একসময় ফেসবুকে খুব সিরিয়াস বিষয় নিয়ে লিখতাম। ধর্ম-দর্শন-ইতিহাস বা রাজনীতির নানা নাচন-কুর্দনধর্মী লেখার একটা প্রবণতা ছিল তখন। যারা পোস্টের কমেন্টে বিতর্ক করার তোড়জোড় করত তাদের সঙ্গে ধুন্ধুমার লেগে যেতাম, ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। বয়স কম ছিল, এসবকে নিজের একটা আবশ্যিক দায়িত্ব মনে করতাম। সর্বোপরি, অনলাইনে ইসলাম রক্ষার বিরাট দায়ভার তো আমার কাঁধেই অর্পিত!

কিন্তু আমি একটা সময়ে এসে বুঝতে পারলাম, ফেসবুকে এসব লেখাজোকা নানাজনকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে, কাউকে পজেটিভলি কাউকে নেগেটিভলি। দেখলাম, অনেকে ফেসবুকের এসব পোস্টকে কেবল ফেসবুকীয় কথাবার্তা না ভেবে বিশ্বাসের কাতারে ফেলছে, অনেকে সেগুলো অনুসরণে ব্রতী হচ্ছে, কেউ আবার এসবকে নতুন কোনো দর্শনীয় চিন্তা মনে করে ভুল বার্তা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। অন্যদিকে যারা আমার লেখার বিরোধিতা করছে তারাও হয়তো ভিন্নমত পোষণের কারণে আমাকে শত্রুজ্ঞান করছে, কিংবা আমাকে ভিন্ন মতাদর্শী ভেবে বান্ধবসমাজে বিষোদ্গারে লিপ্ত হচ্ছে; যেটি তার জন্যও গোনাহ’র কারণ, আমার জন্যও দুঃখজনক সংবাদ।

এই অভিজ্ঞতা আমার জন্য ছিল বেশ বেদনাদায়ক। এরপর থেকে চেষ্টা করি ফেসবুকের মতো হাট-বাজারে সিরিয়াস কথার প্যাচাল না পারতে। কী দরকার মানুষের চিন্তাকে অযথা উত্তেজিত করার? কেন আমার কথায় হতাশার জালে আটকে যাবে একজন তরুণের হৃদজগত? আমার নিজস্ব চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে আরেকজন মানুষের চিন্তাজগতকে বিকারগ্রস্ত করার অধিকার তো আমার নেই। ইসলাম সেই অধিকার কাউকে দেয়নি। বিচার বিভাগে কথিত একটি বাণী আছে—‘আইনের ফাঁক গ’লে দশজন অপরাধী শাস্তি থেকে রেহাই পেলেও একজন নিরপরাধ যেন শাস্তি না পায়।’

সুতরাং দেশ ও জাতির বৃহত্তর উপকার করার ‘মহান’ ব্রত পালন করতে গিয়ে আমি চাই না আমার কথায় একজন কোমলমতি তরুণের জীবনও যেন ঝুঁকিতে পড়ুক।

 

দুই

অনলাইন বা ফেসবুকে যারা নানা গুরুগম্ভীর এবং তর্ক-বিতর্কমূলক লেখালেখি করেন, তাদের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে সমাজের উঠতি হাজার তরুণের মনে নানা ধরনের ডিপ্রেশন তৈরি হয়। আপনি বিতর্ক করছেন, রাজনীতি বা ধর্মের কোনো বিষয়ে তুবড়ি ছোটাচ্ছেন; আপনার কাছে এগুলো নিছকই কোনো লেখা বা বিতর্ক মনে হতে পারে, কিন্তু অন্তরালে এসব লেখা বা চিন্তা বহু তরুণের মনমগজকে বিরূপভাবেও প্রভাবিত করে।

আপনি অনেক সময় ধর্ম-রাজনীতি বিষয়ে এমন এমন কথা বলেন যেগুলো দ্বন্দ্ব উস্কে দেয়, কলহ সৃষ্টি করে, পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ বৃদ্ধি করে; এগুলো করে আপনি নিজেকে পণ্ডিত ভাবেন, সেলিব্রেটি হিসেবে নিজেকে জাহির করার গোপন অভীপ্সা থাকে। কিন্তু আপনার এসব লেখা আপনার অজ্ঞাতে অনেক তরুণকে ডিপ্রেশনে ভোগায়, তার চিন্তাকে সংক্ষুব্ধ করে কিংবা তাকে হতাশায় ম্রিয়মান করে তোলে। মনে রাখবেন, আপনার পাণ্ডিত্য প্রকাশের চেয়ে মানুষের জীবন অনেক বেশি মূল্যবান। সেলিব্রেটি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেয়ে একজন মুসলিম তরুণের মনোজাগতিক স্বাধীনতা অবশ্যই জাতির জন্য অধিক জরুরি।

খেয়াল করে দেখবেন, আপনার লেখাটি নিজস্ব চিন্তাধারার ১০ জন ব্যক্তি গ্রহণ করতে পারলেও ভিন্ন চিন্তার দুজন হয়তো গ্রহণ করতে পারবে না। এই দুজনের মনে এই লেখা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। পরবর্তীতে এমন আরও দু-চারটে লেখা হয়তো তারা ফেসবুকে দেখবে, প্রতিটি লেখাই তাদের মনোজগতকে প্রভাবিত করবে। এই বিরূপ প্রভাব ধীরে ধীরে তাদের মনের মধ্যে বিষম একটি অবস্থার তৈরি করবে। সেখান থেকে তৈরি হবে হতাশা, হীনম্মন্যতা, বীতশ্রদ্ধা, সমাজকে অবজ্ঞা করার মানসিকতা। যার কোনোটিই মানবিক সমাজের জন্য উপকারী নয়।

আজকের বীতশ্রদ্ধ, সংক্ষুব্ধ, হতাশাগ্রস্ত, মান্যতাহীন, বিতর্কপ্রিয় যে তরুণদের আমরা দেখতে পাই অনলাইনে, তাদের সৃষ্টি একদিনে হয়নি। আপনার আমার মতো সেলিব্রেটি বীরপ্রবর লোকজনই এই সংক্ষুব্ধ তরুণদের সৃষ্টি করেছে এবং করছে। আপনি জাতির পথপ্রদর্শক হিসেবে সহস্র জনকে পথের দিশা দিতে ময়দানে আবির্ভুত হয়েছেন ঠিক, কিন্তু আপনার কারণে আরও শত শত তরুণ ধর্ম-দুনিয়ার ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে গভীর ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে, সে খবরও হয়তো আপনার নেই।

সুরা বাকারার ১১ নং আয়াতটি স্মরণ করুন, ‘যখন তাদেরকে বলা হয় তোমরা দুনিয়াতে বিশৃঙ্খলা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে, আমরা তো (সমাজ) শুদ্ধ করছি।’

আমি এমন অনেক তরুণকে দেখেছি যারা ধর্ম নিয়ে লোকজনের বিবাদ বিতর্ক অসহিষ্ণুতার ফলে ধর্মের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে গেছে, ধর্মের পথ থেকে বিচ্যুতই হয়ে গেছে। এমনকি অনেককে গভীর ডিপ্রেশনে ভুগতে দেখেছি। তারা চিন্তা করে কূল পায় না—ধর্মকে পুঁজি করে ধর্মবেত্তাদের মাঝেই যদি এত ঝগড়া-বিবাদ থাকে তাহলে মানুষ ধর্মের জন্য যাবে কার কাছে?

মানুষকে ধর্ম থেকে বিচ্যুত করা নিশ্চয় কোনো দাওয়াতি আন্দোলন হতে পারে না।