‘আমি পুরো ঘটনার ওপর চোখ রাখছি’—এই বাক্যটা শোনার দ্বারা আপনি কী বুঝলেন? বুঝতে পারলেন, আমি ঘটমান বিষয়টার ওপর নজরদারি করছি এবং কী ঘটছে না ঘটছে সে ব্যাপারে সম্যক জ্ঞান লাভ করার চেষ্টা করছি।

এখন কেউ যদি বলে, না, এই কথার অর্থ হলো, আপনার চোখটা কোটর থেকে খুলে ‘ঘটনা’র ওপর রাখতে হবে। তাহলেই কেবল এই কথার সত্যতা পাওয়া যাবে। যেহেতু বাক্যের মধ্যে ‘ঘটনা’র ওপর চোখ রাখার উল্লেখ আছে, কাজেই ঘটনার ওপর চোখ খুলে না রাখলে বাক্যটা মিথ্যা হবে এবং আপনি হবেন মিথ্যাবাদী!

আমার লেখা ‘প্রিয়তমা’ বই পড়ে এমনই কিছু আকিদার বিষয় সামনে নিয়ে এসেছেন কিছু ‘শব্দবাদী’ পাঠক। ‘প্রিয়তমা’ বইয়ে আমি উল্লেখ করেছি ‘আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান’। তারা বলছেন, না, এটা মুসলিম আকিদার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেননা, আল্লাহ রয়েছেন আরশের উপর এবং তিনি কেবল সেখানেই বিরাজমান। তিনি এ ধুলোর ধরায় বিরাজমান হতে পারেন না।

‘আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান’ এই কথার দ্বারা কেউই কখনো উদ্দেশ্য নেয় না যে আল্লাহ এ পৃথিবীতে এসে বসে আছেন। বরং সবাই বুঝাতে চান, আল্লাহর কর্মসম্পাদন পদ্ধতি, আল্লাহর নির্দেশনা, আল্লাহর টেকনিক্যাল সাপোর্ট এ পৃথিবীর সর্বত্র বিরাজমান।

পৃথিবীতে হাওয়া বইছে, বৃষ্টি হচ্ছে, মানুষ জন্ম নিচ্ছে-মারা যাচ্ছে, ফসল ফলছে, আমরা হাঁটছি, পড়ছি, চোখ মেলে তাকাচ্ছি, গাছেরা বড় হচ্ছে—এই সকল কাজের কর্তা কে? আল্লাহ। আল্লাহর অনুপম কর্মসম্পাদন টেকনোলজি সকল কাজ সুচারুরূপে সম্পাদন করছে। তো, এই সম্পাদন পদ্ধতি তো এককভাবে আল্লাহরই করায়ত্ত। তাহলে আল্লাহর রুবুবিয়্যাত কি সর্বত্র বিরাজমান নয়? যেখানে আল্লাহর রুবুবিয়্যাত অর্থাৎ তার ‘পালনকর্তা’ সত্তা বিদ্যমান সেখানে অবশ্যই আল্লাহর সিফাতও বিদ্যমান। আর আল্লাহর সিফাত বিদ্যমান হওয়া মানে আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দিহান হওয়া।

এখানে আমাদের লেখার প্রথম উদাহরণটি খুব সহজেই মানিয়ে যায়। আল্লাহ আমাদের পালন করছেন বলেই শাব্দিকভাবে আল্লাহর পৃথিবীতে থাকা আবশ্যক নয়। বরং তার রুবুবিয়্যাতের উপস্থিতি তাকে সার্বিকভাবে এখানে রিপ্রেজেন্ট করছে। আর রুবুবিয়্যাত যেহেতু আল্লাহর আবশ্যিক গুণাবলির অন্যতম, সুতরাং সেই রুবুবিয়্যাতের মাধ্যমে তিনি জমিন ও আসমান সকল অন্তরীক্ষে বিরাজমান।

আল-কুরআনে আল্লাহ বহুবার বলেছেন, ‘এই সকল আসমান ও পৃথিবীর যাবতীয় কর্তৃত্ব আমার’—লাহু মা ফিস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ…।’ তিনি সুরা নুর-এ বলেছেন, ‘আল্লাহ সকল আসমান ও পৃথিবীর আলো’—আল্লাহু নুরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ…। আলো তো সর্বত্র বিরাজমান। সেটাকে বাধা দেয়ার কোনো উপায় নেই। সে হিসেবেও আল্লাহর আলোর সর্বত্র বিরাজমান হওয়া স্বাভাবিক।

শুধু শব্দকে ধরে ধরে যদি আকিদার ভুল ধরা হয়, তাহলে পৃথিবীতে ভাষা বলতে কিছু থাকবে না। যারা এ ধরনের ভাষা-অজ্ঞতা থেকে আকিদার ভুল খুঁজে বের করে, তাদের ভাষাজ্ঞান নিতান্ত দরিদ্র। প্রতিটি ভাষায় নানা উপমা-উৎপ্রেক্ষা, মেটাফোর, রূপকল্প ব্যবহার করা হয়। এগুলো ভাষার আবশ্যিক অনুষঙ্গ, ভাষার সুষমা। ‘আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান’—এটিও একটি রূপক বাক্য। এর দ্বারা কখনোই স্বয়ং আল্লাহর উপস্থিতি পৃথিবীতে কামনা করা হয় না। বরং এর দ্বারা রূপকভাবে আল্লাহর পৃথিবী পরিচালন-পদ্ধতিকে ইঙ্গিত করা হয়।

ভাষার এই সাধারণ রূপকাশ্রয়ী বাক্য যদি বুঝতে না পারেন তাহলে আপনাদের জন্য নতুন করে আবার বাল্যশিক্ষা পড়ার পরামর্শ দেয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকবে না।

দুই

‘প্রিয়তমা’ বই থেকে আরেকটি বাক্য তারা উল্লেখ করেছেন যেটি আমি লিখেছি—‘আল্লাহ নিরাকার’। কিন্তু তারা বলছেন, না, আল্লাহর আকার আছে কিন্তু সেই আকারটা কেমন সেটা আমরা জানি না।

এই কথার মধ্যেও শুধুই ভাষাজ্ঞানের স্বল্পতা পরিলক্ষিত হয়। এ যেন অন্ধের হাতি-দর্শনের মতো অবস্থা। চারজন অন্ধকে নিয়া যাওয়া হলো হাতি দেখাতে। তো পাঁচজনের কেউ হাতির পা ধরল, কেউ ধরল শুঁড়, কেউবা ধরল বিশাল বড় কান, কেউ আবার হাতির দাঁত ধরে হাতি দেখা শেষ করল। হাতি দেখাটেখা শেষ হলে একজন একজন করে জিজ্ঞেস করা হলো, হাতি দেখতে কেমন? যে পা ধরেছিল সে বলল, হাতি দেখতে গাছের মতো। যে শুঁড় ধরেছিল সে বলল, ধুর বোকা, হাতি তো পাইপের মতো। কান ধরা অন্ধ বলল, হাতি দেখতে কুলার মতো। আর যে দাঁত ধরেছিল সে বলল, আহাম্মকের দল, হাতি দেখতে তলোয়ারের মতো।

আমাদের ব্যাপারও হয়েছে এমন। আমরা নিজেদের মতো আল্লাহর আকার নির্ধারণ করে বসে আছি।

আল্লাহর অবশ্যই আকার আছে। কারণ কুরআন ও হাদিসে আল্লাহর ‘আকার’ নির্ধারণযোগ্য নানা আঙ্গিক বিবরণ এসেছে। সুতরাং আল্লাহর আকার যে আছে সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, আপনার চোখে আল্লাহর আকার কী? আল্লাহ দেখতে কেমন, সে বিষয়ে আপনি নির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারবেন? অথবা তার কোনো অবয়ব বা আকার তুলে ধরতে পারবেন? পারবেন না। কারণ আল্লাহর কোনো আকার মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়নি এবং ইহলৌকিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেটা সম্ভবও নয়। সুতরাং যে জিনিসের কোনো আকার আমাদের দৃষ্টি ধরতে পারবে না, সেটা কি নিরাকার নয়? স্বয়ং আল্লাহ নিরাকার নন, কিন্তু আমাদের দৃষ্টির সীমাবদ্ধতায় তিনি আমাদের কাছে আকারহীন। আর যে জিনিস আমাদের চোখে আকারহীন তাই তো নিরাকার।

একটা জিনিস চারকোনা, একটা জিনিস গোল, একটা জিনিস জ্যামিতিক ত্রিকোণা, কোনোটা বহুকোণ ইত্যাদি প্রতিটি জিনিসেরই কোনো না কোনো আকার আছে বা শেপ আছে। এমন আকার বা শেপহীন কোনো পদার্থের অস্তিত্ব নেই পৃথিবীতে। এমনকি বাতাসেরও ভর আছে এবং আলোরও গতিবেগ আছে। এগুলোর অস্তিত্ব আমরা আমাদের ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে পারি। বাতাস লাগলে ঠাণ্ডা লাগে, রোদ লাগলে গরম।

কিন্তু আল্লাহর আকার কি আমরা নির্ধারন করতে পেরেছি? না, পারিনি। সুতরাং যে জিনিস আমাদের পার্থিব সীমাবদ্ধ দৃষ্টিতে আমরা ধরতে পারি না, সেটা আমাদের কাছে নিরাকার। কিন্তু আল্লাহ নিরাকার নন। তাঁর অবশ্যই সুমহান আকার রয়েছে। তবে আমাদের পার্থিব দৃষ্টি তার আকার ধরতে সক্ষম নয় বিধায় আমরা তাঁকে ‘নিরাকার’ বলে থাকি। তাঁর রুবুবিয়্যাত কখনোই নিরাকার নয়।

আপনাদের বোকা বোকা শব্দবাদী ও দেহবাদী প্রশ্ন দেখে আমার হাসিও আসে আবার দুঃখও লাগে।

তিন

‘প্রিয়তমা’ নিয়ে এই প্রশ্ন আমি দেখেছিলাম সম্ভবত আরও প্রায় দুই-তিন বছর আগে, আলী হাসান উসামার পোস্টে। তিনিই সর্বপ্রথম এ বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন। তার থেকে আকিদা ধার করে তার সঙ্গী-সাথীরা পরবর্তীতে নানা সময়ে এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করতে চেষ্টা করেছেন। কোনোটা আমার চোখে পড়েছে, আবার কোনোটা হয়তো আমার চোখে পড়েনি। তবে যেখানেই এ বিষয়ে আলোচনা দেখেছি, আমি সযত্নে এসব আকিদাগত বিষয় এড়িয়ে গিয়েছি। আকিদা নিয়ে আমার ‘আকিদা’ খুব সিম্পল: যে কালিমায়ে শাহাদাতের ওপর মৌখিক, আন্তরিক ও কর্মগত বিশ্বাস রাখে, সে মুসলমান। সুতরাং এ নিয়ে কারো সঙ্গে বহস করার খাহেশ আমার হয়নি কখনো।

তাছাড়া ফেসবুকের মতো গরু-গাধা-পণ্ডিত সর্বস্ব প্লাটফর্মে তর্ক-ক্যাচাল করে আজ তক কোনো সমস্যার সুরাহা হয়েছে বলে আমি দেখিনি। আর আকিদার মতো স্পর্শকাতর বিষয় তো আরও মারাত্মক। যখন তখন যে কেউ মুমিন হয়ে পোস্ট দিচ্ছে আর কাফের-মুশরিক হয়ে কমেন্ট করছে। ভয়াবহ অবস্থা! মানুষকে তাকফির করার প্রতিযোগিতা চলছে যেন।

দিনশেষে একদল লোক নিজেদের মধ্যে আত্মগৌরব করে বলছে, আমি আজকে ২৪ জনকে কাফের বানিয়েছি। আরেকজন বলছে, আমি মুশরিক বানিয়েছি ৭২ জনকে। কেউ হয়তো আরও এগিয়ে গিয়ে বলছে, আমি পুরো দলকে খারেজি-শিয়া-মুশরিক করে এসেছি। তোমার চেয়ে জীবনযুদ্ধে আমি এগিয়ে আছি বন্ধু!

ফারুক ফেরদৌস ভাই চমৎকার কথা বলেছিলেন, সোসাইটির জন্য কিছু গুণ্ডা পালতে হয়, এই তরিকার লোকজন হলো বঙ্গদেশের এস্লামি গুণ্ডা। সমাজে এদেরও প্রয়োজন আছে। হয়তো বা, কে জানে!

ভাই, ইসলাম এসেছে মানুষকে জাহান্নাম থেকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যেতে। যত সম্ভব মানুষকে জান্নাতের দিকে পথ দেখানোর প্রতিযোগিতা যেখানে ছিল আমাদের মাকসাদ, সেখানে আমরা মানুষের পা ধরে টেনে টেনে জাহান্নামে হড়কে নিচ্ছি। মানুষকে জান্নাতের আশা থেকে নিরাশ করবেন না, প্লিজ। সামান্য সামান্য কারণে কাউকে কাফের বানাবেন না দয়া করে। আল্লাহর নবী (সা.) এই উম্মতকে জান্নাতে নেয়ার জন্য দিন-রাত কেঁদেছেন। যার বুকে এক বিন্দু ঈমানের আলো দেখেছেন, তাকেই বলেছেন: মান ক্বলা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ফাদাখালাল জান্নাহ।

মানুষ আলেম ও আপনাদের মতো জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছ থেকে ভালোবাসা চায়। কেবল গুটিকয়েক মানুষকে নিয়ে জান্নাতে নিয়ে গেলে আল্লাহর জান্নাতে কম পড়ে যাবে না। জান্নাত সীমাহীন। চেষ্টা করুন প্রত্যেক বনি আদমকে সেখানে জায়গা করে দিতে। এ আপনার দায়িত্ব। এ আমার দায়িত্ব। আমরা হয়তো আমাদের দায়িত্ব ভুলে অন্য কারো পাতানো খেলা খেলছি।

আল্লাহ আমাদের এইসব ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত থেকে বিরত হয়ে উম্মাহর ভালোবাসায় একতাবদ্ধ হওয়ার তওফিক দান করুন।