প্রকাশকদের কথা বলা যাক। একটি প্রকাশনী যখন কেউ প্রতিষ্ঠা করে তখন তার মাথায় সর্বপ্রথম যে চিন্তাটা কাজ করেÑআমাকে এখান থেকে ব্যবসা করতে হবে। ঠিক আছে, ব্যবসা আপনি করবেন, কিন্তু তাই বলে যাচ্ছেতাই জিনিস ছাপিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? যে প্রকাশক ব্যবসা করার জন্য প্রকাশনী দিয়ে বসেছেন, তিনি বাজার ঘুরে দেখেন কোন বইটা বাজারে বেশি বিক্রি হচ্ছে। সেটা যদি কোনো আরবি-উর্দু বইয়ের অনুবাদ হয় তখন তিনিও নিজের প্রকাশনী থেকে ওই বইটার আরেকটা অনুবাদ বের করেন। যেহেতু কপিরাইট বা মেধাস্বত্ব কী জিনিস, এটা অধিকাংশ প্রকাশকই জানেন না, সেহেতু বাছ-বিচারহীন যে যেভাবে পারছেন বই অনুবাদ করে ছাপিয়ে ব্যবসা করছেন। মানবিচারের প্রশ্ন তো উঠছেই না, অনুমতি ব্যতীত অন্যের বই ছাপিয়ে তাঁরা যে গোনাহর কাজ করছেন, সেই অনুভূতিও কখনো হৃদয়ে উত্থিত হয় না। যেখানে লেখককে সম্মানী দিতে হয় না, সম্পাদনা বা প্রুফ দেখার টাকা দিতে হয় না, সেখানে কেবল লাভই লাভ। কিছু কিছু প্রকাশক এমন ব্যবসাই খুলে বসেছেন বাংলাবাজারে।

বাংলাবাজারের কিছু প্রকাশনী আছে যারা অভিনব উপায়ে জোচ্চুরি করে থাকে। ধরুন, কোনো বই যদি বাজারে খুব কাটতি হয় তখন এক শ্রেণির প্রকাশনী ওই বইটিকে স্ক্যান প্রযুক্তির মাধ্যমে স্ক্যান করে নতুন করে ট্রেসিং করে নিজেরা ছাপে, তবে বইয়ের প্রচ্ছদ এবং লেখক বা অনুবাদকের নাম পাল্টিয়ে সেখানে নতুন লেখকের নাম বসিয়ে দেয়। ব্যাস, একই বই তাঁরা একটু ভিন্ন নামে বিক্রি শুরু করে। পাপ-পুণ্যের বিচার কে করতে যায়!

সম্প্রতি আরও ভয়াবহ কিছু খবর শুনলাম। ধরা যাক বাংলাবাজারের কোনো বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। যারা পাঠ্যবইয়ের নোট-গাইড প্রকাশ করে আবার সাধারণ ধর্মীয় বইও প্রকাশ করে থাকে। বিরাট তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম। সারা দেশের মাঠপর্যায়ের লাইব্রেরিগুলোর সাথে বিশাল নেটওয়ার্ক। প্রতিমাসে কয়েক কোটি টাকার ওপরে তাদের ব্যবসায়িক বিক্রি-বাট্টা।

তো, এই প্রকাশনীর কাজ হলো, বাজারে যেসব বইয়ের কাটতি ভালো তারা সেসব বই বাজার থেকে কিনে এনে স্ক্যানের মাধ্যমে নতুন করে ছাপে। প্রচ্ছদও একই, কোনো পরিবর্তন নেই। এমনকি যে প্রকাশনী বইটি ছেপেছে তারাও ওই প্রকাশনীর নামেই বইটি ছাপে। মোটকথা, ভেতরে-বাইরে একদম হুবহু একই বই তারা নিজেদের প্রেসে দ্বিতীয়বার ছাপে এবং ওই নকল বইটি তাদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সারা দেশে বিক্রি শুরু করে। যারা আসল প্রকাশক তারা ঘুণাক্ষরেও টের পায় না যে তাদের বই নকল হয়েছে। বাজারে তাদের বই ভালো বিক্রি হচ্ছে ঠিকই কিন্তু লাভের পয়সা তার পকেটে না এসে যাচ্ছে নকলবাজের পকেটে। কী অভিনব জোচ্চুরি! অথচ এই প্রকাশনী থেকে কিন্তু কুরআনের তাফসির আর হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থও ছাপা হয়!

এ ধরনের প্রকাশনীর আরেকটি জোচ্চুরি শুনলাম। বাজারের কাটতি বইগুলো কিনে তারা তাদের নিজস্ব কম্পোজারের হাতে দেয়। কম্পোজার পুরো বইটি হুবহু কম্পোজ করে প্রকাশনীর কসাইসম সম্পাদকদের হাতে অর্পণ করে। সম্পাদকদের হাতেই মূলত আসল ম্যাজিক! সম্পাদকগণ কম্পোজকৃত বইটি দ্রুত সম্পাদনা শুরু করেন। এসব সম্পাদনার কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। সম্পাদক প্রতি পৃষ্ঠার প্রতিটি প্যারার প্রথম এবং শেষ লাইন পরিবর্তন করে পুরো বইটিকে নতুন করে রচনা করেন। বইয়ের নাম ও লেখক-অনুবাদকের নাম পরিবর্তন করে সেখানে নতুন নাম বসিয়ে নতুন বই বাজারে ছাড়া হয়। আসল প্রকাশনী যারা তারা যদি বইটি দেখে নকলের অভিযোগ আনে তবে নকল প্রকাশনী বলে, না, দুটো বইয়ের লেখা একেবারেই ভিন্ন, একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো মিল নেই। আসল প্রকাশকের নিজের চুল ছেঁড়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না তখন।