আজ থেকে ৭০০ বছর আগের ওয়াজ-মাহফিলের বর্ণনা দিচ্ছেন ‘তারিখ-ই-ফিরুজশাহী’ গ্রন্থের লেখক জিয়াউদ্দিন বারানী। জিয়াউদ্দিন নিজেও ওই সময়কালের মানুষ ছিলেন (জন্ম ১২৮৫-মৃত্যু ১৩৫৮)। দিল্লিতে তখন সুলতান আলাউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ খিলজীর শাসন চলছিল। এ গ্রন্থে তিনি ফিরুজশাহী বংশের শাসনামল লিখতে গিয়ে সেই চতুর্দশ শতকে ভারতবর্ষে ওয়াজ-মাহফিলের হাকিকত আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। লেখকের ভাষায়—বেশ জমজমাট ছিল সে সময় ওয়াজ-মাহফিলের বাজার। এটা পড়ার পর বুঝলাম, আমাদের আজকালের মাহফিলের বক্তাগণ পূর্বসূরীদের ধারা বেশ ভালোভাবেই আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।

“আলাই (আলাউদ্দিন খিলজী) শাসন আমলে এমন অনেক ওয়ায়েজ-ধর্মীয় বক্তা ছিলেন, যাহাদের তুলনা এই দুনিয়ার কোথাও পাওয়া যায় নাই এবং আজ পর্যন্ত কেহ অনুরূপ কাহারও সন্ধান দিতে পারে নাই। এই সকল ওয়ায়েজের পুণ্য প্রভাবে দিল্লীর শহর আলোকিত এবং জমজমাট হইয়া উঠিয়াছিল। সপ্তাহের কোন দিন ওয়াজ নসিহত ব্যতীত যাইত না। আলাই আমলের এই সকল ওয়ায়েজের মধ্যে একজন ছিলেন মওলানা এমাদ উদ্দিন হেসাম দরবেশ। যাহার সর্বদা এই দরবেশের ওয়াজ নসিহত শুনিবার সৌভাগ্য হইত, তাহাকে অবশাই স্বীকার করিতে হইত যে, এক আশ্চর্য ওয়াজ সে শুনিয়াছে। মওলানা এমাদের ন্যায় এমন আবেগপূর্ণ, এমন হাস্য কৌতুকময়, এমন সারগর্ভ, এমন তত্ত্ব গভীর, এমন প্রাঞ্জল, এমন মনোমুগ্ধকর সুন্দর ওয়াজ কোন কর্ণ শুনে নাই ও কোন চক্ষু দেখে নাই। আলাই আমলের বিশ বৎসরব্যপী মওলানা এমাদ ওয়াজ করিয়াছেন এবং ওয়াজের মহফিল গরম করিয়া রাখিয়াছেন। তাহার ওয়াজের মহফিলে বিচক্ষণ, জ্ঞানী, বুজুর্গ, মান্যবান ও কবিরা উপস্থিত থাকিতেন। এই সকল ওয়ায়েজের মহফিলে আবেগের পরিবেশে মওলানা হামিদ, মওলানা লতিফ মুকরী এবং তাহাদের পুত্ররা কোরান পাঠ করিতেন। তাহাদের সুর লহরীতে আকাশের পাখীও মাটিতে নামিয়া আসিত। বস্তুতঃ তাহাদের ওয়াজ নসিহতের ফলে মহফিলে এমন উত্তেজনার সৃষ্টি হইত যে, চতুর্দিকের শ্রোতারা আবেগে দাঁড়াইয়া পড়িত এবং সকলের কণ্ঠে কান্নার শব্দ ও হাহুতাশের আওয়াজ উঠিত। এক সপ্তাহেও এই আবেগের রেশ হৃদর হইতে দূর হইত ন। ইহার ফলে মানুষের মন সেই মহফিলের দিকে পাগলের ন্যায় ছুটিয়া যাইত।”


তারিখ-ই-ফিরুজশাহী, পৃষ্ঠা ২৯৫ (বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বইটি সম্ভবত বাজারে নেই, পিডিএফ পেতে পারেন অনলাইনে।)