বাংলাদেশ রেলওয়ের আকণ্ঠ দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দীন রনি’র (Mohiuddin Roni) নিঃসঙ্গ প্রতিবাদটা দেখছি কয়েকদিন ধরে। ভাই, এভাবে নিঃসঙ্গ শেরপার মতো সিস্টেমের প্রবল তুষারঝড়ের বিরুদ্ধে একা দাঁড়িয়ে যেতে এবং দাঁড়িয়ে থাকতে, বুকের পাটা লাগে। স্বৈরাচার সরকার নানা চোখ রাঙানি আর গুম-খুনের ভয় দেখিয়ে যে পাটা’টা আপনার-আমার ভেঙে দিয়েছে। আমরা ঘরের দেয়ালে পিঠ সিঁটিয়ে হয়ে আছি সাকাচৌ—ধর্ষণ যখন সুনিশ্চিত তখন তা উপভোগ করাই শ্রেয়!

গতকাল মহিউদ্দীন রনি গিয়েছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের সদর দপ্তরে, তার ৬ দফা দাবির স্মারকলিপি হস্তান্তর করতে। সেখানে দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা তাকে দেখে সদর দপ্তরের প্রধান গেট তালাবদ্ধ করে রাখে, তাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। তার সঙ্গে অনেক মিডিয়াকর্মীও ছিলেন, তাদেরও ঢুকতে দেয়া হয়নি। মহিউদ্দীন তার স্মারকলিপিটি রেলওয়ের ডিজির হাতে সরাসরি দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আনসার অফিসার গেট তালাবদ্ধ রেখেই স্মারকলিপিটি তার হাতে দিতে বলেন, তিনি সেটি মহাপরিচালকের হাতে পৌঁছে দেবেন বলে জানান। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অনড় মহিউদ্দীন দীর্ঘ আধা ঘণ্টা সেখানে অবস্থান নিয়ে মহাপরিচালকের হাতে স্মারকলিপি হস্তান্তর করে তবেই ক্ষান্ত হন।

আমার প্রশ্ন হলো, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান দপ্তরের গেট কি তার সেবাগ্রহীতার জন্য বন্ধ করে রাখা যায়? রেলওয়ের অব্যবস্থাপনার দাবি জানাতে যদি চায় কেউ, তার ভয়ে কি রেলওয়ের সদর দপ্তরের গেট তালাবদ্ধ রাখার কোনো রাষ্ট্রীয় বিধান আছে? প্রধান দপ্তরের গেট যদি সেবাগ্রহীতার জন্য তালাবদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে সে যাবে কোথায়? তার তো প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বা জাতীয় সংসদেও যাওয়ার উপায় নেই। সেগুলোতে এত পরিমাণ সিকিউরিটির ঘেরাটোপ, আপনি কখনো সেখানে যাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাববেন না। তাহলে মহিউদ্দীন রনি যাবে কোথায়?

এই রেলওয়ে সদর দপ্তর বানানো প্রতিটি ইটের টাকা তো মহিউদ্দীন রনির মতো কোটি জনগণের পকেট থেকেই খসেছে। এই দপ্তর তো বানানো হয়েছে মানুষকে সেবা করার ব্রত নিয়ে। তাহলে মহিউদ্দীন রনিকে দেখে কেন দপ্তরের গেটে ঝুলিয়ে দেয়া হয় তালা? আমি টাকা দিয়ে কিনছি রেলের ইঞ্জিন, বগি, ব্রডগেজ-মিটারগেজ রেললাইন, আমার টাকা দিয়ে বানাচ্ছি সদর দপ্তরসহ সকল অবকাঠামো, আর আমিই হয়ে যাচ্ছি বহিরাগত, আমাকে দেখে সদর দরজায় পড়ছে তালা। কী আজব না!

আরও আজব ব্যাপার হলো, মহিউদ্দীনের এই ছয় দফা দাবি দেখে রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি সংগঠন দাবি তুলেছে, যদি এই ছয় দফা মেনে নেয়া হয় তাহলে তারা স্ট্রাইক করে পুরো রেল নেটওয়ার্ক অচল করে দেবে। সারাদেশে তারা রেল চলতে দেবে না। চিন্তা করা যায়! দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা সিস্টেমের ভেতরে এতটা তীব্রভাবে মিশে গেছে, এখন যদি আপনি সেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলেন তাহলে আপনি হয়ে যাবেন অপরাধী। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নিতে গেলে আপনাকে বলা হবে দুষ্কৃতিকারী।

দু-চারজন লোক দুর্নীতি করলে সেটা দুর্নীতি। সেটাকে অপরাধই বলা হবে। কিন্তু এই দুর্নীতিকে যখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হবে তখন সেটা অপসারণ করা সরকারের পক্ষেও সম্ভব নয়। সরকার ইচ্ছা করলেই কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে দুর্নীতি তখন আর দূর করতে পারবে না। যদি করতে যায় তাহলে পুরো সিস্টেমটিই ভেঙে পড়বে।

মহিউদ্দীন রনি রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্ট্রাইকের হুমকি শুনে একটি চমৎকার কথা বলেছেন। যদি তারা তার দাবির বিপরীতে সত্যিই স্ট্রাইক করে তাহলে দেশের মেধাবী তরুণরা নিজেদের সিভি নিয়ে এখানে চলে আসুন। যারা যারা স্ট্রাইক করবে, সরকার তাদের বরখাস্ত করে তাদের শূন্য পদে অন দ্য স্পট মেধাবী তরুণদের নিয়োগ দেয়া হবে। ব্রাভো ম্যান!

মহিউদ্দীন রনি রেলওয়ের এই সিস্টেমেটিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে একা দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু তার উচ্চারিত ছয় দফা দাবি কি আমাদেরও দাবি নয়? আমরাও কি রেলের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ভুক্তভোগী নই? তাহলে আমরা কেন কথা বলছি না? কথা তো বলতে হবে। অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা না বললে আপনি আমিও ওই সিস্টেমেটিক দুর্নীতিরই অংশ হয়ে যাব। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, দুজনই সমান অপরাধী। এমনটাই তো শুনে এসেছি আমরা।