খলিফা উমর ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু মৃত্যুশয্যায়। গুপ্তঘাতকের খঞ্জরের আঘাতে পেট ও বুকে গভীর ক্ষত নিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করছেন। ছেলে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বাবার মাথা নিজের কোলে নিয়ে বসে আছেন।

এক সাহাবি এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘উমর, মৃত্যুকে কি ভয় পাচ্ছেন?’

উমর শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘না, মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছি না; বরং ভয় পাচ্ছি—মৃত্যুর পর আমার সঙ্গে কী আচরণ করা হবে সেটা চিন্তা করে!’

অধিক রক্তক্ষরণের দরুণ নড়বার শক্তি ছিল না তাঁর শরীরে। ছেলে আবদুল্লাহকে বললেন, ‘আমার মাথাটা নামিয়ে দাও।’

আবদুল্লাহ বাবার মাথা কোল থেকে নামিয়ে নিজের উরুর উপর রাখলেন।

উমর বললেন, ‘এখানে নয়, আমার মাথা মাটিতে রাখো।’

আবদুল্লাহ তাঁর মাথা মাটিতে রেখে দিলেন। উমর মাটিতে নিজের কপাল ঘষে ঘষে বলতে লাগলেন, ‘হায় উমর! তোমার কী হবে যদি মৃত্যুর পর তোমার প্রভু তোমাকে ক্ষমা না করেন!’

এই কথা বলে তিনি অঝোরে কাঁদতে লাগলেন।

এ কথা বলছেন সেই উমর, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম দুনিয়াতে যাঁর জান্নাতের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন।

সেই খলিফা উমর, ফোরাত নদীর তীরে একটি কুকুর অভুক্ত হয়ে মারা গেলে যার দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।

অর্ধ পৃথিবীর শাসক উমর, রোম-পারস্য-আফ্রিকা বিজয়ের সেনাদল পাঠিয়ে যিনি খেজুরগাছের নিচে কাপড় বিছিয়ে ঘুমিয়ে থাকতেন।

সেই উমর, পরবার মতো যাঁর একটার বেশি কাপড় ছিল না। তাঁর মেয়ে উম্মুল মুমিনিন হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা একবার কয়েকজন সাহাবির পরামর্শে তাঁকে বলেছিলেন, ‘আব্বাজান, আমিরুল মুমিনিন হিসেবে আপনার উচিত আরেকটু ভালো পোশাক পরা।’

এ কথা শুনে রাগে উমরের চেহারা লাল হয়ে গিয়েছিল। মেয়েকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমাকে এমন কথা বলার জন্য কে পাঠিয়েছে? নাম বলো তার, পিটিয়ে আমি তার পিঠের চামড়া তুলে নেবো!’ এরপর তার চোখে পানি চলে এসেছিল। তিনি মেয়েকে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর রাসুলের পরবার মতো একটার বেশি পোশাক ছিল? সারা জীবনে তিনি দিনে একবারের বেশি পেটপুরে খেয়েছেন কখনো? তাহলে আমি কে?’ এ কথা বলে তিনি কাঁদতে কাঁদতে চলে গিয়েছিলেন।

খলিফা উমর, যাঁর ইনসাফ ও ন্যায়বিচারে ইতিহাসের মানদণ্ড নির্ধারিত হয়েছে। রাসুল বলে গিয়েছিলেন, আমার পরে কেউ নবী হলে সে হতো উমর!

আরেকবার ভরা মজলিসে উমর এবং আবু বকরের হাত দুপাশ থেকে ধরে রাসুল বলে গিয়েছিলেন, কিয়ামতের দিন আমি আবু বকর ও উমরকে নিয়ে এভাবেই উঠব।

আজ মৃত্যুর সময় সেই উমর নিজের আখেরাত নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। আল্লাহর হিসাবের ভয়ে কম্পিত তাঁর হৃদয়—না জানি আল্লাহ তাঁর সঙ্গে কী আচরণ করেন!

বর্তমান পৃথিবীর মুসলিম শাসকেরা, আল্লাহকে ভয় করুন। আপনার অধীনস্থ প্রত্যেক নাগরিকের ব্যাপারে আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিটি পয়সার ব্যাপারে আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আপনার অধীনস্থ প্রত্যেকজন মন্ত্রী, এমপি, সচিব, মহাপরিচালক, জেলা প্রশাসক, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান-মেম্বার, প্রতিটি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর হিসাব নেওয়া হবে। রাষ্ট্রের প্রতিটি আইনের হিসাব নেওয়া হবে, প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পের হিসাব নেওয়া হবে, প্রতিটি টেন্ডার আর রাষ্ট্রীয় বরাদ্দকৃত পাই পাই অর্থের হিসাব নেওয়া হবে। জনগণের সেবার নামে যত অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে, ট্যাক্স, কর, সার্ভিস চার্জ, ভ্যাটের মাধ্যমে যত অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে এবং সেগুলো কোথায় কীভাবে খরচ করা হয়েছে, নাকি আত্মসাৎ করা হয়েছে—সেগুলো প্রতিটি কানা-কড়ির হিসাব আল্লাহ তাআলা সর্বাধুনিক অ্যালগারিদমের মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সংরক্ষণ করে রাখছেন। সকল তথ্য হাজার মেগাপিক্সেল ক্যামেরায় লাইভ ধারণ করে সুরক্ষিত ডাটা সেন্টারে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সুইপার-পিয়ন পর্যন্ত কেউ বাদ যাবে না আল্লাহর নজরদারি থেকে। এক পয়সার জুলুম, এক টাকার দুর্নীতি, এক আনার অবৈধ উপার্জন—আল্লাহর হিসাব থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। প্রতিবছর হজ্জ করেন উমরা করেন, বাড়িতে মসজিদ-মাদরাসা বানিয়ে আল্লাহওয়ালা হন, দান-সদকা করে দানবীর হয়ে যান; কিন্তু কোনো বান্দার একটি টাকা আপনি জুলুম করে আয় করেছেন, জনগণের প্রাপ্য হকের টাকা অবৈধভাবে আত্মসাৎ করেছেন—ওই টাকার পাপ কোনোদিন ক্ষমা হবে না, যদি না ওই সমস্ত জনগণ আপনাকে ক্ষমা করে যাদের টাকা আপনি আত্মসাৎ করেছেন।

আপনি মন্ত্রী-এমপি বা সচিব, কিংবা সরকারি অফিসের প্রধান কর্মকর্তা, আপনার অধীনস্থ প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর অবৈধ উপার্জন ও দুর্নীতির হিসাব আপনাকে দিতে হবে।

শাসক হওয়া আল্লাহর অনেক বড় নেয়ামত। ন্যায়পরায়ণ শাসকগণ কেয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান পাবেন। একজন ন্যায়পরায়ণ শাসকের একটা কথার মাধ্যমে সারা দেশের মানুষ উদ্বুদ্ধ হতে পারে। তার একটা উপযোগী সিদ্ধান্তে একটি জাতির ভাগ্য বদলে যেতে পারে। যদি সেই শাসক আল্লাহর ভয় এবং পরকালের জবাবদিহিতার কথা স্মরণ রেখে দেশ পরিচালনা করেন।

আউফ ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, “তোমাদের মধ্যে উত্তম শাসক ও নেতা তারা যাদেরকে তোমরা ভালোবাসো এবং তারাও তোমাদেরকে ভালোবাসে, তারা তোমাদের জন্য দোয়া করে, তোমরাও তাদের জন্য দোয়া করো। অপরদিকে তোমাদের মধ্যে মন্দ ও নিকৃষ্ট শাসক তারা যাদেরকে তোমরা ঘৃণা করো এবং তারাও তোমাদেরকে ঘৃণা করে, তোমরা তাদের প্রতি অভিসম্পাত করো এবং তারাও তোমাদের প্রতি অভিসম্পাত করে।” (সহিহ মুসলিম)