জানালার পর্দা দুলে উঠার মাঝে একটা ব্যাপার আছে। মিহি একটা তাল, অনেকক্ষণ চেয়ে থাকলে তালটা ধরা যায়। আমি জানালার পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকছি না আজকাল। জানালা বেশ একটা দরকারি বিষয়— আলো-বাতাস দেয়, বেলা দেখা যায়, হ্যাঙার ঝুলিয়ে রাখি; সবময়ই তো চোখে পড়ে। সবসময় তাকাতে হয় না। 
সামনের ফ্ল্যাটের চারতলার দরোজায় দুটো মেয়ে এসে দাঁড়ায় মাঝেমধ্যে। হঠাৎ এলে চোখের বারান্দায় ওদের নড়াচড়া ধরা পড়ে। কখনো দেখি— কেমন কেমন চোখে জানালা গ’লে এদিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভয়কাতুরের মতো শঙ্কাবোধ করি। নিজেকে আড়াল করতে ল্যাপটপের পাশে থাকা চশমাটা পরে নিই। অতো দূর থেকে ওরা আমার ভয়ার্ত চোখ দেখতে পায় না। আমি ভয়ে কুঁকড়ে যেতে থাকি। নিচের দিকে তাকিয়ে টিক-টক, টিক-টক করে কি-বোর্ডে টাইপ করি—
বিড়ালের চোখে রঙিন চশমা
ঠিকঠাক গোঁফের উপর গোলগাল
একটা চশমা ভারী বেশরম
কালো ফ্রেমে মায়াবী নরোম
চোখের পাপে চশমা কাঁদে
মন বুঝে না, মন জানে না
মন লোকটা বোকা রকম
আজকের বাতাসটা ভারী মিহি। সিনথেটিকের টি-শার্ট পরেও ঘামছি না। মশার ভয়ে রাতেরবেলা জানালা খোলা হয় না। আজ দুটোই খোলা— পশ্চিমের আকাশ সমান একটা, আর উত্তরের ভয়ার্ত জানালাটা। বন্ধ জানালায়ও একটা ব্যাপার আছে। বন্ধ জানালা বন্ধ থাকলে বিশ্বাস দৃঢ় হয়। নিজের মাঝে আত্মবিশ্বাস গাঢ় হয়। বাইরে অবাক পৃথিবী, আমি কাউকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছি না। ভিড় থেকে বিচ্ছিন্ন, পায়ের সাথে পা লাগে না। রঙিন ফুল দেখার আশায় মানুষের মুখের দিকে তাকাই না। তবু কিন্তু জানালার গ্রিল ধরতে হয় কখনো। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন? জানালার গ্রিল ধরে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থাকলে কিন্তু চোখ ভিজে ওঠে। মানুষের কল্পনাশক্তি একটা অদ্ভুত মেকানিজম। জানালার গ্রিল ধরে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকলে কল্পনাশক্তি প্রখর হয়। বাঁধনছাড়া হয়ে যায় কখনো। অবশ্য কল্পনা জিনিসটাই তো বাঁধনহারা। নিজের ভেতর নিজের এক মনমতো পৃথিবী। 
এক সিনেমার পরিচালককে জিজ্ঞেস করা হলো— আপনি সবসময় এমন সিনেমা বানান যেগুলোর সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল থাকে না। পরিচালক জবাব দিলেন— সত্য! আমি এমন কাল্পনিক বিষয় নিয়ে সিনেমা বানাই যেটা বাস্তবতাবিবর্জিত। কিন্তু একজন বাস্তবের মানুষ এই অবাস্তব পৃথিবী, পরিবেশ, ঘটনা নিজের ভেতরে কল্পনা করে। নিজেকে একজন সুপার হিউম্যান ভাবতে ভালোবাসে, যা সে কখনো হতে পারবে না। আমি আমার সিনেমায় বাস্তবতার জাঁতাকলে নিষ্পেষিত একজন মানুষকে তার কল্পনার কাছে নিয়ে যাই, সে বিনোদিত হয়। সিনেমার কাজ তো মানুষকে বিনোদিত করা, বাস্তবতা দেখানো না। বাস্তবতা তো সে নিজেই প্রতিদিন দেখছে। আমি নতুন করে সেটা দেখিয়ে কেন শুধু শুধু বিরক্তি উৎপাদন করবো?
জানালা গ’লে বৃষ্টির ছাঁটে হাত ভেজানো অত্যন্ত রোমান্টিক এক মুহূর্ত। দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, আমার দুটো জানালাই বিছানাঘেঁষা। বৃষ্টির ছাঁটে লোটা-কম্বল ভিজে যায়। কাচ লাগিয়ে কাচের গায়ে বৃষ্টির গলে পড়া দেখি। একেকটা ফোঁটা প্রবল বেদনা নিয়ে জানালায় আছড়ে পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে দেয়াল বেয়ে অতলে নেমে যায়। একেকটা ফোঁটার রেখে যাওয়া পদচিহ্নে মুহূর্তে আত্মাহুতি দেয় আরেকটি ফোঁটা। আলিঙ্গনহীনতার বেদনা নিয়ে মৃত্যু হয় এঁকেবেঁকে যাওয়া বৃষ্টিদের। কী নির্মম আমরা!
জানালার স্বচ্ছ স্ফটিক বৃষ্টি আর মানুষের ভালোবাসার মাঝে বেঁধে দিয়েছে অস্পৃশ্য মায়াবী দেয়াল। সভ্যতার ডানা ঝাপটানো অহংকারের তলে হাতের আঙুল প্রবল অনস্পর্শে কাতরধ্বনি করে ওঠে। বৃষ্টির তীক্ষ্মতায় মাটির গর্ভ থেকে উগরে দেয়া সোঁদা গন্ধ পাই না, পায়ের পাতায় মার্বেলভূমির উত্তাল অনুভব করি না, সুতীব্র শরীরের ডাক শোনে না বেহুলা বাতাস।
তবু একেকটা বিশাল বিরাট জানাল কতো প্রয়োজন হয় আমাদের। আমি খুব একটা পাকচক্রে পড়ে গেছি আজকাল, মাইরি!