আপনারা যারা লেখালেখি করেন, করতে চান বা লেখালেখির প্রতি প্রবল আগ্রহ আছে; যারা তাদের গদ্যকে সুন্দর, প্রাঞ্জল ও সুষমামণ্ডিত করতে চান, তাদের জন্য একটা সদুপদেশ দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। উপদেশ দেয়ার সুতীব্র ইচ্ছা মানবমনের স্বাভাবিক প্রবণতা। আর বাঙালি হিসেবে এই প্রবণতা আমাদের আরও উত্তুঙ্গ। সুতরাং উপদেশ শোনেন।

গদ্য সুন্দর করার একটা অন্যতম মাধ্যম হলো কবিতা। প্রথিতযশা কবিদের কবিতা পড়ুন, কবিতা শুনুন, কবিতা আবৃত্তি করুন। কবিতা পড়া যেমন জরুরি, তেমনি কবিতা শোনাও খুব জরুরি। কৈশোরকালে আমি প্রচুর কবিতা শুনেছি। শিমুল মুস্তফার একগাদা ক্যাসেট ছিল আমার কাছে। টেপ রেকর্ডারে বাজিয়ে বাজিয়ে প্রায়ই শুনতাম। বাংলা কবিতার অনেক বিখ্যাত কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় শিমুল মুস্তফার মাধ্যমে। শিমুল মুস্তফার আবৃত্তি শুনতে শুনতে অনেক কবিতা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল:
হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোরে মন বাড়িয়ে ছুঁই
দুইকে আমি এক করি না এককে করি দুই
হেমের মাঝে শুই না যবে, প্রেমের মাঝে শুই
তুই কেমন করে যাবি
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়ায় আমাকে তুই পাবি
(নির্মলেন্দু গুণ)
…এমন আরও অনেক কবিতা।
কবিতার সুন্দর সুন্দর পঙক্তি নকল করার চেষ্টাও করতে পারেন। আপনার লেখার মধ্যে কবিতার পঙক্তি নকল করে নিজের মতো করে প্রকাশ করুন। কারো পঙক্তি বা কবিতার লাইন নকল করে লেখা দোষের কিছু নয়। পৃথিবীর অধিকাংশ লেখক-কবি পূর্ববর্তী কোনো না কোনো লেখকের লেখা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। প্রত্যেকের লেখায় তার অগ্রজ বা প্রিয় কোনো লেখকের ছাপ থাকে। নকল করা দোষের কিছু নয়। নকল করতে করতে আপনি নিজের আলাদা পরিচয় তৈরি করতে পারবেন।
যখন আমি নতুন নতুন গ্রাফিক্স ডিজাইন শিখি তখন আমার উস্তাদ বলতেন, নকল করেন। ভালো ভালো ডিজাইন সূক্ষ্মভাবে নকল করতে শিখেন। নকলে আপনে যত নিখুঁত হবেন, ভবিষ্যতে তত বেশি ক্রিয়েটিভ হবেন। নামী ডিজাইনারদের কাজগুলো নকল করতে করতে দেখবেন, একসময় আপনেও ভালো ডিজাইনার হয়ে গেছেন। দুঃখই বলতে হবে, আমি ভালো ডিজাইনার হইতে পারি নাই।
এ কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে কবিতা সাহিত্যের সবচেয়ে উঁচু তবকার শিল্পকর্ম। কবিতায় ব্যবহৃত শব্দাবলি, শব্দ ব্যবহারের মুন্সিয়ানা, বাক্যের অভিনব গঠন, ছন্দের জাদুময়তা—এসব গদ্যের জন্য দারুণ উপকারী। শিল্পসম্মত অনেক অনেক শব্দ শুধু জানলেই হয় না, সেগুলো ব্যবহারের সুন্দরতম জ্ঞান থাকাও জরুরি। যেখানে সেখানে যে কোনো কঠিন বা শব্দ ব্যবহার করলেই সেটা উচ্চাঙ্গের সাহিত্য হয়ে যায় না। শব্দ ব্যবহারের সঠিক জ্ঞান থাকা জরুরি। এই জ্ঞানটা পাওয়া যায় কবিতায়।
অনেক গদ্যকারকে দেখি, তারা কঠিন ও অপ্রচলিত অনেক শব্দকে জোর করে তাদের গদ্যে সেঁধিয়ে দেন। শব্দটা বাক্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল হচ্ছে কি-না, বাক্য-পাঠে সাবলীলতা থাকছে কি-না, পাঠকের কাছে শব্দটা আন-ইজি লাগছে কি-না, গদ্য-পাঠে বিরক্তি উৎপাদন করছে কি-না; এসব না বুঝে শুধু শব্দের বাহাদুরি আপনার গদ্যকে শক্তিশালী ও সাবলীল করবে না, বরং পাঠককে বিরক্ত ও ক্লান্ত করবে। পাঠক আপনার গদ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
এজন্য কবিতার কাছে আসুন। দেখুন কবিরা কত সুন্দরতম পন্থায় শব্দকে তাদের পঙক্তিতে জায়গা করে দিচ্ছেন। ভাব ও ছন্দের মিশেলে তারা সাধারণ একটা কথাকে কত অভিনব পন্থায় প্রকাশ করছে পাঠকের সামনে। কবিতা শুনুন। আবৃত্তি শোনার ফায়দা হলো, আবৃত্তিটা আপনার মাথার মধ্যে দীর্ঘদিন বাস করবে, দীর্ঘ সময় ধরে এটা আপনার লেখাকে প্রভাবিত করবে।
গদ্যকবিতার মধ্যেও এক ধরনের ছন্দ আছে। ওই ছন্দটা ধরতে চেষ্টা করুন। ছন্দটা ধরতে পারলে আপনার গদ্যে সেটা ব্যবহারের চেষ্টা করুন। আপনার গল্পে, উপন্যাসে, স্মৃতিকথায়, সাহিত্যধর্মী লেখায় কবিতার ছন্দ জাদুময়তা ব্যবহার করুন। তবে খেয়াল রাখবেন, প্রবন্ধধর্মী লেখায় কবিতার জাদুময়তা ব্যবহারে বিরত রাখুন। প্রবন্ধের ভাষা একেবারে ভিন্ন, আটপৌড়ে। সে বিষয়ে আরেক দিন আলাপ করব।
সুতরাং কবিতা পড়া ও কবিতা শোনার বহুবিধ ফায়দা আমাদের চোখের সামনে উন্মোচিত হলো।
এবার নিচের আবৃত্তিটা শোনেন। আমার বন্ধু মাহমুদ আযমানী `মৃত্যুঞ্জয়’ নামে আমার এ কবিতাটি আবৃত্তি করেছিল সম্ভবত আজ থেকে ১০ বছর আগে। তখনও আমার কোনো কবিতার বই বের হয়নি। কবিতার বই কি, আমার কোনো বই-ই সম্ভবত বের হয়নি তখন। কিন্তু আমার বন্ধু তখনই বুঝতে পেরেছিল, ভবিষ্যতে আমি ‘বিরাট’ কবি হবো। এই আশায় সে তখনই এ কবিতাটা আবৃত্তি করে রেখেছিল। কী দারুণ দূরদর্শী বন্ধু!
কবিতা: মৃত্যুঞ্জয়
কবি: সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর
আবৃত্তি: মাহমুদ আযমানী
কবিতাপুস্তক: ইয়া আফরোজা ইয়া আফরোজা

কবিতাপুস্তকটি যারা কিনতে চান তাদের জন্য লিংক: https://www.rokomari.com/book/153899/yaa-afroza-yaa-afroza