সেদিন পল্টন থেকে গাবতলী আসছিলাম। বিআরটিসির দোতলা বাসে চড়েছি। দোতলা বাসে উঠা মানে দোতলায় বসা, ভীড় কম থাকে। সেদিনও ভীড় কমই ছিলো, তবে শাহবাগের পর এসে ভীড় বাড়তে লাগলো।

আমার সামনের সিটটা খালিই ছিলো এতোক্ষণ। কাওরান বাজার থেকে একজোড়া যুবক-যুবতী উঠে সিটটায় বসে পড়লো। ছেলেটা লম্বা তবে যথেষ্ট কালো। মুখে ব্রণের দাগ। মেয়েটার চেহারা দেখতে পারিনি তবে একটু খাটোর দিকে এবং একটু মোটাও। যাক, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার কাজ নিরুপদ্রবে বাড়ি ফেরা।

কিন্তু আমার যাত্রা আর নিরুপদ্রব রইলো না। সামনে বসা যুবক-যুবতী সিটে বসার পর থেকেই নানা অসভ্যতা শুরু করে দিলো। তাদের সে অসভ্যতা দেখে বমি আসতে চাইলো। যুবকটি বারবার মেয়েটির শরীরের নানা জায়গায় হাত দিচ্ছে, কখনো জড়িয়ে ধরছে, কখনো মাথা টেনে বুকে নিছে, মেয়ের খিলখিল হাসি… কী অবস্থা! তাদের এমন অসভ্যতা দেখে নিজেই নিজের কাছে লজ্জা পেলাম। চোখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না সামনের সিটের দিকে। বাইরেও বেশিক্ষণ তাকানো যায় না, জ্যামের মধ্যে একদিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ঘাড় ব্যথা করে। কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকাই, কিছুক্ষণ বাইরে। অথচ তারা ছিলো নির্বিকার। নিজেরা নিজেদের নোংরামি করেই যাচ্ছে।

এমন যদি হতো, ছেলেটি মেয়েটির অনিচ্ছায় তার শরীরে হাত দিচ্ছে- তাহলে হয়তো এটাকে নারী নির্যাতন বলা যেতো। কিন্তু মেয়েটি ছেলেটির কার্যকলাপে বেশ আমুদই পাচ্ছিলো মনে হয়। হেসে হেসে গড়িয়ে পড়ছিলো ছেলেটির গায়ে। নানারকম নখরা করছিলো দুজনে মিলেই।

যদি তারা স্কুলের টিনএজ পোলাপান হতো, যৌনতা বিষয়ে যারা অদম্য কৌতূহলী, তাহলেও একটা কথা ছিলো। কিন্তু এ যুবক-যুবতী মোটেও টিনএজ ছিলো না। দুজনের বয়সই ২৪-২৫-এর কম হবে না। তার ওপর তাদের দেখে কোনো ভার্সিটি বা কলেজের স্টুডেন্টই মনে হয়েছে। হাতে বই-কাগজ ছিলো। একদম যে বস্তির ছেলেমেয়ে বা নিম্নবিত্ত পরিবারের, তাদের দেখে তা মনে হয়নি। পোশাক-আশাকে দুরস্তই মনে হলো। আমি ভেবে পেলাম না, এমন লোকসম্মুখে তারা এসব কীভাবে করতে পারে! সাধারণ একটা চক্ষলজ্জু তো থাকবে। শিক্ষিত ছেলেমেয়ে, তাদের দ্বারাই যদি এমন অভব্য কাণ্ড হয়, এ বাংলাদেশে বস্তির লোকদের পতিতাবৃত্তির জন্য দোষ দেই কোন আক্কলে?

আরেকটা বিষয় দেখে আমি হতবাক হলাম, তাদের চারপাশের প্রতিটা সিটে লোক বসে আছে। দাঁড়িয়েও আছে অনেক লোক। এমনকি তাদের ঘাড়ের ওপর দু-তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। সেদিকে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। বিআরটিসির বাস মাত্রই প্লাস্টিকের স্লিম সিট। এগুলো উপরের দিকের আয়তনও কম হয়। অন্যান্য বাসের মতো গদিমোড়া নয় যে চিপায় চাপায় হাতাহাতি করবে…। তাদের নির্লজ্জতা দেখে না কিছু বলতে পারছি না সইতে পারছি। অন্যদেরও একই অবস্থা…। আবার তারা দুজন ছাত্র বলে সাধারণ মানুষও কিছু বলছে না। কেননা বাংলাদেশে ভার্সিটির ছাত্রদের দু’কথা বলতে যাওয়া মানেই তো রাস্তায় দশ-পনেরোটা গাড়ি ভাঙচুর!

এটা ভাদ্র মাস। এই নির্লজ্জ ছেলে-মেয়ে দুটোকে দেখে কামতাড়িত পাশবিক কুকুর ছাড়া আমার আর কিছুই মনে হয়নি। মেয়েটির জন্য আমার করুণাই হলো— আহা! নিজেকে কেমন সস্তায় বিকিয়ে দিচ্ছে লালাতুর ছেলেদের কাছে। তাও এমন নির্লজ্জভাবে!

মেয়ে—
তোমার যে প্রেমিক রিকশায় বসে সুযোগ পেয়েই হুড তুলে তোমার শরীরে হাত দিচ্ছে— মনে রেখো, সে এ কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। পূর্বের সম্পন্ন অভিজ্ঞতা ছিলো বলেই আজ সে নির্দ্বিধায় তোমার দিক হাত বাড়াতে সাহস পেয়েছে। কাল সে আরও সাহসী হবে, কাল তোমার অগোচরে রিকশার হুড ‍তুলে আরেকজনের শরীরে হাত দেবে।

মেয়ে—
আজ যে ছেলে বাসে বসে সবার সামনে তোমার শরীরে হাত দিচ্ছে, তার চারিত্রিক ওজনটা তোমার সাধারণ বিচার-বুদ্ধি দিয়ে মেপে দেখো— চরিত্রের পাল্লায় তাকে একজন চরিত্রহীন ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। এমন একজন চরিত্রহীনের সঙ্গে নিজের জীবন কোন সাহসে জড়াবে, সে প্রশ্ন তোমার কাছেই তোলা রইলো।

মেয়ে—
যে ছেলে ঝোঁপের আড়াল পেলেই কামতাড়িত হয়ে তোমার শরীরে হামলে পড়ে, তাকে তুমি প্রেমিক বলো কীভাবে? সে তো কামতাড়িত একটা পশুমাত্র। সে বারবার শুধু ঝোঁপ খুঁজে বেড়াবে, কখনো ঘর-সংসার খুঁজবে না।

মেয়ে—
যে ছেলেকে আজ একমাত্র পুরুষ বলে বিশ্বাস করে সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়ার ‘মহান উদারতা’ দেখাচ্ছো, একবার কি ভেবেছো সে ছেলে তোমাকে কী ভাবছে? সে তোমাকে একটা সস্তা, চাইলেই পাওয়া যায়, কামনা মেটানোর সহজ মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই ভাবছে না।

মেয়ে—
পুরুষ ‘জিনিসটা’ স্বামী হিসেবে তুমি যা ইচ্ছা তাই তাকে তৈরি করতে পারো, কিন্তু প্রেমিক হিসেবে তাকে একজন ‘কামপাগল’ ছাড়া আর কিছুই বানাতে পারবে না। কারণ সে তোমার শরীর আর রূপ-লাবণ্য দেখে তোমার প্রেমে পড়েছে, তোমার ‘তুমি’কে দেখে নয়।