বঙ্গদেশীয় মুসলিমদের নামের শেষে ‘হোসাইন’/‘হোসেন’ বা ‘হাসান’ বা ‘আলী’ ‘ফাতেমা’ পদবী যুক্ত করার যে প্রবণতা, এই প্রবণতার পেছনে বিশেষত্ব কী? পৃথিবীর অন্য মুসলিম দেশগুলোর কোথাও এত ব্যাপকভাবে এ নামগুলোর নামকরণ প্রথা লক্ষ করা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে এমন দেখা যায় কেন? বাংলাদেশেই বা কেন মুসলিমদের এমন নামকরণ প্রথা চালু হলো? এর উৎপত্তি হলো কীভাবে?

যেমন মুহাম্মদ আলী, জামিল হোসাইন, শওকত হোসেন, মেহেদী হাসান ইত্যাদি। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, আপনার নিজের কিংবা আপনার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজনের মাঝে ৪০-৫০ শতাংশ মানুষের নামের সঙ্গে এমন অভিধাগুলো যুক্ত আছে। আলী, হাসান, হোসেন/হোসাইন নামগুলো কিন্তু অধিকাংশের মূল নাম নয়, তাদের বংশীয় পদবী বা পারিবারিক পদবীও নয়। তবু এ প্রশংসাসূচক নামগুলো তাদের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।

পৃথিবীর অনেক দেশে আপনি আলী, হোসাইন, হাসান নামে বহু মুসলিম পাবেন। মুসলিম সমাজে এগুলো খুব কমন নাম। আমাদের দেশেও এ নামের অনেক মুসলিম রয়েছেন। নবীজির পরিবারের প্রতি ভালোবাসা থেকেই মুসলিম সম্প্রদায় এমন নামকরণ করে থাকে। সেগুলো তাদের মূল নাম হিসেবেই নামকরণ করা হয়। তবে বাংলাদেশই একমাত্র ভূখণ্ড যেখানে মুসলিমদের বিরাট একটি অংশ তাদের মূল নামের শেষে ‘হোসাইন’/‘হোসেন’ বা ‘হাসান’ বা ‘আলী’ অতিরিক্ত যুক্ত করে থাকে।

হয়তো ভারতের কোথাও কোথাও এবং পাকিস্তানে অল্পবিস্তর এর প্রবণতা লক্ষ করা যেতে পারে। পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম দেশে হয়তোবা সামান্য প্রবণতা থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশের মতো এমন গণহারে সকল নামের শেষে এসব পদবী ব্যবহার আর কোথাও নেই হয়তোবা। এর কারণ কী?

 

দুই

বাংলাদেশের ধর্মীয় অঙ্গন ঐতিহাসিকভাবে নানা দিক থেকে শিয়া প্রভাবে প্রভাবান্বিত ছিল, এখনও আছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। কীভাবে এটা শুরু হলো, সে বিষয়টা নিয়ে খানিকটা আলাপ করা যায়।

শিয়ারা কখন প্রথম বাংলায় এসেছিল, এ নিয়ে দুটো মত আছে। একটা মত হলো, ১৪৭৪ সালে পারস্যের শাসক বারবাক শাহ তদানীন্তন ইসমাইল গাজী নামের একজন সুফি সাধককে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। কারণ এই সুফি ইসলামি মরমিবাদের সঙ্গে যোগী ও তান্ত্রিক দর্শনের সমন্বয়ে নতুন এক মতবাদের উদ্ভব ঘটিয়েছিলেন। তার এই যৌগিক মরমিবাদকে উৎখাত করতে সুলতান বারবাক শাহ তাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিলে তিনি তার ভক্ত-অনুরক্ত নিয়ে জাহাজযোগে পালিয়ে বাংলায় চলে আসেন এবং এখানে থিতু হন। তবে তিনি কোথায় বসতি স্থাপন করেন, এ ব্যাপারে ইতিহাসের সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

দ্বিতীয় মতটি হলো, ১৪৯৯ সালে শেখ সালামত নামের একজন প্রভাবশালী শিয়া ব্যক্তিত্ব ইরানের ইস্পাহান থেকে বাংলাদেশের কুলাউড়া উপজেলার প্রিথিমপাশা গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। তার ছেলে ইসমাইল খান লোধী তখনকার সুলতানের কাছ থেকে প্রিথিমপাশায় জায়গির লাভ করেন এবং বেশ প্রতিপত্তির সঙ্গে সেখানে বসবাস করতে থাকেন।

বাংলাদেশে শিয়াদের ব্যাপক আগমন ও প্রভাব শুরু হয় দিল্লিতে মুঘল শাসনামলে। আরও স্পেসিফিকলি বললে, ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়কাল থেকে। জাহাঙ্গীরের বেগম নুরজাহান (মেহেরুন্নিসা) ছিলেন শিয়া ধর্মাবলম্বী এবং তিনি উপমহাদেশে শিয়া মতবাদ প্রসারে বেশ ভালো ভূমিকা রাখেন।

জাহাঙ্গীর দিল্লির মসনদে সমাসীন হন ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে। এর তিন বছর পর ১৬০৮ সালে বাংলাদেশের প্রথম ইমামবাড়া নির্মিত হয় ঢাকার ফরাশগঞ্জে। আমির খান নামের একজন শিয়া ব্যক্তি এটি নির্মাণ করেন, যেটাকে ‘বিবি কা রওজা’ নামে ডাকা হয়।

বাংলাদেশে প্রথম শিয়া গভর্নর (সুবাদার) নিয়োগ দেন জাহাঙ্গীর ১৬১৭ খ্রিষ্টাব্দে, নুরজাহানের ভাই ইবরাহিম খান ফতেহ জঙ্গকে। আর দশজন সুবাদারের মতো ফতেহ জঙ্গও তার সাথে করে বিরাট সংখ্যক শিয়া পরিষদ ও সেনা নিয়ে আসেন। ১৬২০ সালে আরাকানের মগ জলদস্যুরা বাংলার রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর আক্রমণ করতে এলে ফতেহ জঙ্গ তাদের পরাজিত করে ৪০০ রণতরী হস্তগত করেন। ধারণা করা হয়, মগদের এই আক্রমণ থেকেই ঢাকার মগবাজারের নামকরণ করা হয়েছে।

মুঘল বাদশাহরা যদিও সুন্নি ছিলেন, কিন্তু তাদের বেগম হিসেবে নানা ধর্মের পত্নী-উপপত্নীদের উপস্থিতি ছিল। ধর্মের বহুধা বিশ্বাসই ছিল তাদের শাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। জাহাঙ্গীরের শিয়া বেগম নুরজাহান মুঘল শাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। শুধু সৌন্দর্য নয়, বিদ্যা বুদ্ধিতেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। জাহাঙ্গীরের অতিরিক্ত মদ্যপান ও আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার দরুণ মুঘল দরবারের প্রতিটি প্রশাসনিক কাজে তিনি প্রভাব বিস্তার করতেন।

পরবর্তী সম্রাট শাহজাহান বিয়ে করেন নুরজাহানের বড় ভাই আবুল হাসান আসফ খানের মেয়ে মুমতাজ মহলকে (আরজুমান্দ বানু বেগম)। পারিবারিকভাবেই তিনি ছিলেন শিয়া। মুমতাজের ছেলে শাহ সুজা 1641 সালে বাংলার সুবাদার হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি নিজে সুন্নি হলেও সঙ্গে নিয়ে আসেন ৩০০ শিয়া পরিষদ ও সৈন্য-সামন্ত। তিনি তাদেরকে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে জায়গির দিয়ে বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করেন। আগে থেকেই তার ব্যাপারে জনশ্রুতি ছিল যে তিনি শিয়া অনুরাগী। কারণ তাকে ছোটবেলায় লালন-পালন করেছিলেন নুরজাহান। তার তত্ত্বাবধানে তিনি বেশ পোক্তভাবেই শিয়া মতবাদের অনুরক্ত হন।

শাহ সুজার সময়কালের শুরুতেই ১৬৪২ সালে তার শিয়া নৌসেনাপতি সাইয়েদ মুরাদ ঢাকার বখশিবাজারে নির্মাণ করেন হোসাইনি দালান এবং এখান থেকেই সর্বপ্রথম তাজিয়া মিছিল ও মুহাররমের মাতম অনুষ্ঠান শুরু হয়। চকবাজারের বড় কাটারা নির্মাণ করেন শাহ সুজা।

পরবর্তীতে বাংলার দুজন প্রভাবশালী মুঘল সুবাদারের দুজনই ছিলেন শিয়া—মির জুমলা (মির মুহাম্মদ সাইয়েদ আর্দিস্তানি) এবং শায়েস্তা খান (মির্জা আবু তালিব)। মির্জা আবু তালিব শায়েস্তা খান ছিলেন সম্রাজ্ঞী মুমতাজের ভাই, অর্থাৎ সম্রাট শাহজাহানের শালা এবং শাহ সুজার মামা। অন্যদিকে মীর জুমলা কোনো রয়্যাল ফ্যামিলির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ইস্পাহানের এক দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে বিরাট হীরা ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি। সেখান থেকেই মুঘল রাজপরিবারের সঙ্গে সখ্যতা এবং বাংলার সুবাদ হিসেবে নিয়োগ পান।

এই দুই সুবাদার নিজেদের মেধা, যোগ্যতা, বীরত্ব, সুশাসনের নজির স্থাপন করে আজও বাংলার মানুষের কাছে অমর হয়ে আছেন। ১৬৬০-১৬৮৮ পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর ধারাবাহিকভাবে বাংলা শাসন করেন তারা। তাদের সময়ে সমুদ্রপথে পারস্যের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও ধর্মপ্রচার জোরদারভাবে শুরু হয়।

মীর জুমলা তার মৃত্যুর আগে অসিয়ত করে গিয়েছিলেন, তাকে যেন ইরাকের নাজাফে নিয়ে দাফন করা হয়, যেখানে ইমাম আলির কবরগাহ অবস্থিত।

১৭০০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুবাদার হিসেবে আসেন মাত্র ৩০ বছর বয়সী যুবক মুর্শিদ কুলি খান (মুহাম্মদ হাদী)। হিন্দুস্তানের ডেকান অঞ্চলে জন্মেছিলেন হিন্দুর ঘরে, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি হন হাজী শফী নামের এক পার্সিয়ান ব্যবসায়ীর কাছে। এই ব্যবসায়ী তার গুণের পরিচয় পেয়ে তাকে শিয়া মতবাদে ধর্মান্তরিত করেন। পরবর্তীতে নিজ গুণে তিনি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের (আলমগীর) নজর কাড়তে সক্ষম হন এবং সম্রাট তাকে বাংলার সুবাদার হিসেবে নিয়োগ দেন।

মুর্শিদ কুলি খান নিজেকে বাংলার নবাব পরিচয়ে ভূষিত করেন এবং বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। ১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর পর বাংলার নবাব হন তার জামাতা সুজাউদ্দীন মুহাম্মদ খান। ১২ বছরের শাসনামলে তিনি শিয়া মতবাদ প্রসারে বেশ ভালো ভূমিকা পালন করেন। তিনি বিদ্বান ও ধার্মিক (শিয়া) নবাব হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন।

১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর পর নবাব হন তার ছেলে সরফরাজ খান। কিন্তু মাত্র এক বছরের মাথায় তার সেনাপতি আলিবর্দী খান তাকে হত্যা করে নিজেকে বাংলার নবাব ঘোষণা করেন। আলিবর্দী খান শিয়া ছিলেন। ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মারা গেলে তার ছোট মেয়ে আমিনা বেগমের ছেলে অর্থাৎ তার দৌহিত্র মির্জা মুহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলা বাংলার নবাব হন।

সিরাজউদ্দৌলা যখন নবাব হন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৩-২৪। এই বয়সেই এই লোক তিন তিনটে বিয়ে করে ফেলেছিলেন। তার বেগমরা হলেন: জেবুন্নেসা বেগম, লুৎফুন্নেসা বেগম, উমদাদুন্নেসা বেগম। এদের মধ্যে লুৎফুন্নেসার ব্যাপারে বলা হয়, তিনি ছিলেন তার নানীর হিন্দু পারিচারিকা। সিরাজ তার রূপ-লাবণ্য দেখে মুগ্ধ হন এবং নানীর কাছে আবদার করেন তাকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে। নাতীর আবদারে নানী পারিচারিকাকে সিরাজের হাতে তুলে দেন। সিরাজ তাকে শিয়া ধর্মমতে ধর্মান্তরিত করে তার নাম রাখেন লুৎফুন্নেসা।

সিরাজ ১৭৫৬ সালে নবাব হওয়ার এক বছর পর ১৭৫৭ সালে সংঘটিত হয় পলাশীর যুদ্ধ। বাংলা চলে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। কিন্তু শিয়া লিগ্যাসি বিগত দেড় শ বছরে বেশ ভালোভাবেই স্থান করে নেয় বাংলা অঞ্চলে। নবাবী শাসন শেষ হওয়ার পরও ঢাকা-মুর্শিদাবাদে স্থিতি লাভ করেন অনেক শিয়া প্রভাবশালী শিয়া পরিবার। তবে তার চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, ধর্ম, সুফিজম, লোক-সাহিত্য, পুঁথিসাহিত্য এবং জনমানুষের নিত্যদিনকার বিশ্বাস ও প্রথার মধ্যে জায়গা করে নেয় শিয়া ধর্মের অনেক আচার ও বিশ্বাস।

 

তিন

যা হোক, আমরা শুরু করেছিলাম বাঙালি মুসলমানের নামের পদবী দিয়ে। সেখান থেকে নানা ইতিহাস ঘেঁটে চলে এসেছি ফলাফলের কাছাকাছি। তো, আমাদের সামনে এখন যেটা প্রশ্ন—আলী, হোসাইন, হোসেন, হাসান—এই নামগুলো বাঙালির নামের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হয়ে গেল?

তার আগে একটা কথা পরিষ্কার করে নেয়া ভালো। আলী, হোসাইন, হোসেন, হাসান—এ সকল নাম কিন্তু মোটেও শিয়া ধর্মীয় কোনো নিশানা নয়। বাঙালিরা এ নামগুলো নিজেদের নামের সঙ্গে যুক্ত করে আহলে বাইতের প্রতি তাদের ভালোবাসার খাতিরে। তাছাড়া, এ নামগুলো এতটাই কমন হয়ে গেছে, বাঙালিরা হয়তো শিশুর নামকরণের সময় চলতি প্রথা হিসেবে নামগুলো যুক্ত করে, তারা এগুলোর ধর্মীয় বিশেষত্ব সম্পর্কে থোড়াই ওয়াকিবহাল! তেমনি এ নামগুলোর সঙ্গে ইসলামের কোনো ধর্মীয় বিরোধ নেই এবং এই রচনার উদ্দেশ্যও ওরকম কিছু নয়। আমরা শুধু জানতে চেষ্টা করছি, কীভাবে নামগুলো আমাদের বাঙালি সমাজে প্রচলিত হলো।

মজার ব্যাপার হলো, পারস্য বা ইরাকের শিয়ারা কিন্তু এত অধিক হারে নিজেদের নামের সঙ্গে আলী, হোসাইন/হোসেন, হাসান ইত্যাদি পদবী ব্যবহার করেন না। সুতরাং এই নামগুলো যুক্ত করা শিয়াদের ধর্মীয় কোনো প্রবণতা বা শিআরও নয়। তাহলে নামগুলো বাংলা অঞ্চলে কীভাবে প্রসারিত হলো?

আমার যেটা ধারণা, এর পেছনে অলক্ষ্যে কাজ করেছে বাংলার পুঁথিসাহিত্য, লোকসাহিত্য, পালাগান, জারিগান, লোকায়ত মিথ এবং বাঙালির আবেগী ধর্মবিশ্বাস। বিগত তিন-চার শ বছরে এ অঞ্চলে শিয়াদের আগমনের সঙ্গে এসেছে ইমাম আলী, মা ফাতেমা, হাসানের বিষপ্রয়োগ শাহাদাত, হোসাইনের শাহাদাত, কর্তিত মস্তক, কারবালা, হোসাইনের নিঃসঙ্গ ঘোড়া, বিবি সখিনা, নরাধম এজিদ, ফুরাত নদীর কান্না ইত্যাদি মর্মন্তুদ ঘটনার কান্নাজর্জর বর্ণনা। এসব ঘটনা এখানে এসে অনূদিত হয়েছে বাংলা পুঁথিতে, বাজারের জারিগানে, পার্বণের পালাগানে, উঠানের সান্ধ্য আড্ডায়। ধর্মীয় পুঁথিগুলোর দিকে লক্ষ করলে স্পষ্ট দেখতে পাবেন, অধিকাংশ পুঁথি রচিত হয়েছে কারবালা, ইমাম আলী, হাসান-হোসাইন, মা ফাতেমার দাওয়াত ইত্যাদি বিষয়ে।

এই করুণ কাহিনিগুলো বিগত তিন-চার শ বছর ধরে বাঙালি মুসলিম সমাজকে বিপুলভাবে আলোড়িত করেছে এবং বিশ্বাসগতভাবে প্রভাবিত করেছে। বাঙালি মুসলিমদের কাছে শিয়া-সুন্নি তেমন কোনো বড় ফ্যাক্ট ছিল না, নবীজির নাতীকে কারবালা প্রান্তরে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়েছে, এটাই তাদের কাছে বড় বিষয়। পুঁথি আর জারিগানের সুর তাদের হৃদয়কে করেছে আপ্লুত, কান্নায় তারা হয়েছে জারে জার। ফলে নবীজির নাতীদের প্রতি তাদের যে ভালোবাসা, যে সহমর্মিতা—সেটা প্রকাশ পেতে শুরু করে তাদের সন্তানদের নামকরণের বেলায়। যে হাসান-হোসাইনকে এজিদ-শিমার গং নির্বংশ করে দেয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছিল, দেখ তোরা, তাদের নাম আমরা কখনো হারিয়ে যেতে দেব না। নবীর কলিজার টুকরার স্মৃতি রয়ে যাবে আমাদের উত্তরসূরিদের নামে নামে। সম্ভবত এমনই সহমর্মিতা ও ভালোবাসা থেকে আলী, ফাতেমা, হাসান, হোসাইন ইত্যাদি পুণ্যময় নাম বাঙালি সমাজে এত বহুলভাবে প্রসারিত হয়েছে।

আরও নানা কারণ থাকতে পারে, তবে আমি মনে করি, পুঁথি ও লোকসাহিত্যই এর প্রধান অনুঘটক। সুতরাং আপনাকে বুঝতে হবে সাহিত্যের শক্তি কত প্রবল। পুঁথি হয়তো আপনার কাছে সামান্য ছন্দোবদ্ধ কবিতা ছাড়া তেমন কিছু নয়, কিন্তু এই সাহিত্য দিয়ে একটি জাতির নামকরণের ইতিহাস বদলে ফেলা যায়। এটাই হলো সাহিত্যের শক্তি। সাহিত্য নিভৃতে পরিবর্তন করে সমাজের বহমান ধারা।

 

পরিশিষ্ট

আপনারা জানেন কি-না, বালাদেশের পীর-মুরিদির মধ্যে প্রবলভাবে শিয়া প্রভাব লক্ষণীয়। বিশেষত কওমি ধারার পীরদের বাইরে প্রায় সকল পীরের কাছে আইলে বাইত, ইমাম আলি, মা ফাতেমা, ইমাম হোসাইন, ইমাম হাসান, কারবালা, এজিদ এ জাতীয় বিশ্বাস ‘তাদের’ ইসলামের অন্যতম অংশ। তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিই হলো কারবালার ঘটনা ও তার পারিপার্শ্বিক ঘটনার ওপর ঈমান আনা। বিশ্বাস না হলে আপনি যে কোনো পীরের মাজারে গিয়ে দেখুন। সেখানকার মাজার থেকে শুরু করে প্রতিটি অবকাঠামো, আচার, প্রথা, প্রার্থনা, সংগীত অনেক কিছু শিয়া বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভির সংস্কার আন্দোলনে প্রভাবিত হয়ে হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর, মুনশী মুহাম্মদ মেহেরুল্লাহসহ গত দুই শতাব্দীতে যেসব ধর্মীয় সংস্কারকের উদ্ভব ঘটেছে বাংলায়, তাদের বড় একটা প্রচেষ্টা ছিল সমাজ থেকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির পাশাপাশি এই শিয়া-প্রভাবের মূলোৎপাটন করা।

 

প্রকাশিতব্য ‘আবার তোরা দরবেশ হ’ গ্রন্থ থেকে