… ইসলামাবাদী হুজুরের চোখ ছলছল করে উঠে। ‘উনি মানুষ ছিলেন না, জাদুকর ছিলেন।’ বলতে বলতে কাঁধের লাল রুমালটা দিয়ে চোখ মুছেন। হুজুর বেশ আবেগী হয়ে গেছে দেখে আমি তাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিংয়ের চেষ্টা করলাম।

‘আপনি শফি সাবের এত পুরোনো ছাত্র, তাঁর খলিফা, কাছের মানুষ কিন্তু হজরতের মৃত্যুর ব্যাপারে আপনি কোনো কথাই বলছেন না; অথবা মৃত্যুর দিন কী ঘটেছিল হাটহাজারী সে ব্যাপারও চেপে যাচ্ছেন।

হুজুর চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘যা ঘটেছে সেটা তো দুঃখজনক ঘটনা। কওমি মাদরাসার ঐতিহ্যের সঙ্গে এগুলো যায় না। আমি তো সেখানে ছিলাম না, জানতে পারিনি কিছু। হুজুরের জানাজায় গিয়েছিলাম, জানাজা শেষে আবার ফিরে এসেছি।’

হুজুর একটু থামেন। স্মৃতি হাতড়ে বের করেন আনেন যোগ্য ঘটনাটা। ‘২০১৩ সালের ৫ মে’র ঘটনার পরপরই আমি হাটহাজারীতে হুজুরের সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলাম। হুজুর তখন শুধু কাঁদতেন। কাঁদতে কাঁদতে সেদিন বলেছিলেন, “১৭৫৭ সালে এবং ১৮৫৭ সালে আলেমদের যে ব্যর্থ বিপ্লব হয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে আলেমদের ওপর যে জুলুম নির্যাতনের স্টিম রুলার চলেছিল, আমি চাই না আমার কারণে সে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হোক।”

‘হাটহাজারী মাদরাসায় তখন সার্বক্ষণিক পুলিশ পাহারা থাকত। প্রশাসন আর দলীয় লোকজন এসে হুমকি-ধমকি দিয়ে যেত। ছাত্র-শিক্ষকরা নানা প্রকার হয়রানির শিকার হচ্ছিল। যেসব কর্মী ৫ মে রাতে শহীদ হয়েছিল তাদের মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনরা এসে হুজুরের সামনে বসে কাঁদত। আহত বা গ্রেফতার হয়েছিল যারা, তাদের পরিবারের লোকজন হুজুরের রুমের সামনে এসে বসে থাকত, তাদের চিকিৎসা আর মুক্তির জন্য যদি কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়।’

ইসলামাবাদী বলে চলেন, ‘হুজুর সেদিন আমাকে বলেছিলেন, “আবদুর রহীম, আমি ঘুমাতে পারি না। ঘুমালেই স্বপ্নে শুধু লাশ দেখি।”

‘ওই সময় সরকারের সঙ্গে আপোস না করে হুজুরের আর কোনো উপায় ছিল না। গ্রেফতার, আত্মগোপন, পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো হাজার হাজার আন্দোলনকারীর জীবন বাঁচাতে তিনি নিজের জীবনের সকল অর্জন বাজি ধরেছিলেন। যে আহমদ শফি জীবনে কোনোদিন রাজনীতির চৌকাঠ মাড়াননি তিনি উম্মতের স্বার্থে তার নব্বুই বছরের আপোসহীন মানসিকতা বিসর্জন দিয়েছিলেন।

‘কী করতে পারতেন তিনি? তার প্রধান সিপাহসালার, একান্ত অনুগত সহকর্মী আল্লামা বাবুনগরীসহ সমস্ত নেতাই তখন হয় বন্দী নয়তো ফেরার হয়ে লুকিয়ে আছেন। ওই কঠিন মুহূর্তেও নব্বুই বছর বয়সী আহমদ শফি ভেঙে পড়েননি। সবাইকে নিরাপদ রাখতে তিনি সময়ের সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন। প্রশাসনের উচ্চপদস্থ লোকজন সকাল-বিকাল তার রুমে এসে বসে থাকত। কে ছিল তখন তাঁর পাশে? কেউ না। আজকে যারা বড় বড় কথা বলে, যারা আহমদ শফিকে সরকারের দোসর বলে তাঁর নিন্দা করে, তাদের কেউ কি তখন একবারের জন্য আহমদ শফির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল? একবার তাকে অভয়বাণী শুনিয়েছিল? কেউ আসেনি। আজকের যত বড় নেতা বলেন আর যত বড় আলেম বলেন, নিজেদের জীবন বাঁচাতে কেউ সেদিন তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়নি। ভয়ে তখন কেউ হাটহাজারী আসতেই চাইত না। অথচ কিছুদিন পর যখন পরিস্থিতি অনুকূলে আসে তখন এসব নেতার কারণে হাটহাজারীতে হাঁটাই যেত না। তাদের চোটপাটে মনে হতো, তারাই হাটহাজারীর মা-বাপ। হাটহাজারী মাদরাসার অল্প কয়েকজন শিক্ষক কেবল তাঁর পাশে ছিলেন। তিনি তাদের নিয়ে পরামর্শ করেই সরকারের সঙ্গে নেগোসিয়েশনে রাজি হন। নইলে আজকেও হয়তো অনেক নামধারী নেতাকে জেলখানায় জীবন কাটাতে হতো।’

‘যাদের মুক্তির জন্য হুজুর সরকারের সঙ্গে আপোসরফা করেছিলেন তাদের অধিকাংশই পরবর্তীতে হুজুরের নেতৃত্বের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন এবং নানা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচার করেছে।’ মাঝখান থেকে জুড়ে দিলাম আমি।

হুজুর বললেন, ‘দেশের সেক্যুলার-নাস্তিক, বেদআতিরা তো হুজুরের বিরেুদ্ধে ছিলই, উগ্রপন্থী কিছু গ্রুপও হুজুরের বিরুদ্ধে ছিল। সরকারের সঙ্গে আলেমদের সদ্ভাব হোক—এটা সেক্যুলারদের যেমন সহ্য হতো না তেমনি মাদরাসাকেন্দ্রিক একটা অংশও এটা পছন্দ করত না। বলা যায় চতুর্মুখী বিরোধিতার শিকার ছিলেন তিনি।’

রাত আটটা প্রায় বেজে গেছে। হুজুরের কথা কিছুতেই শেষ হয় না। আমাদের উঠি উঠি ভাব দেখলেই আরেক আলোচনার থলে খুলে দেন।

‘নব্বুইয়ের বেশি বয়স হয়েছিল, তবু প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে বুখারির দরস দিতেন একটানা। দেওবন্দে যখন হোসাইন আহমদ মাদানি রহ.-এর বুখারির দরসে বসতেন, তার সারা বছরে একদিনও গরহাজিরা ছিল না। দরসের প্রথম সারিতে বসার জন্য সকালে নাস্তা না করে কিতাব নিয়ে প্রথম বেঞ্চে গিয়ে বসে থাকতেন। আশ্চর্য এক মানুষ ছিলেন। তাঁর জীবনে কলমের কালি দিয়ে খোঁচা দেওয়ার মতো কোনো স্থান ছিল না। এমনই নিষ্কলঙ্ক ছিল তাঁর জীবন।

‘এই হাটহাজারীর মানুষজন তাঁকে নিজেদের সেরেতাজ করে রেখেছিল। ধনী-গরিব, যুবক-বৃদ্ধ সবাই তাঁর দোয়ার কাঙাল ছিল। জানাজানার দিনের একটা ঘটনা মনে পড়ল। শোনা ঘটনা, কতটুকু সত্য জানি না। এক হিন্দুলোক এসেছে হুজুরকে শেষবারের মতো দেখতে। মাদরাসার আশপাশে বেশকিছু হিন্দু বসতি আছে। তো, ওই লোক এসে হুজুরকে একনজর দেখার খুব চেষ্টা করছিল। এর ওর কাছে জিজ্ঞেস করছিল কীভাবে হুজুরকে শেষবারের মতো দেখা যায়। কিন্তু এত ভীড়ের মধ্যে কীভাবে দেখা সম্ভব? একসময় হিন্দুলোকটি তার পাশের এক মাদরাসাছাত্রকে বলতে লাগল, হুজুরের অন্তিম চেহারা দেখেছে এমন একজনকে দেখান, আমি অন্তত তার মুখটা দেখতাম।’

ইসলামাবাদীর গলা বুজে আসে। আমাদের চোখের ভেতরেও টের পাই নোনাজলের ঢেউয়ের শব্দ। গাল বেয়ে নেমে আসে অশ্রুর বেদনাবিদ্ধ জলের ধারা। রাতের দমকা বাতাস স্থানুর মতো থেমে থাকে জানে আলমের মনোহরী পাইকারি দোকানের ভেতর।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াই। হুজুর হা-পিত্যেশ করেন দুটো ডাল-ভাতের। আমরা কড়জোর করি, আরেকদিন, অন্য কোনোদিন। হুজুর আমাদের কাঁধে হাত রেখে এগিয়ে দেন। রিকশা ডেকে তুলে দেন। আর বলেন, ‘খুব ভালো লাগল আপনারা এসেছেন বলে।’

আমি মনে মনে বলি, আপনি কোনোদিন জানতেও পারবেন না, আপনার অজান্তে কী অমূল্য রতন আমি নিয়ে গেলাম আপনার সান্নিধ্য থেকে।

রিকশায় বসে নাজিরহাট বাসস্ট্যান্ডে আসতে আসতে এহসানকে বললাম, ’যদি কখনো আল্লাহওয়ালার সন্ধান পাইতে চাও তবে প্রথমেই দেখবা কাঙ্ক্ষিত লোকের ভেতরে লৌকিকতা আছে কি-না। একজন আল্লাহওয়ালার ভেতরে কখনো লৌকিকতা, তাকাল্লুফি, লোকদেখানো ব্যাপার স্যাপার থাকবে না। তিনি হবেন শিশুর মতো সরল। জাইনা রাখো, এইমাত্র তুমি একজন আল্লাহওয়ালার সঙ্গে সাক্ষাত কইরা আসলা।’