১৪ অক্টোবর ২০২০। বুধবার। রাত ৩.২৮। রুম ৭০৬। হোটেল আল-ইমাম, আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম।

 

রাত তিনটা আটাশে লিখতে বসলাম। গত পরশু চট্টগ্রাম এসেছি। সঙ্গে এহসান সিরাজ।

পরশু (১২ অক্টোবর) সকাল সাড়ে সাতটায় ঢাকা থেকে সিল্কলাইন পরিবহনে করে চট্টগ্রাম ভাটিয়ারী এসে পৌঁছাই বেলা সাড়ে এগারোটা-বারোটার দিকে। বেশ তাড়াতাড়িই এসেছি, ঘণ্টা চারেকের চেয়ে কিছু বেশি লেগেছে সময়। গাড়িটা মন্দ নয়, এসি গাড়ি হওয়ায় জার্নির ধকলটা বুঝা যাচ্ছে না। দুদিন ধরে হালকা ঠাণ্ডা-সর্দির প্রকোপ টের পাচ্ছি, এসির শীতাতপ পরিবেশ মাথাটা ভারী করেছে আরও। ভাটিয়ারী নেমে তাই এদিক ওদিক হাঁটতে লাগলাম, তাতে যদি মাথার দায়ভার কিছুটা কমানো যায়।

দুজনেরই হিসু চেপেছে, আশপাশে কোনো মসজিদ দেখছি না। একজনকে জিজ্ঞাসিলে সে বলল, ওই সামনে হাতের বাঁয়ে। সামনে এগুতে গিয়ে দেখি রাস্তার পাশে বিক্রি হচ্ছে ইয়া বড় এক পাঙ্গাস। আট-দশ কেজির কম হবে না। ওটার পিঠের একটা বড় টুকরো পোড়া পোড়া করে ভেজে গরম ভাত দিয়ে খেতে পারলে বড় সোয়াদ হতো। এহসানকে বললাম ব্যাপারটা। সে-ও পাঙ্গাসের ফরসা পেটির দিকে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে বলল, সহমত ভাই!

মসজিদ পাওয়া গেল, কিন্তু সেটার সদর গেট তালাবদ্ধ। মেজাজটা কেমন লাগে এখন! এই হলো সভ্যতার এক অভিশাপ। লাখ লাখ টাকা খরচ করে মসজিদে হরেক রকম বিলাসী জিনিসপত্তর লাগিয়েছি আমরা, ফলে মসজিদ হয়ে উঠেছে দূর্গের মতো দুর্ভেদ্য। সেগুলোকে এখন তালাবদ্ধ করে পাহারাদার বসিয়ে পাহারা দিয়ে রাখতে হয়। মসজিদ যেন এখন আর আমজনতার ফরিয়াদের কেন্দ্র নয়, গভীর রাতে ইবাদতগুজার বান্দার রোনাজারির আশ্রয় নয়। মসজিদ রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকবে। প্রভুর দরবারে ফরিয়াদী লোকজন এখানে এসে মাথা কুঁটে পড়ে থাকবে, আসবে দুনিয়াবী ফরিয়াদীও। মসজিদ কেন দূর্গ হবে?

এহসানের আর কুলোচ্ছে না। মসজিদের পাশে রাস্তা থেকে একটু আবডালে বসে ছেড়ে দিল। প্রায় শেষ পর্যায়ে যখন, এক লোক রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আমাকে বলল, সামনে কবরস্তান, উনাকে বলেন। উনাকে বলেই বা আর কী লাভ এখন, খেলার এই মুহূর্তে তো আর দিক বদল করা সম্ভব না।

জলনির্গমনের অপর্যাপ্ত ব্যবস্থার দরুন আমি আর ওমুখো হলাম না, প্রাকৃতিক পরিবেশে পথে কোথাও হালকা হয়ে নিব। সেমতে একটা সিএনজি ঠিক করে হাটহাজারীর উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলাম।

ভাটিয়ারী বাজার পেরোতেই রাস্তার দুই পাশে সুন্দর সবুজ, আলুথালু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মায়াবী পাহাড়। আরেকটু সামনে এগুলে হাতের বামপাশে দেখি পাহাড়ের পৈথানে নীলাভ জলের লেক। অবিশ্বাস্য সুন্দর। সিএনজি থামিয়ে নেমে পড়লাম। এত টলটলে জল, ইচ্ছে করে ঝাঁপ দিয়ে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে আসি। পাহাড় আর লেকের নয়নাভিরাম দৃশ্য বুকের মধ্যে হু হু করে বেজে উঠল-রাবুকে যদি সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারতাম!

মেয়েদের ঘোরাঘুরির খুব শখ। বিশেষ করে গৃহপালিত বউদের। দিনের পর দিন বাড়ির চৌহদ্দির একঘেয়েমি দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে উঠে। উন্মনা প্রকৃতির মাঝে মুক্ত পায়ে হাঁটার বড় সাধ থাকে তাদের। মেসেঞ্জারে কল দিলাম। লেক আর পাহাড় দেখালাম। ও কী কী জানি বলল, বাতাসের কারণে ভালো শুনতে পেলাম না। লাইন কেটে গেল। হয়তো চুলায় রান্না চড়িয়ে এসেছে, কাজের তাড়া।

আবার সিএনজি চলতে শুরু করল। ডানপাশে ক্যান্টনমেন্ট। আমার শশুরআব্বা এ ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত, সিনিয়র সার্জেন্ট অফিসার। তাঁকে ফোন দিলাম। আমি চট্টগ্রাম এসেছি সেটা জানেন, এ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি শুনে আফসোস করলেন। করোনার সতর্কতার দরুণ ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরীণ রেজিমেন্টের কাউকে বাইরে আসতে দেয় না, আবার বাইরের কাউকে ভেতরে নেয়াও যাবে না। দেখা করতে পারলেন না বলে মন খারাপ হলো।

ক্যান্টমেন্ট দেখা যাচ্ছিল রাস্তা থেকেই। রাস্তায় অনেকগুলো এমপি (মিলিটারি ‍পুলিশ) চেকপোস্ট। প্রায় ত্রিশ বছর আগে আমি ছিলাম এখানে। আমার আব্বাও সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। এই চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে কাটিয়েছেন দশ-বারো বছর। তখন আমি ছোট, দুধের বয়স। সে সময় আব্বা-আম্মার সঙ্গে সেনা কোয়াটারে ছিলাম বছর দুয়েক। বছর দুয়েক বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম মায়ের সঙ্গে, দু’বছর পর আবার এসেছিলাম এই চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টেই। তখন আমার বয়স পাঁচ-ছয়। আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় এখানে। নতুন একটা স্কুল হয়েছিল ৩ নম্বরের কাছে, আমার বড় দুই বোন আর আমি পড়তাম সেখানে।

ক্যান্টনমেন্টে কাটানো সেই শৈশবের দিনগুলোতে আমার সবচেয়ে এক্সাইটিং স্মৃতি আছে শুধু পাহাড়ের। বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিদিন পাহাড়ে যেতাম। নানা কারগুজারি হতো। এ কারণেই কি-না, সাগর বা নদী নয়, অরণ্য বা অট্টালিকা নয়, আমাকে অদম্য আহ্বানে কাছে টানতে পারে কেবল পাহাড়। পাহাড়ের প্রতি আমার অমোঘ আকর্ষণ। শৈশবের স্মৃতি বড় মারাত্মক চিজ। একটা মানুষের পরবর্তী জীবনের অনেক সিদ্ধান্ত তৈরি হয় শৈশবের স্মৃতি থেকে। তার জীবনাচার, সাফল্য-ব্যর্থতার অনেক চাবিকাঠিও লুকিয়ে থাকে এই শৈশবের হাতে। তাই শিশুর শৈশব বড় মূল্যবান। তার শৈশবকে নষ্ট করা মানে তার ভবিষ্যত জীবনকে ব্যর্থ করে দেয়া। পারিবারিক বিবাদ, কলহ, ঝগড়া – এগুলো থেকে শিশুকে সবসময় দূরে রাখতে হবে। তাকে আনন্দে বাঁচতে দিন, প্রকৃতির সৌন্দর্যে বড় করে তুলুন, ক্ষুদ্রতা থেকে বের করে অপার পৃথিবীর পাঠশালায় তার শিক্ষার ব্যবস্থা করুন।

ভাটিয়ারী থেকে হাটহাজারী রাস্তার বেশির ভাগটা পাহাড়ের পাশ দিয়ে গেছে। রাস্তার পাশে নতুন অনেক স্থাপনা হচ্ছে, পার্ক বা বিনোদনকেন্দ্র টাইপের কিছু হবে। কিন্তু এর কোনো কিছুর মধ্যে আমি আমার সেই দুরন্ত শৈশব খুঁজে পেলাম না। না পাওয়ারই কথা, ত্রিশ বছর তো কম সময় নয়। ত্রিশ বছর পর এসে সেই হলুদ রঙের পাঁচতলা কোয়াটার, রাজহাঁস ভেসে বেড়ানো পুকুর, ফায়ারিং রেঞ্জ খোঁজা বোকামি বৈ কিছু নয়।