ধর্মীয় মিথ (কল্পকাহিনি, রূপকথা, কিচ্ছা) উপমহাদেশের মানুষের ধর্মপালনের একটা আনুষঙ্গিক বিষয়। ইসলামের সঙ্গে এটা ইসলাম আগমনের পরপরই শুরু হয়েছে। ধর্ম থাকলে মিথ থাকবেই। হোক সেটা ঐশ্বরিক ধর্ম কিংবা মানবরচিত ধর্ম, ধর্মপালনই মানুষের পৃথিবীতে মিথের জন্ম দেয়। পৃথিবীর কিছু ধর্ম আছে যেগুলো কেবলই মিথের ওপর ভর করে প্রতিষ্ঠিত। মিথ দিয়েই তাদের ধর্মের আচরিক সকল যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়।

উপমহাদেশে ইসলামের নামে অসংখ্য মিথ প্রচলিত। কোনোটা কিছু সত্য, কোনোটা আংশিক আর কোনোটা একেবারেই মিথ্যা। সর্বৈব বানোয়াট কল্পকাহিনি। কিন্তু তারপরও এসব মিথ মানুষ বিশ্বাস করে। শুধু বিশ্বাস করে তাই নয়, এসব মিথ দিয়েই তারা ধর্মের বিশ্বাসকে পরিপুষ্ট করে। ধর্মের জন্য এটা দুঃখজনক ব্যাপার। ধর্ম কখনো মিথ্যা কল্পকাহিনির বাতাবরণের ওপর ভর করে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না।

যে কোনো লোকালয়ে মিথ প্রসারের একটা বড় কারণ হলো ধর্মীয় অজ্ঞতা এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের অপর্যাপ্ততা। দুঃখজনকভাবে, ইসলামের প্রাণকেন্দ্র থেকে দূরবর্তী জনগোষ্ঠী হওয়ার দরুণ উপমহাদেশীয় লোকজন এই দুই উপসর্গে প্রবলভাবে সংক্রমিত। আরেকটি কারণ ছিলো- প্রতিবেশী ধর্মের সংক্রমণ। এটা সব অঞ্চলে সব ধর্মের বেলায়ই ঘটে থাকে। এক ধর্মের সঙ্গে আরেক ধর্মের বিশ্বাস ও আচারের মিশেল ঘটে যাওয়া। ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অবধারিতভাবে উপমহাদেশের সনাতনী ধর্মের অনেক আচার ও মিথ মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। দুই ধর্মই একে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে ধর্মীয় লোকজনের অজান্তেই।

হিউম্যান বিং হিসেবে মানুষ মাত্রই গল্প পছন্দ করে। এ কারণে দেখা যায়, নবিদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কথার চেয়ে আমরা নবিদের জীবনের অতিলৌকিক কাহিনি শুনতে ভালোবাসি। ধর্মীয় প্রাজ্ঞজনের জ্ঞানগর্ভ আলোচনার চেয়ে আমাদের ভালো লাগে ধর্মীয় বুজুর্গদের সুপার হিউম্যান গল্প শুনতে। মানুষের প্রকৃতিই এমন, মানুষ গল্পের কাঙাল। তবে নবি কিংবা ধর্মীয় সুপারপাওয়ার ব্যক্তিদের জীবনকে কেন্দ্র করে বাংলাভাষায় তেমন কোনো গল্প-উপন্যাস লেখা হয়নি। কল্পকাহিনি তো প্রচুর আছে, কিন্তু সত্য গল্প বলার গল্পকারের অভাব। ধর্মীয় কল্পকাহিনি নিয়ে অনেক লেখকই লিখেছেন, কিন্তু ধর্মীয় ব্যক্তিগণ যারা সত্য গল্পটা জানেন, তারা কখনো সত্য গল্পটাকে গল্পাকারে মানুষের সামনে পেশ করেননি।

ফলশ্রুতিতে ধর্মীয় কল্পকাহিনিই ধর্মের জায়গা দখল করে নিয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে প্রবল প্রতাপশালী মিথ। গাজী-কালু-চম্পাবতী, বিষাদ সিন্ধুর হায় হোসেন, বড়পীরের কেরামতি, ইউসুফ-জুলেখার প্রণয়, বুজুর্গদের অতিলৌকিক কল্পকাহিনি- সকলই ধর্মের নামে বিরাট বিশাল মিথ হয়ে আছে আমাদের ধর্মীয় মানসে। সাধারণ গ্রাম্য ও ধর্ম-অজ্ঞ মানুষ এ-সবই বিশ্বাস করে। তাদের কাছে এগুলোই ঐশ্বরিক ধর্মের অন্যতম প্রতিনিধি। এসবই ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার আদি ও আসল কাঁচামাল। যদিও বাস্তবিকভাবে তা সত্য নয়।

সুতরাং, আপনার সত্যভাষণ মানুষের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সত্য গল্পটা আপনাকে শক্তিশালী ভাষায় বলতে হবে, কল্পকাহিনির চেয়েও জোরালোভাবে।