পায়ের নিচে কাদার সঙ্গে দেবে যায় ঘাস, জলজ উদ্ভিদ, কচুরিপানার ডাঁটা। মচ মচ কচ কচ শব্দ হয় পায়ের তলায়। মনে হয় নাগরিক জীবন পুঁতে যাচ্ছে কাদামাটির গোরস্তানে। অল্প পানি ক্ষেতে, হাঁটলে থই থই করে না, ছলকে যায় শুধু। এবার বর্ষায় পানিই এলো না বিলে, সামান্য বৃষ্টি-বাদলার যা পানি। ফলে বিলে না আছে মাছের দুদ্দার, না আছে শাপলা-শালুকের বাড়ন্তি। তবু এখানে যে জীবনের ডাক শুনি, মর মর করে ভেঙে যাওয়া ঘাসের ডালে মাটি মেশানো গন্ধের যে মাদকতা, এখানে আমার পূর্ণ জীবন বাজি ধরা।

দক্ষিণ বিলে জমিদারির একটা ক্ষেতের আইল নিচু হয়ে গেছে। শুকনো মৌসুমে অধিক লোকের চলাচলে আইলের উপর জুলুম গেছে। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণার আইলটা তাই হয়ে রয়েছে নিচু। যদ্দরুণ ক্ষেতে পানি থাকে না। কিন্তু ভাদ্দইর‌্যা (ভাদ্র) ধান বুনতে হলে ক্ষেতে পানি দিতে হবে। আইল উঁচু না হলে ক্ষেতে তো পানি রাখা দায়। আর যে বড় বড় ঘাস, বুরহান ভাই ক্ষেতে ট্রাক্টর আনতেই ভয় পাচ্ছে।

একটু বেলা করে কোদাল একটা কাঁধে নিয়ে ক্ষেতের দিকে রওনা হই। আব্বা আমার সঙ্গ নিলেন। আমি না না করলাম যদিও, উনি বললেন, একটু দেখায়া না দিলে বুঝবি না। কী তাজ্জব কথা!

কাজ অল্পই ছিল। পনেরো-বিশ মিনিটে ক্ষেত থেকে এক কোদাল করে মাটি নিয়ে আইলে বসিয়ে দিলাম। নরম কাদামাটি, দু-এক দিন থাকলে পুরোনো আইলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবে। আর ঘাস তো আছেই, ঘাসেরা নতুন করে আইলের সীমানা তৈরি করে ফেলবে শিগগির।

কাজ যখন শেষের দিকে, আব্বা পাশের টাখনু-পানির ক্ষেতে দেখেন কয়েকটা শাপলা ফুটে আছে। তিনি শাপলা তুলতে ব্যাপ্ত হলেন। কাজ শেষ করে কোদাল ক্ষেতের আইলে রেখে আমিও নামলাম। অল্প পানি ক্ষেতে, ফলে শাপলার লতা বড় হয় নাই মোটেও। আধা হাত-এক হাত, বড়জোর দেড় হাত, ওগুলোই তুলতে লাগলাম। শাপলা ভাজি আব্বার বড় পছন্দ। আর যদি পান্তাভাত হয়, তাহলে তাকে বেঁধে রাখা দায়। অনেক সময় গরম ভাতে পানি ঢেলে পান্তা বানিয়ে খান।

আমি আর আব্বা – দুজনে শাপলা তুলতে তুলতে ওই ক্ষেতের দক্ষিণ পাশে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, মেরুন ডাঁটা-সবুজ পাতার কলমি শাক লকলকিয়ে পুরো পুবপাশ দখল করে ফেলেছে। শাপলা তোলায় ক্ষান্তি দিয়ে আমি কলমি শাকের ডগা তুলতে লাগলাম। পিতা-পুত্রের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আজ দুপুরের মধ্যাহ্নভোজ হবে শুধু শাকাহার।

এই তো জীবন। মাঝে মাঝে অন্যের জীবনের পিছনে ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে উঠি। ভাবি, কার জন্য জীবন? অন্য মানুষের জন্য? লেখক-পাঠক, যশ-খ্যাতি, লেখকসত্তাকে মহৎ বানিয়ে জাতির সামনে বিরাট বিভূতি নিয়ে উপস্থাপন? পাঠকতুষ্টির জন্য মুখের সামনে আলাদা একটা ‘লেখক-মুখোশ’ পরে থাকা? নিজেকে বিরাট ধর্মাবতার বলে জাহির করার কুৎসিত প্রতিযোগিতা? আমি সবসময় মানুষ হতে চেয়েছি। খুব সাধারণ একটা মানুষ।

কী? জীবন আসলে কী?

আমার কাছে এ-ই জীবন। এক তোড়া শাপলা আর এক গুচ্ছ কলমি শাকের সজীবতার কাছে জীবনের যে মহত্তম সমর্পণ, তার চেয়ে সুখকর প্রার্থনা, সমর্পিত ইবাদত কিছু নেই আর!

No photo description available.