…বাংলাদেশে বিজ্ঞ, যোগ্য, প্রথিতযশা আলেম, পীর, ইসলাম প্রচারকের অভাব নেই। বরং পূর্বের দরবেশদের চেয়ে আমাদের সংখ্যা আনুপাতিক হারে বহু গুণ বেশি। বাংলাদেশের মানুষের মনেও ইসলামপ্রিয়তা পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক। এই দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনীতি করে বহুসংখ্যক রাজনৈতিক দল। খেলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বলে কেউ, পীরেরা খানকা-দরবার বানিয়ে মানুষের আত্মশুদ্ধির নসিহত দিয়ে যাচ্ছেন। মাদরাসাগুলোতে লাখ লাখ ছাত্র-শিক্ষক ধর্মীয় শিক্ষা আদান-প্রদান করছে। তাবলিগ ও অন্যান্য দাওয়াতি মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী চলছে দাওয়াতের কাজ।

কিন্তু সচ্চরিত্রবান মানুষ হওয়ার জন্য আমরা কোথাও যাচ্ছি না। যে চরিত্র একজন দরবেশের এবং যে দরবেশের কথায় মানুষ বিহ্বল হয়ে ইসলামের জন্য প্রাণোৎসর্গে উদ্দীপ্ত হতো, সেই দরবেশি জীবন অর্জনের ব্যাপারে আমরা বেখবর হয়ে আছি।

বুঝতে হবে, ইসলাম রাজ্য জয় করতে আসেনি। দেশে দেশে শাসন প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে ইসলামের সংবিধানের কোথাও শর্তারোপ করা হয়নি। তেমনি খেলাফত প্রতিষ্ঠাও ইসলামের মূলমন্ত্র নয়। ইসলাম সর্বপ্রথম মানুষ গড়ার কথা বলেছে, রাষ্ট্র সেই মানুষেরা গড়ে নেবে। কিন্তু আমরা যদি আগে মানুষ গড়তে না পারি তাহলে অযোগ্য লোকদের দিয়ে কীভাবে রাষ্ট্র চালাব?

ইসলাম গ্রহণ করে আমাদের নবীজি (সা.) মানুষকে মানুষ হতে বলেছেন। বলেছেন, সবার চেয়ে উন্নত চরিত্রের হতে হবে। শারীরিক, মানসিক, আত্মিক সবদিক থেকে পিউর, খাঁটি মানুষ হতে হবে। নবীজির পরশে সেই মানুষগুলো যখন খাঁটি হয়েছে, চারিত্রিকভাবে সোনার মতো শুদ্ধ হয়েছে তখন তারা আবু বকর, উমর, উসমান, আলি, আয়েশা আর খালিদ, মুসআব, আবু জর গিফারি হয়ে ইতিহাস হয়েছেন। সর্বগুণে গুণান্বিত যখন হয়েছেন তখন তারা বদরে কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়েছেন আর আল্লাহ ফেরেশতা পাঠিয়ে তাদের বিজয় সুনিশ্চিত করেছেন । তারা কাদেসিয়া-ইয়ারমুকে কাতারবন্দী হয়েছেন। মাত্র বত্রিশ হাজার সেনা নিয়ে, শত্রুসংখ্যা দুই লাখ; তবু বিজয় এসে তাদের পদচুম্বন করেছে। কীভাবে? এই আত্মশক্তির বলে বলীয়ান ছিলেন তারা। রুহানিশক্তিতে জিন্দাদিল দরবেশ ছিলেন প্রত্যেকজন সাহাবি।

আমরা কেন আত্মশক্তিতে বলীয়ান হতে পারছি না? খুব সিম্পল উদাহরণ দেই। এখন আমরা ফেসবুকে নানা পোস্টে বিজ্ঞাপনে শত শত বেগানা নারীর ছবি-ভিডিও দেখে আমোদিত হচ্ছি আর এক ফাঁকে পোস্ট দিচ্ছি—‘ফিলিস্তিনের জন্য জিহাদে শরিক হতে তৈরি আছো হে নওজোয়ান?’ ইউটিউবে গান, নাটক, সিনেমা, নানা বেপৰ্দেগি দেখে দেখে নিজের চ্যানেলে আমিও একটি ভিডিও আপলোড করি—‘সাবধানে থাকিও নারী পর্দার আড়ালে।’ সোস্যাল মিডিয়ায় নানাজনের গিবত, পরনিন্দা, দোষচর্চা, গালিগালাজে মাখামাখির পর লিখি—‘তোমাকে ভালোবাসি হে নবী।’

এই হলো আমাদের নবীপ্রেম। বলো আমাকে, আমাদের নবীর চরিত্র এমন দ্বিচারী ছিল? কুরআনের প্রতিবিম্বিত তাঁর আখলাকে এমন দুশ্চরিত্রের কলুষ ছিল? কখনোই না। আমাদের নবী এমন চরিত্রবান ছিলেন তাঁর আগে কেউ এমন ছিল না, কেয়ামত পর্যন্ত আর কেউ আসবে না তাঁর মতো। তিনি কোনোদিন একটা মিথ্যাকথা বলেননি, কাউকে গালি দেননি, গিবত-পরনিন্দাকে ঘৃণা করতেন চরমভাবে, দ্বিচারিতা ছিল না তাঁর চরিত্রে, মনে একটা আর মুখে আরেক কথা বলতেন না কখনো, ষড়রিপুর ওপর ছিল তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। এবং এমনই হতে হবে একজন দরবেশকে।

আমার যদুর বোধ, একজন মুসলিমের জীবনে সচ্চরিত্র ছাড়া দুনিয়ার আর সকল কিছুই মূল্যহীন। যিনি মাদরাসার প্রিন্সিপাল বা মসজিদের ইমাম-খতিব, কিন্তু তিনি মিথ্যা-মনগড়া কথা বলেন, বা অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায্যভাবে ভোগ করছেন, মুসলিম হিসেবে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। যে পীর সাহেবের লাখ লাখ ভক্ত-মুরিদান, দ্বীনের ওয়াজ-নসিহত করে যাচ্ছেন দিন-রাত, কিন্তু তিনি অন্যের গিবত করেন, অন্যের সামনে পরনিন্দা করতে আনন্দবোধ করেন—তিনি কখনোই গুড মুসলিম নন, নবীজির কাশমোকাশে দরবেশ হওয়ার যোগ্য তিনি নন। এমন হাজার হাজার পীরে পৃথিবী ভরে গেলেও ইসলামের বিজয় সম্ভব না। বছরের পর বছর ধরে দাওয়াতে তাবলিগের কাজে সময় লাগানো তাবলিগওয়ালা, নামাজে তাকবির উলা কাজা না হওয়া মুসল্লি, ওয়াজ-মাহফিলে কেঁদে কেটে বুক ভাসানো ওয়ায়েজ, খেলাফত প্রতিষ্ঠায় প্রাণোৎসর্গিত আবেগী তরুণ—সবার আমলের ফরজিয়্যাত চলনসই কিন্তু চরিত্রে বেঠিক, সচ্চরিত্রের সার্টিফিকেট যাদের দেওয়া যায় না, তাদের দ্বারা দ্বীনের বড় বেশি ফায়দা কখনোই হবে না।

ইসলামে সচ্চরিত্র যদি না থাকে তবে আর কিছুই থাকবে না। একজন মুসলিমের শক্তিধর পরমাণু অস্ত্র হলো তার সচ্চরিত্র। এ এক অমিয় শক্তি, যার সংস্পর্শে মাত্র ত্রিশ বছরে অর্ধেক পৃথিবীর মানুষ ইসলামে বিভাসিত হয়ে ধন্য হয়েছিল। তখন যারা মুসলিম শাসক ছিলেন, তারা হতেন সবচে বড় দরবেশ। যারা সেনাপতি ছিলেন, তাদের সচ্চরিত্র নিয়ে বাজি ধরা যেত। যারা দাঈ ছিলেন, চরিত্রের বিভায় তারা ছিলেন নবীজির প্রতিচ্ছবি। একারণেই খেলাফতে রাশেদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মরক্কো থেকে চিনের কাশগড় পর্যন্ত।

আজ ধর্মের জন্য জীবন দিয়ে শহীদ হওয়ার মতো আবেগী তরুণের অভাব নেই, কিন্তু নিজের আমিত্ব ত্যাগ করে সচ্চরিত্রবান হওয়া যুবক খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য। তুমি সচ্চরিত্রবান হও, আখলাকওয়ালা হও, পৃথিবীটা একদিন সত্যি সত্যি তোমার হবে। চৌদ্দশ বছরে মুসলিমদের যত পরাজয়, প্রতিটি পরাজয়ের পেছনে তত্ত্ব তালাশ করে দেখো, কেবল নৈতিক অবক্ষয়ই ছিল তাদের পরাজয়ের মূল কারণ। চারিত্রিক অধঃপতন আমাদের নতজানুতার প্রধান কারণ।