১৯৪০ সাল। ঢাকার বাংলাবাজারের একটি আটপৌড়ে দোতলা বাড়ি। বাড়ির একটি ঘরে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বসা। তার সামনে বসে আছেন সৈয়দা আসরা খানম, যাকে এ পৃথিবী মনে রেখেছে ‘নার্গিস’ নামে। এ নামে আজ থেকে বিশ বছর আগে কবিই তাকে প্রথম ডেকেছিলেন।

নার্গিসের সামনে বসে কবি কাঁদছিলেন। দু চোখের জলে কবির গাল ভিজে যাচ্ছিলো। তিনি রুমাল দিয়ে চোখ মুছছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে বার বার শুধু নার্গিসকে বলছিলেন— ‘তুমি আমাকে ক্ষমা করো! আমাকে ক্ষমা করো!’

নার্গিসের চোখেও জলের আরতি। তিনি কোনো কথা বলতে পারছিলেন না। নতমুখে শাড়ির আঁচলে লুকোচ্ছিলেন বেদনার অনিঃশেষ জলধারা।

একসময় কবি নার্গিসকে জিজ্ঞেস করলেন— ‘বিশ বছর আগে দৌলতপুরে আমি ও তুমি যে যুগল একখানা ছবি তুলেছিলাম, ছবিটি কি এখনও আছে তোমার কাছে?’

নার্গিস কবির সামনে থেকে উঠে ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। একটু পরই ফিরে এলেন হাতে পুরোনো সেই ফটোগ্রাফটি নিয়ে। ঝাঁকড়াচুলো এক বাইশ-তেইশ বছরের তাগড়া তরুণের পাশে প্রস্ফুটোন্মুখ এক গ্রাম্য কিশোরীর আধোলাজমাখা মুখচ্ছবি। ফটোগ্রাফটি কবির হাতে দিতেই তার কান্নার উচ্ছ্বাস আরও তীব্র হলো। চোখ তুলে নার্গিসের দিকে তাকাতে পারছেন না। ফটোগ্রাফটির দিকে তাকিয়েই নার্গিসকে বললেন— ‘সারা জীবন আমি শয়তানের পাল্লায় পড়ে তোমার প্রতি শুধু অবিচারই করেছি। এ জীবনে তার প্রায়শ্চিত্ত শেষ হবে না। আমাকে তুমি ক্ষমা করো।’

কবি আসবেন বলে নার্গিস তার জন্য এটা সেটা রেঁধে রেখেছিলেন। কিন্তু কবি কিছুই খেলেন না। নার্গিসের কাছে শুধু এক খিলি পান চাইলেন। নার্গিস কবির জন্য পান বানিয়ে আনলেন। পান মুখে দিয়ে কবি আর বেশিক্ষণ দেরি করলেন না, নার্গিসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পথে নামলেন। এটাই ছিলো নজরুল ও নার্গিসের শেষ দেখা।

অবাক ব্যাপার হলো, কবি ও নার্গিসের এই সাক্ষাতের সুযোগ করে দেন নার্গিসের স্বামী কবি আজিজুল হাকিম। আজিজুল হাকিম নিজে কবি বলে কাজী নজরুল ইসলামকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। নজরুলও তরুণ বয়স থেকে স্নেহ করতেন আজিজুল হাকিমকে। কলকাতা থেকে ঢাকা এলে আজিজুল হাকিমের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটাতেন। আজিজুল হাকিম জানতেন কবি ও নার্গিসের জীবনের বেদনভরা অতীত প্রেমের কথা। এ কারণে নজরুল-বিচ্ছেদের সতেরো বছর পর আজিজুল হাকিম নার্গিসকে বিয়ে করেন।

কবি আজিজুল হাকিম নজরুলের প্রতি সম্মান জানিয়েই নার্গিসকে বিয়ে করেছিলেন। একদিকে নার্গিস নজরুল-প্রেয়সী, এ তিনি ভালো করেই জানতেন। নার্গিসকে নিয়ে নজরুল শত শত গান-কবিতা লিখেছেন। তার প্রেমের এক অনন্য সঞ্জীবনী নার্গিস। এ কারণে নার্গিসকে বিয়ে করে তিনি শ্রদ্ধেয় কবিকে সম্মান করতে চেয়েছিলেন। কবির সৃষ্টিকে প্রণাম করতে চেয়েছিলেন।

আরেকটা দিক হলো নার্গিসের ব্যথাভরা নিঃসঙ্গ জীবন। মাত্র এক রাতের সংসার শেষে নজরুল নার্গিসকে ফেলে চলে আসেন, সেই থেকে তিনি নজরুলের জন্য অপেক্ষা করেছেন। দীর্ঘ সতেরো বছর তিনি নজরুলের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনেছেন। ১৯২১ সালে মাত্র ষোল-সতেরো বছর বয়সে তিনি বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন, নজরুলের জন্য প্রতীক্ষা করতে করতে অবশেষে বিয়ে করেন কবি আজিজুল হাকিমকে। এটা ১৯৩৮ সালের কথা, তখন নার্গিসের বয়স মধ্য ত্রিশে।

কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে সৈয়দা আসার খানম নার্গিসের এ সাক্ষাতপর্ব আজিজুল হাকিমের সঙ্গে বিয়ের আরও দু’ বছর পর, ১৯৪০ সালে।

দুই

নজরুল-নার্গিসের প্রেমকাহিনি নিয়ে বাংলাসাহিত্যে অনেক কথা হয়েছে। অনেকে জল ঘোলা করেছেন। নতুন করে সে প্রেমকাহিনি নিয়ে আমার মতো নাবালকের আর ঘাঁটাঘাঁটির না করাটাই শ্রেয়। আমি এই দুই মানব-মানবীর প্রেমকে নিজের মতো করে একটু দেখার চেষ্টা করেছি মাত্র। আর তাছাড়া প্রেমের ভেতর দিয়ে কবি ও নারীর অনেক গভীর জীবনবোধও প্রস্ফুটিত হয় পাঠকের সামনে। মূলত সিরিয়াস কোনো আলোচনা নয়, কেবলই কবির জীবনের প্রেম নিয়ে কবিকে একটু বেকায়দায় ফেলা আর কি!

একটু গোড়া থেকেই শুরু করা যাক। ১৯২১ সালের মার্চ-এপ্রিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ করে কবি কাজী নজরুল ইসলাম তখন করাচির বাঙালি পল্টন ছেড়ে কিছুদিন হলো কলকাতায় ডেরা গেড়েছেন। বামপন্থী রাজনীতির সমর্থক কমরেড মুজফফর আহমদের সঙ্গে ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি’র অফিসেই তার বাস। এখানে নজরুল স্বাধীনভাবে গান-কবিতা, আড্ডা, হৈ-হুল্লোড়ে জীবন গুজরান করছিলেন।

এরই মধ্যে আলী আকবর খান নামের এক বঙ্গদেশীয় প্রকাশক আসেন নজরুলের কাছে। নজরুলের তখন কবি হিসেবে মোটামুটি একটা নামডাক ছড়িয়ে পড়েছে বঙ্গ সাহিত্য সমাজে। আলী আকবর খানও প্রকাশক হিসেবে বেশ ভালো ব্যবসা করছেন, সামনে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের ইচ্ছা আছে। নজরুলের সঙ্গে খানিকটা খাতির রাখা কর্তব্য ভেবেই তার কাছে এসেছিলেন। কিন্তু নজরুল তো প্রবল দিলখোলা মানুষ, খানিকটা খাতির থেকে আলী আকবর খানের সঙ্গে তার খাতিরটা একেবারে দহরম মহরম হয়ে গেলো। এমন খাতিরীয় সময়ে খান সাহেব নজরুলকে প্রস্তাব করলেন তার দেশের বাড়িতে বেড়িয়ে আসার জন্য। নজরুল একবাক্যে রাজি হয়ে গেলেন। নজরুল বাঁধনহারা, খান সাহেবের দেশের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর থানার দৌলতপুর যেতে তার কোনো বাধাই নেই। নজরুল মুহূর্ত সিদ্ধান্তে আলী আকবর খানের সঙ্গে দৌলতপুরের পথে রওনা হয়ে গেলেন।

সৈয়দা আসার খানম ছিলেন আলী আকবর খানের ভাগ্নি। পিতৃহীন এ কিশোরী মায়ের সঙ্গে মামাবাড়িতে থাকতেন। দেখতে সুশ্রী, খানিকটা চাপা স্বভাবের সৈয়দা আসরারকে প্রথম দেখায়ই ভালো লেগে গেলো নজরুলের। দুজনের কথা হলো, কথা বিনিময় হলো, কথা রাখা অনেক কথাও হলো। সহজ বাংলায়— দুজন দুজনের প্রেমে পড়লেন। নজরুল আসার খানমের নাম রাখলেন ‘নার্গিস’।

নার্গিসের মামা সুচতুর প্রকাশক আলী আকবর খান ভাববেলন, মন্দ কী? কবি হিসেবে নজরুলের নাম-যশ এখনই বেশ প্রসার, কিছুদিন পর তো সে দেশসেরা কবি হয়ে উঠবে। প্রকাশক হিসেবে আলী আকবর খানের হিসাব বেশ সুদূরপ্রসারী ছিলো। এ কারণে তিনি নজরুলের কাছে সরাসরি ভাগ্নির বিয়ের প্রস্তাব করলেন। নজরুলের ছন্নছাড়া জীবনে নার্গিস এক টুকরো সুশীতল ছায়ার মতো ছিলো। তার প্রথম প্রেমও। এবং নজরুলের প্রেমও ছিলো বাঁধনহারা। তাঁর স্বভাবটাই প্লাবনের মতো। যখন কারো প্রেমে পড়তেন তখন সবকিছু উজাড় করে সর্বস্ব দিয়ে তাকে ভালোবাসতেন। না লোকলজ্জা, আর না দুনিয়াদারির ভয়। সুতরাং নার্গিসকে বিয়ে করার ব্যাপারে নজরুলের অমতের প্রশ্নই আসে না।

নজরুল নার্গিসকে কতোটা ভালোবেসেছিলেন তার একটা পরিমাপ পাওয়া যায় দৌলতপুরে অবস্থানকালীন তার রচিত গান ও কবিতার সংখ্যা দেখে। কুমিল্লার দৌলতপুরে সময়ে তিনি নার্গিসকে নিয়ে ১৬০টি কবিতা এবং ১২০টি গান রচনা করেন। বলাই যায়, এমন অন্তর্ভেদী গান-কবিতার অর্চনা শুনে নার্গিসের মতো সদ্য কৈশর পেরুনো গ্রাম্যবালিকার পক্ষে ইমপ্রেস হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তিনিও বিয়েতে রাজি।

তিন

১৭ জুন ১৯২১ মোতাবেক ৩ আষাঢ় ১৩২৮।

নির্দিষ্ট দিনে কবির বিয়ের সানাই বেজে উঠলো। কবির পক্ষ থেকে তার একান্ত কাছের দু-চারজন বন্ধু এসেছেন বরপক্ষ হয়ে। বাদবাকি মেয়েপক্ষের আত্মীয় স্বজনই সব। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো। নজরুল-নার্গিস দুজনই বিভোর হয়ে আছেন অনাগত রাত্রির প্রতীক্ষায়। সকল জড়তা ডিঙিয়ে কাছে পাবার আকুলতা দুজনকেই আন্দোলিত করছিলো ভেতরে ভেতরে।

সমস্যাটা হলো বিয়ে পড়ানোর সময়। অবশ্য এটা কেবলই ধারণাগত। কেননা সমস্যাটা কোথা থেকে শুরু হয়েছিলো এবং মূলত সমস্যাটা কী ছিলো— এ ব্যাপারে আজ পর্যন্ত কোনো সুরাহা মেলেনি। না নজরুল কখনো খোলাখুলি কাউকে বলেছেন, না নার্গিস কখনো আলাপ করেছেন।

যাকগে, বিয়ের কাবিন লেখার সময় কাবিননামায় নাকি পাত্রীপক্ষ থেকে দুটো শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছিলো। শর্ত দুটোর ব্যাপারে নানাজন নানা কথা বলেছেন। তবে অধিক নির্ভরযোগ্য যেটা প্রণিধান করা হয়— ১. নজরুলকে বিয়ের পর দৌলতপুরের বাড়িতেই ঘরজামাই থাকতে হবে; ২. নজরুলের আগামী বইগুলো আলী আকবর খানের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাপতে হবে।

মানুষ হিসেবে নজরুল একেবারেই স্বাধীনচেতা। কারো বাঁধন, আদেশ, শর্ত মানার মতো মানসিকতা তার কখনোই ছিলো না। সুতরাং এমন অপমানজনক শর্ত মানা তাঁর জন্য ছিলো অসম্ভব। আর তাছাড়া এখানে আরেকটি বিষয়ও আলোচনায় আনা প্রয়োজন। বিষয়টি হলো— শর্ত যাই হোক না কেন, সেগুলো বলার মতো পরিবেশ বা স্থান বিয়ের কাবিননামা নয়। নার্গিসের অভিভাবক যারা কবিকে আয়ত্ব করতে এমন কুরুচিপূর্ণ শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন তাদের আসলে ভদ্রোচিত কমন সেন্স থাকা উচিত ছিলো। বিয়ের কাবিননামায় ঘরজামাই থাকার শর্ত কিংবা বইয়ের স্বত্ব প্রদানের শর্ত জুড়ে দেয়া ভব্যতার পরিচায়ক নয়, অপমানজনক তো বটেই। তাছাড়া বিয়েবাড়ির ভরা মজলিসে এমন দাবি তোলাটাও নজরুলের মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর।

এমন অযাচিত শর্তে তার আত্মসম্মানবোধে অহঙ্কারী মন বিদ্রোহ করে উঠলো। বিয়ের আসরে কবুল পড়ে বিয়ে হয়ে গেলো ঠিক কিন্তু কবি শর্তের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করলেন না। বিয়ের আয়োজন শেষ হওয়ার পর তিনি নার্গিসের ঘরে গেলেন। কবির মন এমনিতেই তেতে আছে, কিছুতেই তিনি এমন অপমান মানতে পারছিলেন না। নার্গিসকে রাগতঃ কবি জানালেন বিষয়টি এবং এ-ও বললেন— এ দৌলতপুরে আমি আর আসবো না, জীবনের তরে এখান থেকে চলে যাবো। এখন তোমাকে দুটোর মধ্যে একটা বেছে নিতে হবে— হয় আমাকে না হয় দৌলতপুরকে।

নার্গিসের জন্য এমন শর্ত মানা এক প্রকার দুঃসাধ্য। একদিকে মা এবং মামারাসহ সকল আত্মীয় স্বজন, অন্যদিকে প্রাণের প্রিয়তম নজরুল। তবে সাধারণ বাঙালি নারীর বাইরের কোনো অতিমানবী নন। গ্রামীণ বাঙালি নারীর অবগুণ্ঠনে তিনি বেড়ে উঠেছেন এবং ওই কিশোরী বয়সে তার জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া বেশ কষ্টকর ছিলো। তিনি কান্নাভেজা নতমুখে কবির কাছে আকুতি জানালেন তার সিদ্ধান্ত বদলাবার, কিন্তু কবি অনড়। তিনি চলেই যাবেন।

পরদিন ভোর হওয়ার আগেই কবি নজরুল ইসলাম শশুরবাড়ির কাউকে কিছু না জানিয়ে দৌলতপুর থেকে থেকে নীরবে চলে গেলেন। সেই যে গেলেন এ জীবনে আর এলেন না। না প্রিয়তমা নার্গিসের ভালোবাসার কাছে, না তার কালেমাপোক্ত স্ত্রী সৈয়দা আসার খানমের কাছে। সেই থেকে বহু দেন-দরবার হয়েছে, নার্গিসের অনেক অনুনয় পৌঁছেছে কবির কাছে, তার চিঠি এসে কড়া নেড়েছে কবির ডাকবাক্সে কিন্তু অভিমানী কবি নার্গিসকে আর তার ভালোবাসার আসনে বসাননি।

কথা আর বেশি বলবো না, তবে শেষে যে বিষয়টি আমাকে পীড়ন করে সে বিষয়ে দু’কথা না বললেই নয়। আপনারা জানেন, নজরুল কিন্তু দু’ বছর বাদই কুমিল্লার মুরাদনগরের এক হিন্দু পরিবারে বিয়ে করেন। সে বিয়েটাও এক প্রকার প্রেমের বিয়েই বলা চলে। শ্রীমতি প্রমীলা দেবী ছিলেন তার সে প্রেমিকা। এ নারীর ডাকনাম দুলি থাকলেও নজরুল তাকে ভালোবেসে দোলনচাঁপা নামে ডাকতেন। দোলনচাঁপা নিয়ে অনেক গান-কবিতাও লেখা হয়েছে। একটা স্বতন্ত্র কাব্যগ্রন্থের নামও দোলনচাঁপা রাখেন কবি। মজার ব্যাপার হলো, প্রমীলাদের পরিবারের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয় নার্গিসদের বাড়িতে বেড়াতে এসেই।

যাকগে, কবির ধর্মবোধ বা জাত-পাত নিয়ে অযথা বাগড়ম্বর করা আমাদের সাজে না। আমাদের কথা হলো, কবি যদি আরেকটা বিয়েই করলেন তাহলে নার্গিস কী দোষ করেছিলো তখন? দোষ যদি হয়ে থাকে তো সে দোষে দোষী নার্গিসের পরিবারের লোকজন। নার্গিসের তো সেখানে কোনো দোষ ছিলো না। সবচে বেদনার বিষয় হলো, নজরুল নিজের প্রথম প্রেমের স্মৃতি-সোহাগ জলাঞ্জলি দিয়ে দু বছরের মাথায় প্রমীলাকে বিয়ে করে নিজের পৌরুষত্ব বজায় রাখলেন, কিন্তু নার্গিস দীর্ঘ সতেরো বছর কবির জন্য অপেক্ষা করলেন, যৌবনের সোনালি দিনগুলো পার করে দিলেন কবির দেয়া মাত্র দু মাসের স্মৃতি তর্পণ করে, কবির ভালোবাসা আগলে প্রতীক্ষায় রইলেন দিনের পর দিন— যদি কোনোদিন দুখু মিয়া ফিরে আসে!

না, আমাদের সেই রুটির দোকানের দুখু মিয়া নার্গিসকে আর কোনোদিন মেনে নেননি। কোনোদিন ভুলেও তাকে কাছে ডাকবার প্রয়োজন বোধ করেননি। কবি হিসেবে নজরুল হয়তো নার্গিসের বিরহ আর দীর্ঘ দূরত্ব ছেঁচেই লিখেছেন অনেক কবিতা, তার বেদনায় রচিত অনেক কবিতাই হয়তো কবিকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করেছে প্রেম ও দ্রোহের কবি হিসেবে, কিন্তু ব্যক্তি নার্গিস তো কবিতার ঊর্ধ্বে। তিনি তো কবি নন, বিশ্ববিখ্যাত হওয়ার কোনো উচ্চাভিলাষও তার কখনো ছিলো না। তিনি শুধু নিজের সর্বস্ব দিয়ে নজরুলকে কাছে পেতে চেয়েছিলেন। হোক সে কবি নজরুল কিংবা রুটির দোকানের দুখু মিয়া।

কথা শেষ করার আগে নার্গিসের একটা গান দিয়ে শেষ করছি। এই যাহ! আপনাদের তো বলতে ভুলেই গিয়েছি, নজরুল প্রত্যাখ্যাত হওয়ার বছর চারেক পর নার্গিস ঢাকা এসে প্রাইভেটভাবে পরীক্ষা দিয়ে আই.এ পাশ করেন এবং পরবর্তীতে ইডেন কলেজ থেকে স্নাতকও পাশ করেন। কাব্যচর্চায়ও তিনি যৎসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হন।

১৯৩৮ সালে কবি আজিজুল হাকিমের সঙ্গে বিয়ের পর তিনি ঢাকায়ই বসবাস করতে থাকেন। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের গর্বিত মা হন। ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে তার স্বামী পরলোক গমন করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে অবস্থানরত তার ছেলের কাছে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন। অবশেষে ১৯৮৫ সালের ২ জুন ম্যানচেস্টারেই তিনি মারা যান এবং সেখানে বিদেশ-বিভূঁইয়েই তাকে সমাহিত করা হয়।

নজরুল থেকে অনেক দূরে, বিলেতের কোনো এক নীরব কবরস্তানে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।

নার্গিসের গানটি—

তুমি তো বলেছিলে চিরদিন সাথী হয়ে থাকবে।

কুড়িয়ে পাওয়া এই বনফুল মালা করে রাখবে।

হে পথিক তুমি ভালোবেসে

এই তো তুমি সেদিন জড়ালে এসে

আজ তুমি হায় ছিঁড়িলে বাঁধন

আর কি গো হায় কাছে এসে নাম ধরে ডাকবে?

আমি সূর্যমুখী জাগি তোমার ধ্যানে

ফুটিয়ে ছিলে তুমিই আমায় গানে গানে

সব কিছু আজ ভুলে গেছ জানি

ভুল করে সুরভি কি আর তুমি মাখবে?


নবধ্বনি মে ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত