(‘প্রিয়তমা’ বইটি নিয়ে মহত্তম বইপাঠ অনুভূতি লিখেছেন (Abdul Kadir Faruq) আবদুল কাদির ফারূক। অনিন্দ্য সুন্দর ছবিটি #সালাহউদ্দীনজাহাঙ্গীরেরবইক্লিক প্রতিযোগিতায় পাঠিয়েছেন আবিদা নুরি। পড়তে থাকুন…)

প্রিয়তমা—রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও রাসূলপত্নীদের জীবনীগ্রন্থ নয়; বরং তাঁদের জীবনের মনোহর গল্পভাষ্য। বাঙলাভাষী মানুষের সামনে বিশেষত মুসলিম নারীদের জন্যে পাথেয় হিসেবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও উম্মুহাতুল মুমিনিনদের সাংসারিক জীবনকে গল্পের আদলে রঙিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে সরসভাবে। কতটা প্রেমময় আর ভালোবাসায় পূর্ণ ছিলো প্রিয়তম রাসূলের সংসার, সগৌরবে তা রচিত হয়েছে। বইয়ের পাতায় পাতায় রয়েছে মানুষের দাম্পত্যজীনের অসংখ্য অনুপম আর অতুল্য শিক্ষণীয় খোরাক। প্রিয়তমা পাঠ করলে অনাগত সকল সভ্যতার জন্য তাদের সাংসারিক প্রেম নক্ষত্রের মতোন প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠবে। যে গ্রহণ করবে এই বইয়ের গল্পগুলো, আলোকিত ও সুখময় আর প্রেমময়ী হয়ে উঠবে তাদের সাংসারিক জীবন।
আরেকটি কথা না বললে না হয়; প্রাশ্চাত্যবাদ ও তাদের প্রেমিকদের কাছে বিতর্কিত, অমীমাংসিত এবং প্রচলিত রয়েছে; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এগারো বিয়ে, সদ্যকিশোরী আয়েশাকে বিয়ে, ইহুদিকন্যাকে উম্মুল মুমিনিন’র মর্যাদায় ভূষিত করাসহ, যতসব অযাচিত অহেতুক বানোয়াট অযুক্তিক প্রশ্ন রয়েছে, সুনিপুণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে এর সমুচিত জবাব এবং পরিশীলিত হয়েছে যথাস্থানে। এখান থেকে শুরু হবে উম্মুল মুমিনিনদের সাংসারিক জীবনের আলোকপাত—
এক
উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ রাযিয়াল্লাহু আনহা—মক্কার সবচেয়ে বিত্তশালী নারী। তাঁর সম্পদের প্রাচুর্য, নিষ্কলুষ চরিত্র এবং পবিত্র জীবনালেখ্য’র জন্যে কুরাইশরা তাকে ‘রাজকুমারী’ নামে ডাকত। দীর্ঘকায়, উজ্জ্বল মুখাবয়ব, চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। যৌবনের লালিমা, আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট ছিল তাঁর দেহাবয়বে সবসময়। চাচাতো ভাই ওয়ারাকার মুখে যেদিন প্রথম শুনেন নবির আগমনের সুসংবাদ, সেদিন থেকে হৃদয়ের ছোট্ট মণিকোঠায় সেই নবির জন্য সাজিয়ে রেখেছেন ভালোবাসার ফুল বাগিচা। এর কয়েকদিন পর আবারও কাবার পাশে বসাবস্থায় এক বৃদ্ধের মুখে শুনেন তাঁর আগমন অত্যাসন্ন। তাঁর হৃদয়ে শুরু হয় তাঁকে কাছে পাওয়ার, তাঁর সহধর্মিণী হওয়ার এক হাহাকার। তাঁকে পাওয়ার এক অজানা তীব্র আশা তাঁর হৃদয়কে সবসময় আনচান করে রাখত। এভাবে আনচান করতে করতে একসময় নবি সা.র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসহ বিভিন্ন গুণাবলির কারণে তাঁকে ব্যবসায়িক কাজে দামেস্ক পাঠান খাদিজা। গোলাম মায়সারার মাধ্যমে নিদর্শন আয়ত্ত করে কিছুটা নিশ্চিত হয়ে যান ইনিই শেষ নবি, কিন্তু সাহসে কোলায় না আবার এভাবে যেন তাঁর দিনও ফুরায় না। একসময় তাঁর অন্তরঙ্গ বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনিয়া খাদিজার অস্থিরতা দেখে বিষয়টি আঁচ করতে পেরে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন এবং উভয়পক্ষের সঙ্গে বাতচিত করেন। অবশেষে নবিজীর পঁচিশ এবং খাদিজার চল্লিশ বছর বয়সে তাঁদের দাম্পত্যজীবন শুরু হয়।
শুরু হয় নবি সা.র সঙ্গে তাঁর সাংসারিক প্রেমময়ী জীবন। খাদিজা রাসূল সা.-কে সবসময় পরম মমতায় জড়িয়ে—নিজের ভালোবাসার বাগডোরে আগলে রেখেছেন। রাসূল পাশে না থাকলে খাদিজার মন সবসময় উচাটন হয়ে থাকত। পাশে এলেই আবার মনে স্বস্তি ও শান্তনা ফিরে আসত। খাদিজা ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভয়াশ্রয়। সবর আর শুকরের অতল আধার। ভালোবাসায় পূর্ণময় প্রেমময়ী এই জীবনের ইতিকথা শোভা পেয়েছে প্রিয়তমা বইয়ের পাতায় পাতায়। খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ’র অধ্যায়ে লেখক মহোদয় প্রাসঙ্গিকভাবে নবিজির পিতার বিয়ে থেকে শুরু করে নবির জন্ম, পিতা-মাতার মৃত্যু। মাতৃসম উম্মে আয়মানের বেদনাবিধুর জীবনকাহিনী সুদীর্ঘ ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন বইটিতে—। অন্যদিকে নবীজির হেরা গুহা থেকে শুরু করে খোদাপ্রদত্ত ওহীর মাধ্যমে নবি হওয়ার সুসংবাদ লাভ করা, শিয়াবে আবি তালিবের কণ্টকাকীর্ণ মূহুর্ত পর্যন্ত অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত ছিলেন মহীয়সী খাদিজা। পাখির ছানার মতো আগলে রেখেছেন নিজের ভালোবাসার চাদরের নিচে। খাদিজা নিজের সর্বস্বকে ইসলামের তরে বিলিয়ে, অপরিসীম ত্যাগ তিতিক্ষার সাক্ষর রেখে, অনুপম নিখুঁত এবং নিখাদ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে মহীয়সী এই নারী পঁয়ষট্টি বছর বয়সে দীর্ঘ পঁচিশ বছরের সাংসারিক জীবনের ইতি টানিয়ে নবুওতের দশম বছর ইহকাল ত্যাগ করেন।
দুই
উম্মুল মুমিনিন সাওদা বিনতে যাময়া রাযিয়াল্লাহু আনহা—মহিরুহতুল্য বটবৃক্ষ হযরত খাদিজা ও পিতৃতুল্য আবু তালিব-কে হারিয়ে নবি সা. যখন একপ্রকার আশ্রয়হীন হয়ে যাযাবরের মতোন সারাদিন অবিশ্রান্ত দীনের দাওয়াত দিয়ে শ্রান্তক্লান্ত শরীরে নীড়ে ফিরেন, তখন হৃদয়টা তাঁদের শূন্যতায় মুচড়ে ওঠত। তাদের মৃত্যুর শোকাভিভূত রাসূলকে ম্রিয়মাণ করে তোলে। রাসূল সা. বিমর্ষ হয়ে পড়েন। খাওলা বিনতে হাকিম প্রথম সারির ইসলাম গ্রহণ একজন নারী। খাদিজার মৃত্যুর পর রাসূল’র বিয়ের প্রয়োজনের কথা ভেবে একধরনের দোলাচলের মধ্যে ভয়ে ভয়ে রাসূল-কে তাঁর মনের অভিব্যক্তি পেশ করলে রাসূল তাকে বলেন, আমার অবস্থা বোঝার চেষ্টা করো, মক্কার মধ্যে আমি এখন সবচেয়ে আলোচিত সমালোচিত ব্যক্তি, আমাকে কে বিয়ে করবে—? খাওলা রাসূল-কে অভয় দিয়ে বললেন, আপনি চাইলে ‘কুমারী’ বিয়ে করতে পারেন আবার বিধবাও বিয়ে করতে পারেন। তারপর খাওলা বিধবা সাওদা আর কুমারী আয়েশার নাম পেশ করেন। তখন নবীজি বলেন, ‘ঠিক আছে তুমি দুজনের ব্যাপারে কথা বলো।’
খাওলার মন নেচে ওঠলো। যাক কিছুটা হলেও রাসূলের মনোবেদনা দূর করতে পারব। হিজরতের তিন বছর আগে; উভয়’র পঞ্চাশ বছর বয়সে দাম্পত্যজীবন সূচনা করেন। সাওদা দীর্ঘাঙ্গী এবং খানিকটা মোটা ছিলেন। তিনি খাদিজার স্থলাভিষিক্ত হয়ে রাসূলের সাংসারিক পরিবারকে দেখভালের দায়িত্ব নেন নিজ কাঁধে। অন্যদিকে রাসূল সা. ইসলাম প্রচারে পূর্ণোদ্যমে আত্মনিয়োগ করেন। খাদিজার পর তিনিই সুদীর্ঘ তেরো বছর রাসূল সা.’র সান্নিধ্যে লাভ করেন। এরমধ্যে কিছুদিনের ভেতর কিশোরী আয়েশাও রাসূলের স্ত্রী করে ঘরে নিয়ে আসেন। শেষ বয়সে রাসূলের জন্যে নিজের ভাগকে আয়েশা রাযি আল্লাহু আনহাকে দিয়ে দেন। প্রাসঙ্গিকভাবে সাওদা’র অধ্যায়ে হিজরতের আলোচনার পাশাপাশি আরও অনেক কিছু স্থান পেয়েছে।
তিন
উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাযিয়াল্লাহু আনহা—নবির পরশে যিনি হয়েছেন পরশপাথর। নবীর সংস্পর্শ আর সোহবতে হয়েছেন হিরকখণ্ড। নবী সা. তাঁকে দুবার স্বপ্ন দেখেছেন বধূবেশে। তারপর ছয়বছর বয়সে বিয়ে করেন; মদিনায় হিজরতের পর আবার স্বপ্নে প্রত্যাদৃষ্ট হয়ে তাঁকে ঘরে তুলে নেন। নবির ঘরে এসেছেন কিশোরী হয়ে ঠিকই; কিন্তু অসাধার মেধাশক্তি বুদ্ধিমত্তা আর প্রখর স্মৃতিশক্তির বলে হয়েছেন মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। একদিন ছোট্ট আয়েশা বাড়ির আঙিনায় কয়েকজন সখীর সঙ্গে পুতুল নিয়ে খেলছিলেন। সেই খেলার মাঠ থেকে তুলে এনে হাত-পা ধুয়ে সাফসুতরো করে চুলগুলো বেঁধে আবূ বকর সিদ্দিক রায়ি. নিজেই মেয়ের বাগদানে সংক্ষিপ্ত খুতবা পাঠ করেন এবং রাসূল তাঁকে বাগদত্তা হিসেবে বরণ করে নেন। শুরু হয় হৃদ্যতাপূর্ণ মমতাপূর্ণ এক অপূর্ব প্রেমময়ী জীবনের সূচনা। আয়েশার মেয়েলি ছেলেমানুষী, অভিমানকে পরম মমতা আর বন্ধুত্বসূলভ আচরণে বিমুগ্ধ করে রাখতেন তিনি। তাঁরা একেঅপরকে এমন ভালোবাসতেন, যদি উপমা দিই, তাহলে ছোট্ট একটি পুস্তিকা রচনা হয় যাবে। মোটাদাগে কথা; এই নশ্বর পৃথ্বীতে তাঁদের ভালোবাসার উপমা পাওয়া বড়োই দুষ্কর। তাঁদের ভালোবাসা আর খুনসুটির গল্প শীলিত হয়েছে এই বইয়ের বিশেষ অধ্যায়ে। পড়লে সত্যিই বিমুগ্ধ হওয়ার মতোন। আয়েশা সিদ্দিকা ছিলেন রাসূলের ছায়াসঙ্গী। একাধারে দশ বছর তিনি রাসূলের ভালোবাসায় স্নাত এক অপরূপ মানবী।
আরবের কলুষিত সমাজব্যবস্থা থেকে ইসলাম যেভাবে নারীকে আলোকিত বারান্দায় এনে উপস্থাপন করেছে, আয়েশা সিদ্দিকা ছিলেন সেই আলোকিত বারান্দার সুরভিত গোলাপ। তার সুবাসে সুবাসিত হয়েছে হাজার সহস্র বাগান। তাঁর এমন অভিজ্ঞতা, জ্ঞান-প্রজ্ঞা-অনুসন্ধিৎসা ছিল, সকলেই ছিলেন নতজানু। নবির ঘরে এসে উম্মুল মুমিনিন হওয়ার পাশাপাশি হয়েছেন ; সময়ের বিজ্ঞ ধর্মবেত্তা। দক্ষ—প্রাজ্ঞ একজন মুহাদ্দিস। প্রাসঙ্গিকভাবে স্থান পেয়েছে, মসজিদে নববীর নির্মাণ, মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রূপরেখা, উম্মুাতুল মুমিনিনদের প্রতি নবির সমতা অসমতার বিষম বর্ণনা। একবিন্দু ফুলের কলঙ্ক স্পর্শ করেনি যাঁর গায়ে সেই মহীরুহতুল্য আয়েশাকে নিয়ে অপবাদ রটনার কুচক্রী মহলের কুটচালের নেপথ্যের কাহিনি বিশদভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষ নবি সা.র হৃদয়ভেজা অশ্রুসিক্ত অসুস্থতার বেদনাবিধুর অবস্থার বর্ণনা। প্রিয়তমা বইটিতে সবচেয়ে বেশি আলোচনা করা হয়েছে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাযিয়াল্লাহু আনহার।
চার
উম্মুল মুমিনিন হযরত হাফসা বিনতে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহা—হাফসার বাইশ এবং রাসূলের পঞ্চাশ বছর বয়সে তাঁদের দাম্পত্যজীবনের সূচনা হয়। তাঁর বিয়ের সময় সাওদা ও আয়েশা আগ থেকেই নবির ঘরে ছিলেন। মাতা-পিতা উভয় দিক থেকে হাফসা ছিলেন বিদূষী, প্রজ্ঞা ও মননে উন্নত, মতপ্রকাশে স্বাধীনচেতা। মোটাদাগে কথা; তিনি তাঁর পিতার তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত। হাফসা বিনতে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহা ধর্মীয় বিষয়ে বরাবরই অনুসন্ধিৎসা ছিলেন, তারজন্য রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে শিক্ষাদীক্ষা দেয়ার জন্যে শিক্ষিত একজন মহিলা রেখে তাঁকে লেখাপড়া শিখিয়ে দক্ষ করে তোলেন। সে সুবাদে হাফসা চিকিৎসা বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। সেসময় যে কজন মহিলা শিক্ষিত ছিলেন, তিনি তাদের অন্যতম। পৃথ্বীতে থাকাবস্থায় আল্লার পক্ষ থেকে বেহেশতে রাসূূলের সঙ্গিনী হওয়ার সুসংবাদ কেবল তিনিই পেয়েছিলেন। তিনি এই সৌভাগ্যের হকদার অর্জন করেছেন। সৌভাগ্য অর্জনের কাহিনি স্বস্থানে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলের সঙ্গে তাঁর দাম্পত্যকাল ছিল আট বছর।
পাঁচ
উম্মুল মুমিনিন হযরত যয়নব বিনতে খোযায়মা রাযিয়াল্লাহু আনহা—তিনি ‘উম্মুল মাসাকিন’ দন-দুঃখীদের জননী নামে পরিচিত ছিলেন। রাসূলের সঙ্গে বিয়ে পর হয়ে গেলেন উম্মুল মুমিনিন। সিরাতবিদ ও ইতিহাসবেত্তাদের মতে রাসূলের সঙ্গে তাঁর দাম্পত্যকাল ছিল মাত্র দুই বা তিন মাস। রাসূলের বাহুডোরে কাটানো সময় ছিল সংক্ষিপ্ত, কিন্তু এর বিনিময়ে তিনি অর্জন করেন এক মহান উপাধি, এক অবিনশ্বর নাম-উম্মুল মুমিনিন। যয়নব বিনতে খোযায়মা রাযিয়াল্লাহু আনহা রাসূলের প্রথম স্ত্রী, যাঁকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে তাঁর জানাযা পড়িয়ে তাঁর লাশের খাটিয়া কাঁধে নিয়ে কবরগাহ যান এবং নিজ হাতে কবরে শোয়ান। পাশাপাশি সাবলীলভাবে বর্ণিত হয়েছে তাঁকে বিয়ের করার লজিক্যাল কাহিনি।
ছয়
উম্মুল মুমিনিন হযরত উম্মে সালামা বিনতে উমাইয়া রাযিয়াল্লাহ আনহা—মদিনা-ইথিওপিয়ায় প্রথম হিজরতকারী এবং প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী নারী ছিলেন তিনি। নবি সা.র সঙ্গে বিবাহ হওয়ার পূর্বে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া বেদনাবিধুর কাহিনি বিশদভাবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রিয়তমা বইটিতে। যয়নব বিনতে খোযায়মা রাযিয়াল্লাহ আনহার মৃত্যুর এক বছর পর নবি সা. তাঁকে খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিয়ে করেন। উম্মে সালাম ছিলেন ভারী সুন্দরী। সুন্দরী হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন বেশ রক্ষণশীল ও লজ্জাবতী-বুদ্ধিমতী এবং বিচক্ষণ একজন নারী। তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার পরিচয় নবী সা. স্থানে স্থানে পেয়েছেন ; বিশেষকরে হোদাইবিয়ার সন্ধির সময়। রাসূলের সঙ্গে তাঁর দাম্পত্যজীবন ছিল উপমাতুল্য। তাঁদের দাম্পত্যকাল ছিল মাত্র সাত বছর; এই সাত বছরে তিনি রাসূল-কে অনেক কিছু দিয়েছেন এবং রাসূলও তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শেখেছেন।
সাত
উম্মুল মুমিনিন হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ রাযিয়াল্লাহু আনহা—তিনি রাসূল সা.র নিকটাত্মীয় এবং যথেষ্ট রূপসী ছিলেন। তাঁর বিয়ের নির্দেশনা এসেছিল সরাসরি আল্লার পক্ষ থেকে। উম্মাহাতুল মুমিনিনদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ওলিমা হয়েছিল তাঁর বিয়ের। দান খয়রাতে তাঁর খ্যাতি ছিল প্রবাদতুল্য। তাঁর বিয়ের নেপথ্যের কাহিনি বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে তাঁর অধ্যায়ে। রাসূলের সঙ্গে তাঁর দাম্পত্যকাল ছিল সাত বছরের। রাসূলের ইন্তেকালের পর উম্মাহাতুল মুমিনদের মধ্যে সর্বপ্রথম তিনি ইহকাল ত্যাগ করেন।
আট
উম্মুল মুমিনিন হযরত জুয়াইরিয়া বিনতে হারিস রাযিয়াল্লাহু আনহা—বিবাহ ও ইসলামপূর্ব তাঁর নাম ছিল বারাহ বিনতে হারিস। তিনি অত্যন্ত ইবাদতগুজার এবং অপূর্ব সুন্দরী নারী ছিলেন। আয়েশা রাযি. বলতেন, ‘নিজের জন্য এবং তাঁর গোত্রের জন্যে জুয়াইরিয়ার চেয়ে সৌভাগ্যের পরশমণি হওয়া আর কোনো উম্মুল মুমিনিনের ভাগ্যে জুটেনি।’ এর নেপথ্যের কাহিনি বিশদভাবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রিয়তমা বইটিতে। নবি সা.’র সঙ্গে তাঁর দাম্পত্যকাল ছিল ছয় বছরের।
নয়
উম্মুল মুমিনিন হযরত উম্মে হাবিবা বিনতে আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহা। ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান নাজাশি’র নিজস্ব বাসভবনে রাসূলের চিঠি’র মাধ্যমে স্বয়ং নাজাশি মধ্যস্থ হয়ে বিয়ের আয়োজন করেন এবং রাসূলের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ চার হাজার দিরহাম মোহর নিজেই আদায় করে নবি সা.র সঙ্গে তাঁর বিয়ের বন্দোবস্ত করেন। ইসলামধর্ম গ্রহণের পর হযরত উম্মে হাবিবা রাযিয়াল্লাহু আনহা দীর্ঘ দশ বছর ইথিওপিয়ায় ছিলেন। সেখানে দীর্ঘদিন থাকার সুবাদে তিনি অনেক কিছু জানা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েন, কিন্তু তিনি এতে পিছপা না হয়ে আগ্রহের সঙ্গে দীনের বিভিন্ন বিষয়াদি আত্মস্থ করে নেন। প্রাসঙ্গিক ভাবে এই অধ্যায়ে ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান নাজাশীর ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি দীর্ঘ দশ বছর তাঁর আশ্রয় দানের সহানুভূতিশীলতার কাহিনি এবং উম্মে হাবিবা’র সঙ্গে রাসূলের বিয়ে কী কী কারণে প্রণিধানযোগ্য তাও বিশদভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
দশ
উম্মুল মুমিনিন হযরত সাফিয়্যা বিনতে হুয়াই রাযিয়াল্লাহু আনহা—ছিলেন ছোটখাটো গড়নের ফরসা অবয়বের। রাজকুমারী থেকে যুদ্ধদাসী হিসেবে করতলগত হয়েছেন তিনি। খায়বার যুদ্ধ থেকে ফিরতে তাঁদের বিয়ে ওয়ালিমা এবং বাসর সম্পাদিত হয়। তিনিও শামিল হয়ে গেলেন উম্মুল মুমিনিনদের কাতারে। রাসূলের সঙ্গে বিয়ের আগে, যেদিন কামুস দুর্গাধিপতির ছেলের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়; সেদিন রাতে তিনি স্বপ্ন দেখেন তাঁর কোলে চাঁদ নেমে এসেছে, রাসূলের সঙ্গে বিয়ে হয়ে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হলো। তিনি যথেষ্ট এবং অসম্ভব সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর চরিত্রে বিন্দু পরিমাণ অহংকার ছিল না। হযরত সাফিয়্যা খুব ভালো রান্না করতে পারতেন। রাসূল জীবনের অন্তিম মূহুর্ত পর্যন্ত স্বজনরা সাফিয়্যার জন্য ভালোবাসার মায়াডোর গলায় পড়িয়ে মদিনায় যেভাবে এনেছেন সেভাবে ভালোবাসা দেখিয়ে গেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবে মজার মজার গল্পের পাশাপাশি বেদনাবিধুর কাহিনিও বর্ণিত হয়েছে প্রিয়তমা বইটিতে।
এগারো
উম্মুল মুমিনিন হযরত মায়মুনা বিনতে হারিস রাযিয়াল্লাহু আনহা—রাসূলের সঙ্গে বিবাহপূর্ব মক্কায় দু-দুবার বৈধব্যের যাতনা নিষ্পেষিত করে তাঁকে। তিন দিনের ভেতর উমরার কার্যাদি শেষ করে মদিনায় ফিরবেন নবি সা.। এরইমধ্যে রাসূলের চাচা হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু তাঁর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। রাসূল সম্মতি পেয়ে তাঁরা বাতচিত করে বিয়ের বন্দোবস্ত করেন এবং সারাফ নামক স্থানে রাত্রিযাপন করেন। সিরাতবিদদের মতে তিনিই রাসূলের বিবাহিত সর্বশেষ স্ত্রী। হযরত মায়মুনার নাম ছিল বাররা। রাসূলের অভ্যাস ছিল কারও নাম অপছন্দ হলে তিনি সুন্দর একটা নাম রেখে দিতেন। সেই সুবাদে তাঁর নাম মায়মুনা রাখা হয়। যার অর্থ ‘সৌভাগ্যের পরশমণি।’ এই অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে আরও অজানা অনেক কিছু। অবশেষে এই মহীয়সী নারী সারাফ নামক স্থানেই জীবনের নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং এখানেই তাঁকে সমাধি দেয়া হয়।
বার
উম্মুল মুমিনিন হযরত মারিয়া কিবতিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহা—তৎকালে মিসরের বাদশা জুরাইজ বিন মাতা নতুন ধর্মের পরিচয় পেয়ে আপ্লূত হয়ে শেষ নবির প্রতি সম্মান প্রদশর্নপূর্বক রাষ্ট্রদূত হাতিব বিন আবি বালতায়া মারফত বেশ কিছু উপঢৌকন প্রেরণ করেন রাসূল সমীপে। সেসব উপঢৌকনের মধ্যে রূপসী ক্রীতদাসী মারিয়া ছিলেন। সমগ্র মিসরে রূপসীকন্যা বলে তাঁর সুনাম ছিল। নবি সা. উম্মাহাতুল মুমিনদের মতোন সমতার ব্যাপারে তাঁকে গুরুত্ব দিতেন। জীবনের অন্তিম মূহুর্ত পর্যন্ত এই অবলা নারীকে তিনি ভালোবাসার বাগডোরে আগলে রেখেছেন। নবির মৃত্যুর সাহাবিরা তাঁর ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। অবশেষে মদিনায় আসার এক বছরের মাথায় তিনি ইব্রাহিম নামে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। এতে রাসূল সা. যারপরনাই খুশি হন, কিন্তু দেড়বছরের মাথায় ইব্রাহিমের ইন্তেকালে নবী সা. খুবই কষ্টপান। প্রাসঙ্গিকভাবে মারিয়া’র প্রতি সাহাবিদের সুধারণার বিভিন্ন কাহিনির স্থান পেয়েছে।
তেরো
উম্মুল মুমিনিন রায়হানা বিনতে জায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহা—বনু কুরায়জা গোত্রের যেসমস্ত মহিলা যুদ্ধবন্দী ছিলেন তাদের মধ্যে রায়হানা বিনতে জায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন। রাসূলের সামনে তাঁকে উপস্থিত করা হলে তিনি বলেন, ‘তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ করো, তাহলে তুমি আমার স্ত্রী হিসেবে সম্মানিত হতে পারবে’ কিন্তু তাঁর মধ্যে জাত্যাভিমান জাগ্রত ছিল এবং স্বামীকে হারিয়ে তাঁর হৃদয় ব্যথায় পূর্ণ ছিল, এ কারণে রাসূলের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি বরং আপনার দাসী হিসেবেই থাকতে পছন্দ করব, আমি মুসলিম নারীদের মতোন মাথায় হিজাব পরতে পছন্দ করি না।’ যদিও স্পর্ধিত উচ্চারণ তবুও নবি রায়হানার প্রস্তাব মেনে নিয়ে তাঁকে অন্যান্য স্ত্রীদের মতোন মর্যাদা দেন। তাঁরজন্য আলাদা পালার দিন নির্ধারিত ছিল এবং তিনি তাঁকে আলাদা বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। রায়হানা’র ব্যাপারে ইতিহাস ও সিরাতগ্রন্থগুলোতে তেমন উল্লেখ নেই। দমশ হিজরিতে তিনি ইনতেকাল করেন। মদিনার জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়েছে।
ঝরঝরে মেদহীন শব্দেশব্দে বাক্যেবাক্যে অসংখ্য অগণিত গল্পভাষ্য, অনবদ্য অনুপম ভাষাশৈলী ও প্রাঞ্জল গদ্যশৈলী আর সুনিপুণ উপস্থাপনায় উম্মুল মুমিনিনদের অনালোচিত অধ্যায় এবং প্রিয়তম রাসূলের দাম্পত্যজীবন নিয়ে রচিত ‘প্রিয়তমা’ বইটি ইতিহাসের এক বর্ণিল আয়োজন হিসেবে মহান রব কবূল করেছেন এবং যুগ যুগান্তর জাতি এই বই থেকে অনায়াসে উপকৃত হবে ইন শা আল্লাহ।

বইয়ের নাম: প্রিয়তমা

লেখক: সালাহউদ্দিন জাহাঙ্গীর

প্রকাশনায়: নবপ্রকাশ

মুদ্রিত মূল্য: ৩৭৫৳

পৃষ্ঠাসংখ্যা : ৩৫২

সংস্করণ: সপ্তম সংস্করণ


২ Comments

MUHAMMAD SOHEL RANA · ১২ এপ্রিল , ২০২২ at ১০:৪২ অপরাহ্ণ

খুবই ভালো লাগে সাজা ভাইজানের প্রতিটি লেখা।হৃদয় ছুঁয়ে যায় তার লেখা।তবে আরো ভালো লিখতে হবে তাকে,আমরা আরো সুন্দর কিছু চাই।ভালোবাসা রইল My Facebook Id
Facebook/SOHELRANA90

    সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর · ২০ জুলাই , ২০২২ at ৯:৩৭ অপরাহ্ণ

    ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য
    আমার ফেসবুক আইডি
    https://www.facebook.com/salahuddinjahangirID/

Comments are closed.