লিখেছেন নেছারুদ্দীন রুম্মান

১. ইয়া আফরোজা-য় আমার দেখা মতে (আমি আলো-আঁধারিতে বইটি পড়েছি। আর আমার চোখের আলোও খুব কম।) দুইটি মুদ্রণপ্রমাদ আছে। বানানভুল আছে বেশ কয়েকটি, পুনরুক্তি ছাড়াই বেশ কয়েকটি; ওগুলো মুদ্রণপ্রমাদ নয়, নিরেট ভুল।

২. কিছু শব্দ আছে ইয়া আফরোজা-য়, যা সাজা ভাইয়ের নিজস্ব শব্দ। কোনো আভিধানিক যোগ এর সাথে নেই; যেমন : অস্ত্রাক্ত, ভুলেল, স্রোতেলা (আরও আছে। এখন মনে নেই। বারবার পড়ার পরও আমার স্মৃতিতে কিছু থাকতে চায় না। আর ইয়া আফরোজা তো মাত্র একবার পড়তে পেরেছি।)। এই শব্দগুলো সাজা ভাইয়ের একান্ত নিজের। এই শব্দগুলোর দিকে আমি শিল্পশমিত ঈর্ষা নিয়ে তাকাই। কিন্তু এর অনুকরণে কোনো কিছু বানাতে প্রবৃত্ত হই না; আমার মন সায় দেয় না। কেননা আমি জানি, তাতে আমি একটি নতুন শব্দ তৈরি করতে পারলেও সাজার ভাইয়ের মৌলিকত্বের কাছে হজম হয়ে যাবো। এবং আমি মনে করি, অন্য কেউ এরকম করলে তারও এমনই হবে। যদিও এও জানি, এত সবের পরও হজম হয়ে যাওয়াই হবে কারো-কারো অলঙ্ঘ্য পরিণতি; কিন্তু আমার সে বরাত না হোক।

৩. জাগতিক প্রেমের সাথে আধ্যাত্মিকতার স্ফুরণ ও সংযোগ, সাজা ভাইয়ের স্বাতন্ত্র্য । তিরিশ ও উত্তর-তিরিশের কবিতা-ইতিহাস মনে রেখে সাজা ভাইয়ের কবিতার প্রধান লক্ষণ ও মৌলিকত্ব হিশেবে একে শনাক্ত করা যায়। সচেতন কবিতামোদী পাঠক এতে একমত হবেন বলেও আমার মনে হয়।

৪. ২ ও ৩-এ যা বললাম, তা ছাড়া ইয়া আফরোজা-য় আর কোনো স্বতন্ত্র চিহ্ন নেই : না কবিতার ভাষায় আছে, না তার আঙ্গিকে; না আছে কবিতার উচ্চারণ বা কাঠামোতে। অথচ বিষয় ও শব্দের সাথে-সাথে উচ্চারণ, কাঠামো ও আঙ্গিকের স্বাতন্ত্র্যও স্বতন্ত্র হয়ে ওঠার জন্য জরুরি বিষয়। অবশ্য এও শিল্পনিষ্ঠতার দায়ে স্বীকার্য যে, সাজা ভাইয়ের কাছে বিষয় ও প্রসঙ্গের যে অভিনবত্ব আছে, সে গুণ থাকার পর এইসব গুণ বা কলা আয়ত্ত করা সময়ের ব্যাপার শুধু।

৫. পুরোটা ইয়া আফরোজা একটি হজম-হয়ে-যাওয়া কবিতা-পঙক্তির দিস্তা। এতে শুধু জনপ্রিয় কবিদের ও তাদের জনপ্রিয় উচ্চারণ ও বক্তব্যের উদ্গার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সাজা ভাই হজম হয়ে গেছেন সুনীল, আবুল হাসান, শক্তি, গুণ, রুদ্র, হেলাল হাফিজ এমনকি ক্ষেত্রভেদে নীরেন্দ্রনাথের কাছেও। তিনি যা যা উচ্চারণ করেছেন ইয়া আফরোজা-য়, তাতে বিষয়ের মৌলিকত্ব ছাড়া শুধুই উদগীরণ হয়েছে অনুকরণকলার। আর এজন্যেই ইয়া আফরোজা-য় আছে অসংখ্য স্মরণীয় পঙক্তি। এককথায়, ইয়া আফরোজা-র নিজস্ব কোনো আলো নেই, অন্যের আলোয় সে আলোকিত। যদিও, স্পষ্ট বলি, মুখ রক্ষার্থে নয় (আমার সে দায় নেই। যারা আমাকে চেনে, তারা এই ব্যাপার জানে।), শিল্পেরই দায় থেকে, অনুকরণের এই প্রভাব কোনো বড় বিষয় নয়, (আবার ধুচ্ছাই-করা হালকা বিষয়ও নয়,) যদি কারো সত্তায় মৌলিকত্বের উপাদান সত্যিই থাকে। আধুনিক বাঙলা কবিতার প্রধানতম মৌলিক স্বর জীবনানন্দ তার প্রথম কবিতাগ্রন্থে নজরুলপ্রভাবিত ছিলেন। কিন্তু এর পর থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত জীবনানন্দ স্বতন্ত্র সুর, স্বর ও বিষয়ের কবি। কোনো কবির চারিত্রলক্ষণ শনাক্ত করার এই হলো উপকার। সেই উপকারের বিবেচনায় এই বিষয়গুলো বললাম। আরও বললাম, ব্যাপারগুলো খসড়া আকারে কোনো জায়গায় থেকে যাওয়ার প্রয়োজনে।

৬. যদিও সাজা ভাই সবসময় বলে এসেছেন, তিনি ছন্দ জানেন না, বোঝেন না, তবুও ইয়া আফরোজায় আছে ছন্দের কবিতাও। আর সেই প্রতিটি ছন্দকবিতাই পতন-আক্রান্ত। ছন্দ অনেক ধরনের থাকলেও প্রধান তিন ছন্দের মধ্য থেকে দুই ছন্দে তিনি কবিতা লিখেছেন : ১. স্বরবৃত্ত; ২. মাত্রাবৃত্ত। কথা হলো, এই দুই ছন্দের কোনো ছন্দেই না তিনি নতুন কোনো ব্যবহার বা বিষয় আনতে পেরেছেন, না পেরেছেন ছন্দের পর্ব-মাত্রা-পঙক্তি-চরণ ঠিক রাখতে। সাজা ভাই ছন্দের এই ব্যাপার যত হেলাখেলাতেই এড়িয়ে যান না কেন, তার মনে থাকা দরকার, বাঙলা কবিতা এবং তার কবিতার প্রধান লক্ষণ সুর, লিরিকধর্মিতা বা গীতলতা; আর এই সুরধর্মিতাই বাঙলা কবিতাকে জনতার কাতারে নিয়ে যায়; জনতাকে পুঁজি করে চলতে-চাওয়া সাজা ভাইয়ের এ হলো জন-উন্নাসিক এক চলন, যার কারণে তিনি নিজেকে জনকবি উপাধি দিতেও আমাদের বাধা দিয়ে রাখেন।

৭. সাজা ভাইয়ের কবিতার সবচে বড় ফাঁক ও ক্ষত বাক্যের অসঙ্গতি ও অনর্থকতা। এই অসঙ্গতি ও অনর্থকতামুক্ত কোনো কবিতা তার পাওয়া গেলেও তার সংখ্যা নেহাত হাতেগোনা ও অপ্রতুল। শব্দের মারপ্যাঁচে তিনি বোকা পাঠকদের সে অসঙ্গতি ও অনর্থকতায় আটকালেও কোনো সচেতন কবিতামোদী ও প্রেমী তার এ অনাচার মানবেন না। কিন্তু তার কথায় এমন উইট এমনিতেই আছে, যাতে পাঠক আটকে থাকে; অযথা এই ভুলের আবর্জনা দিয়ে কবিতার গা ময়লা করার কোনো মানে নেই। বাক্যের অসঙ্গতি ও অনর্থকতামুক্ত উইটের পক্ষে একটি উদাহরণ বিশ্বাসী তিল কবিতাটি। আর আলোচ্য অসঙ্গতি ও অনর্থকতার উদাহরণ সম্পূর্ণ ইয়া আফরোজা বইটি। এই ফাঁক এবং ক্ষত নিয়েও মৌলিকতার পথে হাঁটা যায় না।

৮. ইয়া আফরোজা নিয়ে এত কথা বলার কারণ হলো, এর ভেতরকার কাব্যিক যাত্রা; এবং এর জনপ্রিয় হয়ে ওঠার অপার ক্ষমতা। তবে আমার এসব কথা কখনোই এর জনপ্রিয়তায় বাধা হবে না। হবে না কবিতার অভিজাত ভুবনের সাথে এ প্রজন্মের কোনো সম্পর্ক না-থাকার সুবিধাতেই। তবে, ইয়া আফরোজা যে কওমি ঘরানা থেকে প্রকাশিত কবিতার সফরে একটি আলাদা নাম, এটাও মনে রাখার মতো কথা। হেলাল হাফিজ নিজে হজম হয়ে যাওয়া কবি হলেও পুরো কয়েকটি প্রজন্মকে সে আছাড় খাইয়ে ছাড়ছে এই জনতা দিয়েই। যদিও পরবর্তীতে অনেক আছাড়-খানেওয়ালাই ওই আছাড়ে শোচনা অনুভব করেন, তবু আছাড় খাওয়ানোর গুণ যে তার আছে, ওটাই বাইরের দুনিয়ায় বড় কথা। আর এই গুণ ও বড় কথা ইয়া আফরোজা-র বেলাও সত্য। কামনা, সে সত্য দ্রুত ফলবান হোক।

৯. আচ্ছা, প্রমীলাজগত কি ইয়া আফরোজা-র খোঁজখবর পায়নি। পেলে তাদের প্রতিক্রিয়া বা মূল্যায়ন কী, জানার খায়েশ রাখি। নারীকে এত আরশ-কুরসি হেলাল হাফিজ তো ছাড়, গালিবও দেখায়নি। ইয়া আফরোজা-র ব্যাপারে তাদের বক্তব্য মূল্যবান।

১০. ইয়া আফরোজা-য় আমার দুইটি পছন্দের কবিতা অন্তভুর্ক্ত হয়নি : ১. তিলোত্তমা-০৩ (এটি সম্পূর্ণ হজম-হওয়া একটি কবিতা। সেই কবিতাটি শক্তির। নাম পরমাদ। ছন্দ-বিষয়-উচ্চারণ—সব দিক থেকে হজম-হওয়া কবিতা এটি। লিখনী-প্রকাশিত প্রথম ঈদ-সংখ্যায় কবিতাটি পাওয়া যাবে। আর শক্তির পরমাদ কবিতা পড়ে সাজা ভাইয়ের ব্যাপারে-বলা আমার হজমসংক্রান্ত বক্তব্যের তালাশ পাওয়া যাবে।); ২. বৃক্ষ যত বড় হয়/বৃক্ষ তত নত হয়—এই পঙক্তিসম্বলিত একটি কবিতা, যা নবধ্বনি-র কোনো প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয়েছিলো। এই কবিতাটি অত্যন্ত ভালো এবং সম্পন্নতায় গুণী একটি কবিতা। এই কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হলে বিশ্বাসী তিলের পর আরও একটি ভালো কবিতা ইয়া আফরোজা-র কাছে থেকে যেতো।

১১. এই এগারোটি ধারা এবং আগের প্রতিক্রিয়া (যা আমার টাইমলাইনে আছে), ইয়া আফরোজা নিয়ে আমার ভেতরে জমা-হওয়া বিচ্ছিন্ন ভাবনা/মূল্যায়ন/চিন্তা/বিশ্লেষণ/ব্যবচ্ছেদের খসড়া। এসবের নানাবিধ ব্যাখ্যা আছে। তার বিবরণ অন্য কেউ দেবেন বা আমাদের মূক হয়ে থাকা হবে আমাদের চিরাচরিত স্বভাবমতো। তবে সব চিরায়ত গৎ-গণ্ডির বাইরে আমার এগুলো বলে দেওয়ারই ছিলো। আর আমার যা বলার বা না-বলার, তার ব্যাপারে আমি কারো অনুরোধ-উপরোধ, নিষেধ-বারণ অথবা কোনো কিছুর বা না-কিছুর অপেক্ষা করি না। তবে এই কথাগুলো এখানে (টাইমলাইনে না-বলে আসহাবে কাহাফ-এ) বলার কারণ বিবিধ। সেই বিবিধ কারণ, যে যেমন ইচ্ছে অনুমান করে নেবেন, তাতে কোনো ক্ষতি নেই।

১২. আমি চাই— সবাই ইয়া আফরোজা পড়ুক। পরস্পরকে উপহার দিক। চাই— ইয়া আফরোজা এক কবিতাগামী কিশোরকে বিভ্রান্ত করুক এবং আবার একদা সে এই বই ছুড়ে ফেলুক সেই বিভ্রান্তিরই লজ্জায়। আমি চাই— ইয়া আফরোজা পড়ে এক কিশোরী বুঝুক এই জগত কীভাবে-কীভাবে তার প্রতি হরদম-হরদম হাহাকার করে ওঠে; রমণী বুঝুক— সে-ই সেই আফরোজা, যার তিল জুড়ে জ্বলজ্বল করে আস্তিকতার মোহন-মন্দ্র সবক। আমি চাই— ইয়া আফরোজা-র এই বাজারি কবিতা পড়ে এক পরস্ত্রীভ্রান্ত স্বামী তার সকল সত্তা নিয়ে আরেকবার নত হোক তার ঐকান্তিক আফরোজার সামনে। আর আমি এসব চাই ইয়া আফরোজা-র কবিতাগুণের প্রতি বিবিধ ও তাবৎ সন্দেহ নিয়েই। ইয়া আফরোজা পড়ে কোনো সম্পন্ন পাঠকের কপাল কোঁচকালেও সে নীরব থাকুক এই মহামারী সম্পর্কে—কত বাজারি জিনিসেই তো বাজার নষ্ট হয়— ইয়া আফরোজা-য় তার শ্যেনদৃষ্টি না-পড়ুক— এও আমি চাই।