বেফাক (বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ – বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড) নিয়ে অনেক আগে কথাবার্তা বলতাম। এখন আর বলি না। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানটি এতটা অনিয়ম, অবহেলা, অস্বচ্ছতা এবং স্বেচ্ছাচারী প্রক্রিয়ায় পরিচালিত হয় যে, এটা নিয়ে কথা বলা অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনি যতই এটাকে সংস্কার করার কথা বলেন না কেন, আপনার ফরিয়াদ ফরিদাবাদ-যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত গিয়ে আটকে যাবে, কাজলা বেফাক ভবন পর্যন্ত কখনোই পৌঁছবে না।

বেফাক নিয়ে আমার সবচে বড় প্রশ্ন হলো, একটি শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান, মহাপরিচালক, পরিচালনা পর্ষদ, নির্বাহী কমিটি, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটির প্রায় সকল সদস্য কোনো না কোনো কওমি মাদরাসার প্রিন্সিপাল/শিক্ষক হওয়া সত্বেও কীভাবে শিক্ষাবোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন থাকেন?

ব্যাপারটা বুঝেন। একজন ব্যক্তি এক বা একাধিক মাদরাসা পরিচালনা করছেন, আবার সেই মাদরাসার শিক্ষা ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে যে প্রতিষ্ঠান, তিনি সেটারও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। পরিস্থিতিটা এমন—আপনি প্রাণ কোম্পানির ডিরেক্টর, যারা নানা রকম পণ্য উৎপাদন করে; আবার আপনিই হচ্ছেন পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই-এর (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস্ অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। প্রাণ কোম্পানির পণ্যের মান নিয়ে কখনো কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে?

আপনি যত বড় ইসলামি ব্যক্তিত্ব হন বা যত বড় ইসলামি নেতা হন, একটি জাতীয় শিক্ষাবোর্ডের নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বে থাকলে আপনি কখনোই নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারবেন না। অতীতে এর বহু প্রমাণ রয়েছে।

আমার দুঃখ লাগে, কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠার বিগত ৪০ বছরে এর পরিচালনা ও নির্বাহী পরিষদে শিক্ষাবিদ কাউকে নিয়োগ পেতে দেখিনি। ইসলামি শিক্ষার মান উন্নয়নে যার বিস্তর অভিজ্ঞতা রয়েছে, ইসলামি শিক্ষা কারিকুলামে যিনি নতুনত্ব আনতে পারদর্শী, লাখ লাখ কওমি শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের ব্যাপারে যিনি ওয়াকিফহাল ও দরদি, আধুনিক ও সমকালীন শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়ে যার রয়েছে চ্যালেঞ্জিং মনোভাব—এমন ব্যক্তিদের আপনারা কখনোই বেফাকের আশেপাশে দেখবেন না।

নানা সময় যারা উঁচু পদগুলোতে সমাসীন হয়েছেন তাদের যোগ্যতার মানদণ্ড এমন—অতীতে এখানে মহাপরিচালক করা হয়েছে যার আত্মত্যাগ সীমাহীন। পরিচালনা পর্ষদে জায়গা দেওয়া হয়েছে তাদের—যাদের অধীনে বা যাদের মাসলাকে অনেক মাদরাসা রয়েছে। নির্বাহী বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এমন ব্যক্তিদের—যারা রাজনৈতিক বা পীরতন্ত্রে শক্তিশালী। কখনো পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন এমন কেউ—যার নিজের নিরপেক্ষতা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে বহুবার।

বেফাকে কওমি শিক্ষার্থীদের ভাগ্য নির্ধারিত হয় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এখানে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান উন্নয়ন, মাদরাসাগুলোতে কঠোর রেগুলেটরি, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণে আধুনিকায়ন—এসবের প্রতি তেমন কোনো ভ্রুক্ষেপ করা হয় না। বেফাক চলে বিরাট সিন্ডিকেটের অধীনে। এখানে কায়েম হয়েছে বিভিন্ন মাসলাক ও পরিবারতন্ত্রের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট ভেঙে কওমি শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান উন্নয়ন কেবল স্বপ্নে সম্ভব, বাস্তবে নয়।

এ কারণে আজ যখন ফেসবুকে দেখলাম, মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভীকে বেফাকের মহাপরিচালক করা হয়েছে, তখন খুব বেশি আনন্দিত হইনি। বরং মাওলানা নদভীর জন্য কিছুটা দুঃখবোধই হলো। তিনি বিশিষ্ট লেখক-কলামিস্ট, আধুনিকমনষ্ক ইসলামি ব্যক্তিত্ব, সমাজচিন্তক এবং উপমহাদেশের দেওবন্দি ধারার ইসলামি শিক্ষা নিয়েও তার চিন্তাধারা সরল ও স্বচ্ছ। আরবি, ইংরেজি, বাংলা, উর্দু, ফার্সিতে তার দখল ঈর্ষণীয়। উপরন্তু তিনি মাওলানা আতাউর রহমান খানের (রহ.) পুত্র, যিনি ছিলেন বেফাক প্রতিষ্ঠার অন্যতম কুশীলব এবং বেফাকের মহাসচিবও ছিলেন দীর্ঘ সময়।

কিন্তু বেফাকে গজিয়ে ওঠা সিন্ডিকেট সাম্রাজ্যে মাওলানা নদভী কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন, সেটা প্রশ্নস্বাপেক্ষ এবং চিন্তারও। সেখানে এত এত কুতুব ও স্বেচ্ছাচারী লোকজন বসে আছেন, সহজ নয় সেই সাম্রাজ্য ভেঙে ইসলামি শিক্ষার আধুনিকায়ন। তবু আমরা আশাবাদী, তিনি নতুন কিছু করার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন।

বেরসিক অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, মাওলানা নদভী যে বেফাকের মহাপরিচালক হলেন, তিনি কোন মাদরাসার দায়িত্বশীল? বুঝুন ঠ্যালা! অথচ কওমি শিক্ষার্থীদের শোকরিয়া জ্ঞাপন করা উচিত ছিল যে বেফাকে অন্তত এমন কেউ দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন যিনি কোনো মাদরাসার দায়িত্বশীল নন। সুতরাং তার নিরপেক্ষতা নিয়ে অন্তত প্রশ্ন তোলা হবে না। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্কে এই বিশ্বাস ঢুকে গেছে যে, বেফাকে ঊর্ধ্বতন কোনো পদে সমাসীন হতে হলে তাকে অবশ্যই বড় কোনো মাদরাসার প্রিন্সিপাল হতে হবে।

এগুলো আমাদের চিন্তার দৈন্য। আর এই চিন্তার দৈন্য এক দিনে তৈরি হয়নি। বেফাক নিয়ে বছরের পর বছর ধরে চলে আসা অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতা আমাদের ভেতরে এই চিন্তাকে পরিপুষ্ট করেছে। এখন আমাদের কাছে অনিয়মই সঠিক নিয়ম মনে হয়, স্বেচ্ছাচারিতাকে মনে হয় আল্লাহর রহমত! চিন্তার এই অর্গল না ভাঙলে কওমি শিক্ষার মান উন্নয়ন আগামী একশ বছরেও সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।


Leave a Reply

Your email address will not be published.