ভাটিয়ারী থেকে হাটহাজারী আসতে আধঘণ্টার মতো লাগল। মাদরাসার পাশে ইশতিয়াক সিদ্দিকীর ডেরা – বাংলাবাড়ি। বাংলাবাড়ি ইশতিয়াক ভাইয়ের একটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, যেখানে মাদরাসার ছাত্রদের বাংলা ভাষাজ্ঞান, লেখালেখির কলাকৌশল, সাংবাদিকতার পথ-পদ্ধতি এবং ইত্যকার বিষয়াদি শেখানো হয়। মাদরাসার পশ্চিম পাশের মার্কেটের দোতলায় একটা কামরা নিয়ে চলছে তার বাংলাশিক্ষণ কার্যক্রম। আমরা গিয়ে সেখানে উঠলাম।

ইশতিয়াক ভাইয়ের সঙ্গে এহসানের পুরোনো সম্পর্ক, সেই হিসেবে আমাদের খয়ের খা। আমার সঙ্গে এর আগে একবার দেখা হয়েছিল ঢাকায়, কোন একটা লেখক পরিষদের অনুষ্ঠানে যেন। সেখানে পরিচয়-পেহচান। এরপর ফোনে কথা হয়েছে বারদুয়েক। আজ আবার দেখা হলো। কিছু মানুষের মুখচ্ছবিই এমন, দেখলে মন আপনাআপনি ভালো হয়ে যায়; ইশতিয়াক ভাইয়ের সপ্রতিভ হাসি অমন। বয়স এখনও পঁচিশ পেরোয়নি সম্ভবত, বিয়েথা হয়নি, কিন্তু দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন বালক।

বাংলাবাড়িতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল হাবিব আনোয়ার। এর সঙ্গেও দেখা হয়েছিল লেখক পরিষদের অনুষ্ঠানে, ওই একবারই। মেসেঞ্জারে কথা হয়েছিল একবার, আশরাফ আলী নিজামপুরী সাহেব কী ব্যাপারে যেন একটা লেখা চেয়েছিলেন, হাবিব ছিল সেটার বার্তাবাহক। কিন্তু এখানে হাবিবকে দেখে আমার মনে হলো, এই ছেলেকে আমি আরও বহুবার কোথাও না কোথাও দেখেছি।

বেশ কিছুক্ষণ বাংলাবাড়িতে বসে গল্পগুজব চলল। হাটহাজারী মাদরাসায় কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে কথা বললাম। কথা বললাম লেখালেখি বিষয়ে। দ্বীন-দুনিয়ার আরও নানা বিষয় নিয়ে কথা হওয়ার পর মনে হলো, পেটের বিদ্রোহ আর উপেক্ষা করা উচিত নয়। নামাজ পড়ে বের হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়া উচিত।

গোসল করার দরকার ছিল যদিও, ঠাণ্ডায় মাথা টন টন করছে। গোসল করলে হালকা হতো। কিন্তু এখন তো নানা জায়গায় যেতে হবে, শরীর আবার জেরবার হয়ে যাবে সারা দিনে। বিকেলে ফের গোসল করতেই হবে। এখন গোসল আবার বিকেলে গোসল, তাতে হিতে বিপরীত হয়ে ঠাণ্ডা আরও জোরদার হতে পারে। এসব ভেবে ভালো করে হাত-মুখ ধুয়ে অজু করে গোসলটা বিকেলের জন্য তোলা রাখলাম।

হাটহাজারী মাদরাসার কাছেই মুসলিম হোটেল। দুপুরের খাবারের জন্য সেখানে গেলাম। রান্না ভালো না, সব তরকারিতে পাতলা ঝোল। লালশাক রান্না করেছে, সেটাতেও ঝোল। কী বিতিকিচ্ছিরি!

খাওয়া শেষে এহসানকে বললাম, এখন আমাদের রোখ কোনদিকে?

এহসান বলল, চলো, আবদুর রহীম ইসলামাবাদীর সঙ্গে দেখা করে আসি। সেই সঙ্গে নাজিরহাট মাদরাসায়ও যাওয়া হবে। কাছেই, বড়জোর আধঘণ্টা লাগবে।

আমার গররাজির কারণ নেই। বললাম, চলো।

মাসখানেক আগে সিলেট গিয়েছিলাম। তিন দিন ছিলাম সেখানে। এ তিন দিনে সিলেটের ছয়-সাতটা উপজেলায় গিয়েছি, পরিদর্শন করেছি প্রায় পনেরো-বিশটা বড় বড় মাদরাসা। রানাপিং, রেঙ্গা, গহরপুর, দরগাহ, কৌড়িয়া, কাজীরবাজার, মামরখানীসহ অনেক মাদরাসায়। বাংলার হাজার বছরের মুসলিম ব্যক্তিত্বদের জীবনী সংগ্রহের একটি প্রকল্প শুরু করেছি আমরা কয়েকজন মিলে, আমি, এহসান সিরাজ, মনযূরুল হক এবং ইফতেখার জামিল। সেই জীবনী সংগ্রহের কাজেই সিলেট যাওয়া হয়েছিল।

তো, এই সফরে গিয়ে দেখা করেছি মাদরাসার প্রিন্সিপালদের সঙ্গে, সেখানকার শিক্ষকদের সঙ্গে, ছাত্রদের সঙ্গে। এছাড়া সিলেটের অনেক আলেম এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গেও সাক্ষাত করেছি, কথা বলেছি তাদের সঙ্গে। এই সফরে একটা জিনিস শিখেছি। কাজের জন্য কোনো সফরে গেলে বিশ্রাম বা ঘোরাঘুরির পেছনে সময় নষ্ট করা চলবে না। অল্প সময়ের মধ্যে যত বেশি সম্ভব কাজ এগিয়ে নিতে হবে। যত বেশি কাজ করা যাবে ভবিষ্যতের জন্য তত বেশি এগিয়ে থাকব।

আরেকটি জিনিস শিখেছি। অল্প সময়ে যত বেশি জায়গায় যাওয়া যাবে, যত বেশি সংখ্যক মানুষের সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হবে তত বেশি জ্ঞানী হবে, তত ঋদ্ধ হবে জীবনের জন্য। এক জীবনের পুরোটাই তো নিরেট শূন্য, মানুষের সান্নিধ্যে গিয়ে কিছু পালক তবু যোগ হোক অভিজ্ঞতার মুকুটে।

দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করে সিএনজিতে উঠে বসলাম। হাটহাজারী থেকে উত্তর-পশ্চিমে নাজিরহাট। রাস্তা ভালো, ভীড়-বাট্টা নেই খুব একটা। অবশ্য রাস্তার দুই পাশে রাস্তা বাড়ানোর কাজ চলছে। তাতে মূল সড়কের চলাচলে কোনো সমস্যা হয়নি। শরীর ছেড়ে দিয়ে বসলাম, এক ছিলিম ঘুমিয়ে নেয়া যাক।

গাড়িতে ঘুমানো খুবই স্বাস্থ্যকর একটা ব্যাপার। এ ব্যাপারে আমি বরাবরই সচেতন। ট্রেন-বাস থেকে শুরু করে সিএনজি, অটো, রিকশা এমনকি পাঠাও-এর ড্রাইভারের পেছনে বসেও ঘুমানোর রেকর্ড আছে আমার। এমন না যে আমি খুব ঘুমকাতুরে, নিজের ঘুমের ওপর আমার পূর্ণ কন্ট্রোল আছে। আমি কখন ঘুমাব এবং কতক্ষণ ঘুমাব—এটা আমি কন্ট্রোল করতে পারি। ভরা মজলিসে, বন্ধুদের আড্ডায়, কিংবা ক্লাসে আমার ঘুমানোর অভ্যাস নেই।

হেফজখানায় তো আমার না ঘুমানোর রেকর্ড আছে। ফজরের আগে উঠে সবক শুনিয়ে এবং ফজরের পরে সাতসবক শোনানো পর্যন্ত আমাদের হেফজখানার প্রায় সব ছাত্র ঢুলে ঢুলে সবক ইয়াদ করত আর ঝিমাতো। এমন কেউ ছিল না যে সপ্তাহে দু-একদিন ঝিমুতো না। একমাত্র আমি এক বান্দা ছিলাম যে হেফজখানার তিন বছরে কোনোদিন ঝিমাইনি। কত ছাত্র ছিল ঝিমানোর কারণে যারা প্রতিদিন বেতের বাড়ি খেত। দু-একজন তো ঝিমুতে ঝিমুতে বেঞ্চের উপর পড়ে যেত। আমার ঝিমুনিই আসত না। এখনও আমি চেষ্টা করি দিন-রাতে পাঁচ ঘণ্টার বেশি না ঘুমাতে। ঘুম আমার কাছে খুবই বাজে একটা ব্যাপার মনে হয়। কত কাজ, কত সুন্দর পৃথিবী, চারপাশে কত কী ঘটে যাচ্ছে, এর মধ্যে পাঁচ-সাতটা ঘণ্টা অযথা চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকা। কোনো মানে হয় এর!

গাড়িতে ঘুমানোর একটা বড় ফায়দা হলো, ১০-২০ মিনিট ঘুমিয়ে জেগে উঠলে শরীরটা দারুণ চাঙ্গা লাগে। মনে হয় দুই-তিন ঘণ্টা ঘুমিয়ে উঠলাম। ওই ১০-২০ মিনিটের ঘুম শরীরে দারুণ এনার্জি এনে দেয়। শরীরে একটা ভাব চলে আসে। যারা গাড়িতে ঘুমানোর এমন প্রাকৃতিক এনার্জি থেকে বঞ্চিত তারা দ্রুত এই ঘুমটনিক ট্রাই করতে পারেন। দেহমনে ফিরে পাবেন অলৌকিক তাকত!

কিসের আধা ঘণ্টা, হাটহাজারী থেকে নাজিরহাট পৌঁছতে পাক্কা পৌনে একঘণ্টা লাগল। যাক, তবু রাস্তা ভালো ছিল বলে রক্ষে।