লালবাগ মাদরাসার শাইখুল হাদিস মাওলানা হাবীবুর রহমান রহ. (হাজী সাহেব হুজুর) গতকাল ইন্তেকাল করেছেন। উমরা সফরের জন্য এয়ারপোরের্টের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। আল্লাহর ঘরের মেহমান হওয়ার আগে আল্লাহ নিজেই তাঁকে ডেকে নিলেন আপন সান্নিধ্যে। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউসে সমাসীন করুন!

হাজী সাহেব হুজুর অত্যন্ত নরমদিল মানুষ ছিলেন। আমার মুহতারাম উস্তাদ ছিলেন তিনি। মিশকাত জামাতে তাফসিরে বায়জাভি পড়াতেন। দাওরা জামাতে পড়াতেন তরিমিজি শরিফ। ছোটখাটো মানুষটা দরসে আসতেন সাদসিধেভাবে। তাঁর চলন-বলন, কথা-কাজে কখনো ‘বহুত বড় আলেম’ টাইপের প্রভাব ছিল না। তিনি বড় একটা ওয়াজ-মাহফিলে যেতেন না। নাম কামানোর সস্তা প্রবণতা থেকে নিজেকে হামেশা পরহেজ করে চলতেন।

মুফতী আমিনী (রহ.) সময়কালীন লালবাগ মাদরাসা মানেই রাজনীতি, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। সবাই হয়তো মনে করতো, লালবাগ মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা নিশ্চয় সবসময় রাজনীতির ডামাডোলে সময় কাটায়। মোটেও এমন কোনো প্রবণতা ছিল না। মুফতী আমিনীর (রহ.) সময়কালে তিনি কেবল একাই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যতিব্যস্ত থাকতেন। তাঁর সঙ্গে মাদরাসার তিন-চারজন শিক্ষক ছিলেন যারা সবসময় সঙ্গ দিতেন। এছাড়া বাদবাকি আর কোনো শিক্ষকই প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতেন না। তাদের কাজ ছিল কেবলই দরস-তাদরিস। হাজী সাহেব হুজুর, আবদুল হাই সাব হুজুর, মুহিব্বুল্লাহ সাব হুজুর, বাবা হুজুর, রহিম সাব হুজুর, মাকসুদ সাব হুজুর এরা কখনোই রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতেন না। পড়া ও পড়ানো ছাড়া তাদের জীবনের আর কোনো মাকসাদই ছিল না। আমিনী (রহ.) রাজনীতি আর তাদরিস সম্পূর্ণ আলাদা করে রেখেছিলেন। হাজী সাহেব ছিলেন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

হাজী সাহেব হুজুরের ছেলে ইসমাঈল ভাই পড়তেন আমাদের সঙ্গে একই জামাতে। তিনি যেন তাঁর বাবার চেয়েও সাদাসিধে ছিলেন। কথা বলতেন খুব কম, কিন্তু কথা শুনতেন খুব মনোযোগ দিয়ে। জরুরি কথা ছাড়া ফুজুল কোনো কথাবার্তা কখনো বলতেন না। লালবাগে দুই বছরের শিক্ষাকালীন তাঁকে কখনো রাগ করতে দেখিনি। রাগ তো দূরের কথা, তাঁকে কখনো হাসিমুখ ছাড়া কথা বলতেই দেখিনি। তিনি যেন তাঁর বাবার প্রকৃষ্ট প্রতিচ্ছবি ছিলেন।

তামীম রায়হান ভাইয়ের সঙ্গে ইসমাঈল ভাইয়ের সখ্যতা ছিল। অবশ্য দুজন ছিলেন একেবারে দুই মেরুর মানুষ। তামীম ভাই সদা চঞ্চল, এই এখানে তো একটু পর ওখানে। কখনো কখনো ধুম করে উধাও হয়ে যাচ্ছেন। আর ইসমাঈল ভাই সম্পূর্ণ উল্টো। ধীর-স্থির, মাপা মাপা কথা, কুতুববিনিতে মশগুল। ক্লাসে কেউ হল্লা করলে তিনি ভারী ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে একনজর দেখে আবার কিতাবের নুসখায় মন দিতেন। একজন বুজুর্গ বলতে যা বুঝায়, ইসমাঈল ভাই ছিলেন সত্যিকারের বুজুর্গ মানুষ। সত্যি বলছি, ইসমাঈল ভাইয়ের সিরাত-সুরতই এমন ছিল, তাকে দেখলে আমাদের মন ভালো হয়ে যেত।

হাজী সাহেব হুজুরকে দেখে আমরা ভাবতাম, এমন বাবা যিনি, তাঁর ঔরসেই তো ইসমাঈল ভাইয়ের মতো নেকদিল, এমন সফেদ হৃদয়ের মানুষের জন্ম হয়।

আল্লাহুম্মা আনিস ওয়াহশাতি ফি ক্ববরি, আল্লাহুম্মারহামনি বিল ক্বুরআনিল আজিম…