এবার ধানের ফলন বেশ ভালো। অন্তত গতবারের চেয়ে এ বছর ইরি মৌসুমে ধানের ফলন ভালো ছিল। গত বছর ইরি ধানে বেশ চিটা হয়েছিল, কিন্তু এবারকার ধানে চিটার পরিমাণ কম। হলদে পাকা ধানে ইতোমধ্যে কৃষকের গোলা ভরে উঠেছে। একে তো রমজান মাসে এসেছে ইরি ধান কাটার মৌসুম, তার ওপর বৈশাখী ঝড় আর বৃষ্টির তোড়ে ধান ঘরে তুলতে কিছুটা ঝক্কি গেলেও ধানের ফলনে কৃষক একেবারে নাখোশ নয়।

সর্বোপরি করোনা মহামারী নিয়ে নাগরিক শিক্ষিত মানুষের মতো গ্রামের কৃষকরাও নিদারুণ দুশ্চিন্তায় ছিল। এই মহামারীর সময়ে মরার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো ধানের ফলনে যদি বিঘ্ন হয় তাহলে মাথায় হাত দেয়া ছাড়া উপায় থাকত না। একে তো দীর্ঘকালীন লকডাউনের ফলে অর্থনীতি ও বাজারব্যবস্থা প্রায় ধসে পড়েছে, ফসলের মাঠেও যদি সে প্রভাব পড়ত তবে দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষ বা আকালের সম্ভাবনা ছিল। খোদার শোকর, আল্লাহ অন্তত আমাদের কৃষি এবং কৃষকদেরকে এখনও কর্মঠ রেখেছেন।

এ কথা সত্য, শহরে চাকরিজীবী মানুষের মাঝে মহামারী এবং লকডাউন যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, সে অনুপাতে গ্রামের পরিস্থিতি খানিকটা ভালো। মানুষের মধ্যে মহামারী নিয়ে শংকা আছে বটে তবে না খেয়ে মরার ভয় নেই। অন্যদিকে শহরে বায়ু দূষণ, পরিবেশ দূষণ, দূষিত পানি ও দূষিত নগরব্যবস্থার ফলে সেখানে করোনার প্রাদুর্ভাব অধিক লক্ষণীয়। নাগরিক খাদ্যব্যবস্থাও শহরের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করার অন্যতম অনুঘটক। এসব দূষণের ফলে শহরের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আশংকাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু গ্রামের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই বেশি। তেমনি যেকোনো বিরূপ পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রকৃতির মতো তাদের মনোবলও দৃঢ়।

 

দুই

মহামারীর ফলে মাদরাসাগুলো বন্ধ আছে প্রায় তিন মাস ধরে। মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক সবাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি দিয়ে যার যার বাড়িতে চলে গেছেন। মাদরাসাগুলো বন্ধ হওয়ার ফলে শিক্ষকদের আয়ের উৎসও বন্ধ হয়ে গেছে। অধিকাংশ মাদরাসাশিক্ষকের এটিই একমাত্র আয়ের উৎস। সেই একমাত্র উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা কীভাবে দিন গুজরান করছেন, সেটি ভাবতেই কষ্ট লাগে। তারা সমাজের সম্মানীয় ব্যক্তি, কারো কাছে নিজের অভাব বা প্রয়োজন প্রকাশ করতে চক্ষুলজ্জা স্বাভাবিক বিষয়। অন্যদিকে পরিবারের ভরণ-পোষণে চোখের পানি ছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। অধিকাংশ শিক্ষকই মাদরাসা বা সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো সাহায্য পাচ্ছেন না, এটা বলাই বাহুল্য। এর ওর কাছ থেকে যা-ও সাহায্য পাচ্ছেন, সেগুলোও আহামরি কিছু নয়।

আমার যেটি ধারণা, মাদরাসার শিক্ষক যারা রয়েছেন তাদের অনেকের বাড়িতেই দু-চার দশ কাঠা জমি রয়েছে। অনেকের হয়তো আরও বেশিই রয়েছে। করোনাকালীন সময়টাতে তাই দুশ্চিন্তা নিয়ে বসে না থেকে চাষবাস শুরু করে দিন। পরিস্থিতি যা বুঝা যাচ্ছে, সহসাই এ মহামারীর প্রাদুর্ভাব দূর হবে না। সুতরাং উপার্জনের বিকল্প মাধ্যম হিসেবে কৃষিকে বেছে নেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন।

বর্ষা মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। এ মৌসুমে নানা প্রকার সবজি চাষ করার উত্তম সময়। প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে, এখন যা বুনবেন সেটাই রই রই করে বেড়ে উঠবে। আমাদের পুকুরপাড়ে অল্প কিছু কাঁচা মরিচ, ধুন্দুল, বেগুনের চারা বুনেছি; সেগুলো কয়েকদিনে বেশ বাড় বেড়েছে। তার চেয়েও বেশি বাড়ে নানা প্রকার আগাছা আর লতাপাতা। একদিন-দুদিন পর পুকুরপাড়ে গিয়ে দেখি একেকটি লতা আগের দিনের চেয়ে এক-দুই হাত পর্যন্ত বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের মাটি প্রচুর উর্বর। এই মাটিতে আপনি যা-ই বুনবেন সেটিই ফলবে।

আপনার এলাকায় যে সবজির ফলন ভালো হয় সেটা দিয়ে শুরু করতে পারেন। বাড়ির আশপাশে যতটুকু খালি জমি, বাড়ির ঢাল, দুয়ার, পাগাড় আছে সেগুলো অযথা ফেলে না রেখে সবজির চাষ করুন। নিজের পরিবারের জন্য যেমন উপকার হবে তেমনি উপার্জনের মাধ্যমও হবে। তাছাড়া নিজের চাষ করা সার-বিষহীন সবজি আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। প্রতিদিন কিছুটা শারীরিক শ্রমের ফলে শরীরও থাকবে তরতাজা।

যারা একটু দীর্ঘমেয়াদি কৃষির চিন্তা করছেন তারা থাই পেয়ারার চাষ করতে পারেন। যে জমিতে বর্ষা মৌসুমে পানি জমে থাকার সম্ভাবনা নেই সে জমিতে নির্বিঘ্নে থাই পেয়ারার চাষ করতে পারেন। আপনার নিকটস্থ নার্সারি থেকে ‘ভালো জাতের’ থাই পেয়ারার চারা এনে এখনই রোপন করে দিন। মাত্র মাস ছয়েক পরই দেখবেন এসব চারাগাছে পেয়ারা ধরতে শুরু করেছে। একেকটি পেয়ারার আকার ১০০ গ্রাম থেকে ৪০০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। ২০ থেকে ১০০টি পর্যন্ত পেয়ারা ধরে একেকটি গাছে। এসব পেয়ারা একদম কম হলেও ৩০ টাকা কেজি বিক্রি করা যায়। শহরের দিকে বিক্রি করলে ৫০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।

আরও লাভের কথা হলো, ভালো জাতের থাই পেয়ারার গাছে সারা বছর পেয়ারা ধরে। কীভাবে বুনবেন, কোথায় চারা পাবেন, কীভাবে গাছ ও ফলের যত্ন নেবেন—সবকিছু অনলাইন-ইউটিউবে পেয়ে যাবেন। তাছাড়া নিকটস্থ নার্সারি বা অভিজ্ঞ কারো পরামর্শও নিতে পারেন। বলা যায় না, কিছুদিন পর আপনি হয়তোবা দেশসেরা কৃষক হয়ে যেতে পারেন। শাইখ সিরাজ চলে আসতে পারেন আপনার সাক্ষাতকার নেয়ার জন্য।

 

তিন

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময়কার মদিনা-সমাজ ছিল কৃষিভিত্তিক সমাজ। মদিনার অধিকাংশ অধিবাসী কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। খেজুর ছিল তাদের প্রধান অর্থকরী ফসল। মদিনার চারপাশের উর্বর জমিতে নানা প্রকার খেজুর উৎপাদন করত তারা।  এছাড়া পশুপালনও তাদের আয়ের অন্যতম একটা উৎস ছিল।

অন্যদিকে মক্কার জনপদটি ছিল ‍পুরোপুরি ব্যবসানির্ভর। মক্কার লোকজন হয় নিজেরা ব্যবসা করত, নয়তো ব্যবসায়ীদের কাছে টাকা লগ্নি করে মুনাফা ভোগ করত। গবাদি পশুপালনের কিছুটা রেওয়াজ ছিল সেখানে, কিন্তু কৃষিভিত্তিক কোনো চাষাবাদ বা উৎপাদন তাদের ছিল না। কারণ, মক্কা এবং এর আশপাশের ভূমি ছিল একেবারেই অনুর্বর, চাষাবাদ ও ফসল উৎপাদনের অনুপযোগী।

ফলশ্রুতিতে মক্কার মুসলিমগণ যখন হিজরত করে মদিনায় চলে আসেন, প্রথমদিকে আয়-রোজগারে তাদের বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল। তারা প্রাচীনকাল থেকে বংশানুক্রমে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে অভ্যস্ত, মদিনার কৃষিভিত্তিক সমাজ এবং আয়ের উৎসের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে কিছুটা সময় লেগে যায়। এ কারণেই দেখা যায়, হিজরতের প্রথম কয়েকটা বছর মুহাজির-আনসার সবাইকে দারিদ্রের কষাঘাতে নিষ্পেষিত হতে হয়।

কিন্তু বছর কয়েকের মধ্যে মক্কা থেকে আগত মুহাজিরগণ কৃষিকাজে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং মদিনার কৃষিভিত্তিক আয়-উৎসের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে সক্ষম হন। নবীজির জীবদ্দশাতেই অবস্থাসম্পন্ন মুহাজির সাহাবিগণ মদিনার আশপাশে একাধিক খেজুর বাগানের স্বত্ত্বাধিকারী হন। যাদের খেজুর বাগান কেনার সামর্থ্য ছিল না, তারা খেজুর চাষের যাবতীয় কায়দা কানুন শিখে নেন এবং মজুরিভিত্তিক কৃষিকাজে যুক্ত হন।

 

চার

শিক্ষা কখনোই রোজগারের মাধ্যম নয়। সেই প্রাচীনকাল থেকে শিক্ষা মানুষকে আত্মিক এবং ব্যক্তি পর্যায়ে দীক্ষিত করার মাধ্যমে সমাজকে আলোকিত করে আসছে। এটিই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। কারো চাকরির দায় নেয়া বা রোজগারের সিঁড়ি হওয়া শিক্ষার উদ্দেশ্য নয়। আমরা এখন চাকরিভিত্তিক যে শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত, এর সঙ্গে মৌলিক শিক্ষার আসলে কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা শিক্ষার একটি ভুল বাস্তবতায় জীবনযাপন করছি।

শিক্ষা যে কারো চাকরি বা আয়ের ‘দায়িত্বশীল’ নয়—এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ দিয়েছে ইসলাম। ইসলাম কখনোই জ্ঞানার্জনের সঙ্গে কিংবা ইবাদতের সঙ্গে রোজগারকে একীভূত করেনি। বরং মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে পৃথক আয়ের উৎস সন্ধান করতে। যেমন আল্লাহ কুরআনে সুরা জুমআয় বলেছেন, ‘…তোমাদের নামাজ সমাপ্ত হলে (রোজগারের নিমিত্তে) জমিনে ছড়িয়ে পড়ো।’ নবীজি সা. যখন জ্ঞানার্জনের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন সেখানে তিনি শিক্ষাকে জীবিকা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে নির্ণয় করেননি কখনো। বরং ইবাদত এবং জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি পৃথক রোজগারের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন।

আমরা যদি ইসলামি শিক্ষার ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করি, আমাদের যারা জগদ্বিখ্যাত আলেম, ইমাম বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন তাদের অধিকাংশজনের পঠন-পাঠনের বাইরে আলাদা আয়ের উৎস ছিল। মূলত এমনটিই হওয়া উচিত। এতে করে ধর্মীয় জ্ঞানার্জন যেমন আল্লাহমুখী হয়, তেমনি সামাজিকভাবেও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের প্রভাব অক্ষুন্ন থাকে।

কৃষিকাজ কোনো অসম্মানের পেশা নয়। এ কাজ করলে আলেমের সম্মানহানী হবে, এমন চিন্তাও বোকামি। আমাদের প্রত্যেকজন নবী পশুপালন করেছেন কিংবা কৃষিকাজে যুক্ত ছিলেন। আমাদের পূর্ববর্তী অনেক আলেমও কৃষিকাজের মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কৃষি একটি সম্মানজনক এবং স্বনির্ভর পেশা। নিজে চাষাবাদ করে, নিজে উৎপাদন করে শতভাগ হালাল মাধ্যমে আয়ের উৎস কৃষি। এই আয়ের মধ্যে একটি পয়সা হারামের সম্ভাবনা নেই। এই শতভাগ হালাল উপার্জনের রিজিক উপভোগ করার পর যখন আপনি আল্লাহর সমীপে দুই হাত তুলে মুনাজাত করবেন, সেই প্রার্থনা আল্লাহ নিশ্চয় ফিরিয়ে দেবেন না।