“আমি মানে অ্যানা। মেম্ফিসের এক দরিদ্র লেখক, নকল করাই যার পেশা। হায় হতভাগ্য পেশা ! একদিন যে প্যাপিরাসের কালো অক্ষরমালা আমার পিতা পিতামহকে দিয়েছিল ঐশ্বর্য সম্মান, সে প্যাপিরাসের রাতদিন কলম ঘুরিয়েও এখন আমার রুটিরুজি চলেনা। আজকাল তাই গল্প লেখাও শুরু করেছি ।”

প্রাচীন মিশরের মেম্ফিস শহরের এক ভাগ্যান্বেষী যুবকের আত্মকথন দিয়ে শুরু হয়েছে বইয়ের কাহিনী। কতটা প্রাচীন? দুই হাজার, তিন হাজার কিংবা চার হাজার বছরের প্রাচীন? হতে পারে। অথবা তার চেয়েও হাজার বছরের পূর্বের কোনো এক মিশরের দিনপঞ্জি মোড়ক খুলেছে ‘মুন অভ ইজরাইল’ নামের অনুবাদ বইটিতে। অসামান্য কল্পনার প্রকৌশল দিয়ে লেখক বর্ণনা করেছেন সে সময়কার মিশরের ব্যস্ত নগরীর। রাজপ্রাসাদ, বিলক্ষন পথ-ঘাট, নীলনদের সাড়ম্বরতা। আর পরম যত্নে পাঠকের হৃদয়ে উদ্ভাসন করেছেন কয়েক হাজার বছর পূর্বের মিশরে উত্থান হওয়া এক নতুন মহাসত্যের। এক মহামানবের। নাম তার মূসা । মিশরে তদানীন্তন নির্যাতিত জাতি বনী ইসরাইলীদের উদ্ধারকর্তা।

আমাদের জানা কুরআনিক কাহিনীকে নতুন ছাঁচে ঢেলে উপন্যাসের দ্যোতনায় সংযোজিত করেছেন ‘হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড’। বৃটিশ লেখক। বৃটেনে তিনি প্রবাদপ্রতিম ঔপন্যাসিক। লিখেছেন ইংরেজিতে। পৃথিবীর বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার লেখা। বাংলা ভাষায়ও অনুবাদ হয়েছে তার অনেক উপন্যাস। ‘মুন অভ ইজরাইল’ তারই একটি।

এ উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে কয়েক হাজার বছর আগের মিশরকে উপজীব্য করে। ইউসুফ আ.-এর বংশধর বনী ইসরাইলরা তখন ভীষনভাবে নিগৃহীত মিশরে । কারণ একদা তারা ছিল কেনানের অধিবাসী। ইউসুফ আ. তাদেরকে এখানে বসবাসের সুযোগ দেন। কিন্তু জাত্যাভিমানী মিশরীরা তাদেরকে সহ্য করতো না। ইউসুফ আ.-এর গড়া সাম্রাজ্য কালের বিবর্তনে খতম হয়ে যাবার পর ধীরে ধীরে মিশরীরা বনী ইসরাইলদের উপর শুরু করে অকথ্য নির্যাতন। এভাবে একসময় তাদেরকে দাসে পরিণত করে ফেলে।

গল্পকার অ্যানার জবানবন্দিতেই শোনা যাবে কিরূপ আচরণ করা হতো তখনকার বনী ইসরাইলদের সাথে।… “বেশ চলছিলো দাসেরা , হঠাৎ একটা অঘটন ঘটল। দলের এক বৃদ্ধ (বনী ইসরাইলী), তার বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। সে তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারছেনা দলের অন্যসব জোয়ানদের সাথে। বারবার হোঁচট খাচ্ছে। ফলে, দলের গতি ব্যাহত হচ্ছে, থেমে যাচ্ছে বারবার। আমাদের সামনে দিয়ে যাবার সময় বুড়ো ক্লান্তিতে একেবারে ঢলে পড়লো। আর উঠতো পারলো না। পাহারাদারদের একজন ছুটে এসেই চাবুক বের করল। সিন্ধু ঘোটকের চামড়ায় তৈরি ভয়ংকর চাবুক। দু‘চার ঘা পড়তেই বুড়োর চামড়া ফেটে রক্ত গড়িয়ে নামল”।

বস্তুত বাস্তব অবস্থা তখন এমনই ছিল। বনী ইসরাইলীরা গণ্য হতো দাস হিসেবে। তাদের না ছিল সামাজিক অধিকার, না ছিল মানবিক সহমর্মিতা পাবার এতটুকু ন্যায্যতা। এমনই এক সময়ে মিশরে আবির্ভূত হন একজন নবী। একজন নয় দু‘জন। একজনের নাম মূসা আঃ, অপরজন তাঁরই সহোদর হারুন আ.। তারা মিশরের তদানীন্তন ফারাও ( ফারাও মানে ফেরআউন। এখানে মনে রাখতে হবে যে, ফেরআউন কারো নাম নয়। মিশরের তখনকার রাজ্যাধিপতিদের ফেরআউন বলা হতো। এটা ছিল তাদের উপাধি। তাদের সবার আলাদা আলাদা নাম থাকতো।) ‘মেনাপটা’র কাছে প্রস্তাব করেন তিনি যেন বনী ইসরাইলদেরকে এ দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যাবার সুযোগ দেয়। কিন্তু অহংকারী ফারাও মেনাপটা তাদের সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ফারাওয়ের কাছ থেকে ব্যর্থ হলে নবীদ্বয় মিশরবাসীকে হুশিয়ার করে দেয় অনাগত কোন এক ভয়ংকর ভবিষ্যতের।

এদিকে ফারাও মেনাপটার পুত্র ছিল যুবরাজ শেঠি। সে ছিল বিচক্ষন, দয়ালু এবং বনী ইসরাইলদের প্রতি সহমর্র্মি। মেনাপটার পরে মিশরের সিংহাসনের যোগ্য অধিকারী। কিন্তু রাজপ্রাসাদের সকল কৌলিণ্য জলাঞ্জলী দিয়ে যুবরাজ শেঠির জীবনে মমতার আশির্বাদ হয়ে আসে এক বনী ইসরাইলী যুবতী – মেরাপি। ফারাও রাজপ্রাসাদে শুরু হয় এক নতুন সংঘাত। যুবরাজ শেঠির চাচাতো ভাই আমেনমেসিস ফেলতে থাকে ষড়যন্ত্রের কুটিল জাল। দখল করে নেয় মিশরের সিংহাসন। আর সত্যের প্রচারক নবীদ্বয় বনী ইসরাইলীদের সাথে নিয়ে নিতে থাকেন কী এক গোপন প্রস্তুতি। যুবরাজ শেঠি মিশরবাসীর জন্য বয়ে আনেন নীলনদের এক রোমহর্ষক প্রলয়কান্ডের সংবাদ। এগিয়ে যেতে থাকে কয়েক হাজার বছর আগের ইতিহাসের এক অম্লান অধ্যায়।

এভাবেই বইটির পাতায় পাতায় রয়েছে যুদ্ধ, সংঘাত, ষড়যন্ত্র, প্রেম আর বনী ইসরাইলী নবী মূসা ও হারুনের আ. তরতাজা উপাখ্যান। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, উপন্যাসের মূল কাহিনী নেয়া হয়েছে কুরআন থেকে। মূল কাহিনীর উপর লেখক হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড তার যোগ্য কলমের প্রতিশ্রুতিতে বাঙময় করে তুলেছেন প্রতিটি চরিত্রকে। খুবই অবাক লাগে, তিনি একজন খ্রিষ্টান হয়েও কুরআন বা তাওরাতের ভাষ্য নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। আমরা কুরআন হাদীসের ঝান্ডাবাহী বলে বেড়ালেও এই শ্রমটুকু কখনো করার প্রয়োজন বোধ করিনি। বইটি পড়লে আশা করি সেই অনুপ্রেরনা পয়দা হবে।

চুয়াল্লিশ টাকা মূল্যের বইটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘সেবা প্রকাশনী’, ২৪/৪ কাজী মোতাহার হোসেন সড়ক, সেগুন বাগিচা, ঢাকা-১০০০। দেশের যেকোন লাইব্রেরিতে খোঁজ নিলে বইটি পাওয়া যেতে পারে।

চেতনা, মার্চ ২০০৯