‘ধন্য ধন্য মেরা সিলসিলা/আইলো দিল্লিতে নিজামুদ্দিন আউলিয়া…’
এই তবকার কিছু ফাতরামি গান আছে বাংলা-হিন্দি-উর্দুতে। এই গান যারা ভবসঙ্গে গায় তারা মনে করে, গানের উচ্চমার্গীয় কথাবার্তার বদৌলতে তারা বিরাট সুফি সাধক হওয়ার পথে। ফাতরামি গান গাওয়া এই শ্রেণির সুফি হওয়ার সর্বোচ্চ তবকা হলো মাজারের চোয়ালে বসে গাঞ্জা টানা আর সহজ কথাকে কঠিন করে বলার মারফতি জ্ঞান হাসিল করা।

ধরা যাক, আপনি তাকে গিয়ে বললেন, বাবা, কেমন আছেন? সে আপনার মাথার উপর দিয়ে উদাস নয়নে তাকিয়ে বলবে, ‘ভালো থাকতে কে আসিলো ভব মন/ খোঁজো তোমার পতিত পাবন…।’ বিরাট আধ্যাত্মিক বাতচিত! আপনার মাথা পুর্ব-পশ্চিমে আপনাআপনি দুলে ওঠবে!

এই তবকায় যারা বিরাজমান, তারা মোটা দাগে মোটামুটি ফ্রড বলে বিবেচিত। তাদের কথা থাক। তবে এই তবকাকে তাজিম করার একটা বোকাহিতৈষী শিক্ষিত শ্রেণি আছে, যাদের সুফিবাদের জ্ঞান মাজারের গাঞ্জা-ধূপের আলো-আঁধারি আর কবরে শিরনি-তাজিয়া দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ।

এরা ইংরেজিতে রুমির মসনবি আর শেখ সাদির গুলিস্তাঁ পড়ে মানবজন্ম নিয়ে কিছুদিন বেশ চিন্তায় থাকে। চলতি বাসে কিংবা অফিসের কলিগদের কাছে দুই-চার বয়েত মসনবি সার্ভ করেই ভাব ধরে-‘বুঝলেন বারেক সাহেব, বিরাট উপ্রের বিষয়-আশয়! সব তো বুঝবেন না, পুরা ফানাফিল্লাহ!’ বারেক সাহেব কোঁৎ করে পানের পিকের সঙ্গে ফানাফিল্লাহ গলধঃকরণ করে ফেলেন। এতো উপ্রের বিষয় যেখানে সেখানে তো ফেলা যায় না!

এদের ফানাফিল্লাহর রোলমডেল মনসুর হাল্লাজ। মনসুর হাল্লাজের বিভিন্ন ভার্সন আছে আমাদের শিক্ষিত এবং কম শিক্ষিত সমাজে। সবচে প্রাচীন ভার্সন আছে নাশিক্ষিত সমাজে। এরা এই ভার্সন প্রাপ্ত হয়েছে অধুনালুপ্ত বিভিন্ন পুঁথি এবং বাউল গানের মাধ্যমে। কখনো যদি গ্রামের কোনো প্রবীণ ব্যক্তির কাছে হাল্লাজের বিষয়ে জানতে চান, দেখবেন, সে আপনাকে হাল্লাজের জীবনকাহিনির আনকমন একটা ভার্সন উপহার দিবে। এবং বাংলাদেশে এটাই হাল্লাজের সবচে প্রাচীন এবং বানোয়াট ভার্সন। বাদবাকি শিক্ষিত সমাজের জন্য মনসুরের এলেম হাসিল করার মাদরাসা হচ্ছে উইকিপিডিয়া আর গুগল, এবং বাংলাবাজারে নিউজপ্রিন্টে ছাপা ৭৫% কমিশনের বাংলা বই। তাদের কাছেও হাল্লাজ নতুন ভাষায় মূর্তমান। আদতে বাংলাভাষায় এখনও হাল্লাজের তেমন কোনো বায়োগ্রাফি নেই বললেই চলে। তিনি যেমন মিস্ট্রিক মানুষ ছিলেন, তাঁর জীবন নিয়ে আরও হাজার ভোল্টের মিস্ট্রি তৈয়ার করেছে উপমহাদেশের ফাতরা লোকজন।

‘লালন ব্যান্ড’ নামে বাংলাদেশে একটা বেয়াদ্দপ ব্যান্ড আছে। এদের ভোকালিস্ট আনুশেহ আলাদিন নামের এক নেশামানবী। এরাই লালনের গান গায়। গান আর কী গায়, হেভি মেটাল ইন্সট্রুমেন্ট বাজিয়ে লালনের ধুতি খুলিয়া পাগড়ী বান্ধনের ব্যবস্থা আর কি! ইউরোপ-আমেরিকায় প্রায়ই তাদের ‘সুফি কনসার্ট’ করতে দেখা যায়। লালন সাঁই সম্ভবত এ ঘটনা আঁচ করেই লিখে গিয়েছিলেন- সত্য কাজে কেউ নয় রাজি/ সব দেখি তা না না না/ জাত গেল জাত গেল বলে…!

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ৯৮% পীর-মুরিদিই তাসাওউফের আলিফ-বা-তা সম্পর্কে বেখবর। এরা অজিফা আর মজ্জুব অবস্থার হকিকতের কদর করতে জানে, কঠিন কঠিন কিছু উচ্চমার্গীয় কথা বলে ভক্ত-আশেকানের কান বরাবর সামান্য টাশকি দিতে পারলেই হলো! এদের কাছে সুফিবাদ হচ্ছে বাবরি চুল রেখে গোসল না করে সপ্তাহর পর সপ্তাহ পার করা। বেয়াদ্দপ কোথাকার! গন্ধে তোর কাছে মানুষ আসা দায়, তুই আল্লাহর কাছে কেমনে যাবি? আল্লাহই জানে এরা সুফিবাদ মানে কী বুঝে!

এঁদের আর ‘ধন্য ধন্য মেরা সিলসিলা’ওয়ালাদের মধ্যে বিশেষ কোনো তফাৎ নেই। একজন মাজারে গিয়ে গাঞ্জায় পিনিক তুলিয়া ঢোলে বাড়ি মারে, আরেকজন খানকার অন্ধকারে কলবের মধ্যে আয়না বসিয়ে কলবের মরিচা দুর করার কোশেশ করে। দুইজনের সিলসিলাই কল্কের ধূমায়িত অরণ্যের মাঝে বিলীন হইয়া গিয়াছে।

ধর্মহীনতাই মানুষকে বিরাট বিরাট ফ্রড ধর্মব্যবসায়ীতে পরিণত করে!