আমার এক বন্ধু বছরখানেক আগে ইন্ডিয়া ঘুরে এলো। ট্রেনে বিস্তর সফর। কলকাতা হয়ে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব হয়ে কাশ্মির। সে তার কলেজ থেকে সহপাঠী এবং শিক্ষকদের সঙ্গে একটা শিক্ষাসফরে গিয়েছিলো। ফিরে আসার পর তার ভারতভ্রমণ সম্পর্কে জানতে চাইলাম- কেমন লাগলো ভারত? সে বললো, সবচে ভালো লেগেছে কাশ্মির। সত্যিই অসাধারণ এক ভূস্বর্গ। আর খারাপ লেগেছে কোন জিনিসটা? সে মুখ কুঁচকে বললো, ভারতজুড়ে প্রচুর দুর্গন্ধ। আমি কপাল কুঞ্চন করে জিজ্ঞেস করলাম, দুর্গন্ধ কা মতলব কেয়া হ্যায়? সে নাক-মুক কুঁচকানো অবস্থাতেই বললো, কলকাতা থেকে কাশ্মির পর‌্যন্ত যতোগুলো স্টেশনে ট্রেন থেমেছে, প্রতিটা স্টেশনে বিরাট দুর্গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিয়েছে। প্রথম প্রথম দু-একটা স্টেশনে ব্যাপারটা হালকাভাবে নিয়েছিলাম, পরে দেখি প্রতি স্টেশনেই এমন দুর্গন্ধ। শেষমেশ তদন্ত করতে গিয়ে ট্রেনের জানালা দিয়ে ভালো করে বাইরে তাকিয়ে দেখি, বাবুমশাইরা কাপড় উঁচু করে স্টেশনের পাশে বসে ভাবুক মনে হাগু করছে। এতোক্ষণ খেয়াল করিনি বিষয়টা, এ দৃশ্য দেখার পর ট্রেনের জানালা দিয়ে যখনই বাইরে তাকিয়েছি তখনই ট্রেন লাইনের পাশে দু-চারজন বাবুমশাইকে ‘ভাবুকচিত্তে’ বসে থাকতে দেখেছি। এমনকি বহু নারীকেও দেখেছি মাঠে উদোম হয়ে পুরুষের পাশাপাশি বসে গালগপ্পো করতে করতে এ কর্ম সমাধা করছে…!

পাঠক জেনে অবাক হবেন, ভারতের শতকরা ৫৭ ভাগ মানুষ খোলা ময়দানে প্রাকৃতিক কর্ম সমাধা করে। তারা সবাই যে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে, ব্যাপার কিন্তু এমন নয়। গ্রামের ধনী-গরিব সকলেই এমন হাগুকর্মে শামিল। এটা তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে গেছে। ঘরে নির্মিত বাথরুমে কিছুতেই তাদের উদ্বুদ্ধ করা যায় না। আসলে ঘরে তারা বাথরুম তৈরির প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করেনি কখনো।

ভারত সরকার আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার সহযোগিতায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। ভারতীয় সরকার সিনেমা, টিভি, পোস্টার, সামাজিক সচেতনতা, র‌্যালির ম্যাধ্যমে নানা কর্মসূচি পালন করছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না, ময়দান থেকে বাবুমশাইদের বাথরুমমুখী করা যাচ্ছে না।

সম্প্রতি ভারতের সুপারস্টার অক্ষয় কুমার অভিনীত একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। সিনেমার নাম ‘টয়লেট এক প্রেমকথা’। সিনেমায় দেখানো হয়- অক্ষয় কুমার নায়িকা ভূমি পেডেনকারের প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করতে উদ্যোগী হন। সবকিছু ঠিকঠাক, কিন্তু নায়িকা যখন জানতে পারেন অক্ষয়দের গ্রামে হাগুকর্মের জন্য কোনো টয়লেট নেই তখন তিনি বেঁকে বসেন। জানিয়ে দেন, যে পর্যন্ত তাদের গ্রামে পর্যাপ্ত বাথরুম তৈরি না করা হবে সে পর্যন্ত তিনি তাদের গ্রামে পা রাখবেন না।

এ নিয়েই তৈরি সিনেমার কাহিনি।

 

দুই

এই ‘ময়দানমুখী’ ভারত বাইরের পৃথিবীর কাছে ততোটা পরিচিত নয়। এর একটা বড় কারণ হলো, পৃথিবীর সামনে ভারতকে তার সুপারপাওয়ার তকমা ঝুলিয়ে রাখতে হয় তার সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে। তাকে বিশ্বের দরবারে জানাতে হয়- আমি অনেক শক্তিশালী দেশ। আমার বিশাল ম্যানপাওয়ার আছে, আমার মুম্বাই-চেন্নাই ঝা চকচকে সিলিকন টাউন দিয়ে সজ্জিত। কিন্তু সত্যিকারের মাদার ইন্ডিয়ার দেখা পাওয়া যায় শহরের চকচকে নিয়ন আলো ছেড়ে একটু বাইরে বেরুলেই। লাইনকে লাইন বাবুমশাইরা গোল হয়ে বসে প্রাকৃতিক কর্মসাধনে ব্যস্ত এবং এর মধ্যেই আলাপ করছে রাজনীতির বিভিন্ন জটিল ধারাপাত নিয়ে। ওটাই মূলত আদি ও আসল ইন্ডিয়া। ভারতমাতা কি জায়!

 

তিন

যদিও ভারতের ঘরে ঘরে টাট্টি না থাকুক কিংবা ভারতের কৃষক না খেয়ে আত্মহত্যা করুক, ভারতকে কিন্তু বিশ্ব দরবারে প্রতিনিয়ত বলতে হচ্ছে ‘…ভারত ভাগ্যবিধাতা’। এটা ভারতের অস্তিত্বের প্রশ্ন, নইলে ভারতের স্বাধীনতাই ভঙ্গুর হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, ভারতের ২৯টি রাজ্যকে দিল্লির কেন্দ্র থেকে প্রতিনিয়ত একীভূত রাখতে হয়। এই একীভূত প্রক্রিয়ায় প্রতিদিন তাদের নিত্যনতুন উপায় ও অস্ত্র তৈরি করতে হয়। নইলে কাল ঝাড়খণ্ডে বিদ্রোহ শুরু হবে, পরশু উত্তরখণ্ডে নয়তো নাগাল্যান্ড বা কাশ্মির।

চিন্তা করতে পারেন! যে দেশের লোকজন বাথরুমে হাগতে শিখেনি তাদের পারমাণবিক বোমার কী দরকার? আগে তো দেশের মানুষকে হাগতে শেখাতে হবে, পরে না যুদ্ধ-যুদ্ধাস্ত্র! কিন্তু ভারত অত্যন্ত সুচতুর, তারা ভারতীয় জনতার মাথার উপর বিরাট বিরাট অ্যাটম বোম্ব ঝুলিয়ে রেখেছে, অগ্নি ক্ষেপণাস্ত্র সাজিয়ে রেখেছে, জলের তলে ইসরাইলি সাবমেরিন বসিয়ে রেখেছে…। যাতে করে ভারতবাসী আত্মতৃপ্ত হতে পারে- হামারা ভারত মহান! হাগাহাগি নিয়ে কিউরিসিটি অত্যন্ত বাজে বিষয়!

 

চার

ভারতের এই এজেন্ডা বাস্তবায়নের সবচে শক্তিশালী হাতিয়ার হচ্ছে বলিউড। বলিউডের আকছার সিনেমায় আপনি দেখবেন ঝকঝকে মুম্বাই বা চেন্নাই শহর। আলিয়া ভাটের দামি দামি শপিং মল, রজনীকান্তের প্রাযুক্তিক উৎকর্ষ, করণ জোহরের স্বপ্নীল ইউনিভার্সিটি কিংবা বাহুবলীর হাজার কোটি টাকার মহামতি ঐতিহাসিক প্লট- সকলই চোখের ধাঁধা। বলিউড কখনোই ভারতের ময়দানমুখী জনতার সচিত্র ছায়াছবি খোদ ভারতের সামনেই তুলে ধরে না, বিশ্ববাসীর কাছে তো নয়ই।

বেশ কয়েক বছর ধরে বলিউডি সিনেমা আন্তর্জাতিকভাবেও মুক্তি দেয়া হচ্ছে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে ভারতীয় সিনেমা দিন দিন ব্যাপকভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে। অনেক সিনেমার প্রিমিয়ার হচ্ছে দুবাই কিংবা শারজায়। ভারতীয় সিরিয়াল নিয়মিত আরবিতে ডাবিং হয়ে প্রচারিত হচ্ছে সৌদি আরব, দুবাই, কাতার, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে। এই যে বলিউডের আন্তর্জাতিক যাত্রা, এই যাত্রায় তারা ভারতের তেরঙা পতাকার ধ্বজা সবসময় ঊর্ধ্বে তুলে ধরার প্রয়াস করে চলেছে। তারা ভুলেও ভারতের ৫৭ ভাগ জনতার ময়দানমুখিতার চিত্র তুলে ধরে না। তারা বিশ্ববাসীর কাছে প্রদর্শন করছে কেবল ভারতের ক্ষুদ্র ৫ ভাগ মানুষের জীবনের চালচিত্রকে। এটাই ভারতের চাতুরী, এখানেই ভারতের সকল মহত্ব!

 

পাঁচ

ভারতের ‘হাগু কেলেঙ্কারি’ ঢেকে রাখার আরেক অস্ত্র হলো ক্রিকেট। ক্রিকেট ভারতের সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখারও অন্যতম চাবিকাঠি। ভারতীয় মিডিয়ার অন্যতম কাজ হলো, ভারতীয় ক্রিকেট টিমের সদস্যদের ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেবতার পর্যায়ে উন্নীত করা। কখনো তারা কপিল দেবকে বসিয়েছে দেবতার আসনে, কখনো সৌরভ গাঙ্গুলী কখনোবা শচীন টেন্ডুলকারকে বলেছে গড অব ক্রিকেট, আবার বিরাট কোহলিকে বানিয়েছে হিরো অব হিরোজ! এ সবই ভারতবাসীকে নানা মধুর প্রেমে আবিষ্ট রাখার নানা যজ্ঞমন্ত্র। ২৯টি রাজ্যকে মোহমুগ্ধ করে রাখার খেলুড়ে জিয়নকাঠি। বস্তুত শচীন কিংবা শাহরুখ খান, ভঙ্গুর ভারতের অজস্র জখমের উপর মোলায়েম প্রলেপ মাত্র।

এই ক্রিকেটের হাত ধরে বিপিএল নামের আরেক ঝকমারি শুরু করেছে ভারত। যেটা ক্রিকেটের চেয়েও বেশি কিছু দিচ্ছে ভারতবাসীকে। ক্রিকেটকে তারা শুধু খেলার মাঠে আবদ্ধ না রেখে সেটাকে ছড়িয়ে দিয়েছে প্রতিটি রাজ্যের প্রতিটি ঘরে ঘরে। কিসের ময়দানমুখী হাগুকর্ম আর কিসের স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্ব, এসব বকওয়াজি বন্ধ রেখে ক্রিস গেইল আর ওয়ার্নারের ছক্কা পেটানোতে বুঁদ হয়ে থাকো। ছক্কা আর চৌকার পরপরই তো আতশবাজির রোশনাইয়ের ভেতর নেচে উঠে উদ্ভিন্ন চিয়ারলিডার কন্যারা। ময়দানে কর্মসাধনে ব্যস্ত ভারতবাসীর চোখ আবেশে আপনাআপনি মুদে আসে- জনগণ মন অধিনায়ক জায় হিন্দ…!

 

ছয়

এ হিসেবে আমি বাংলাদেশকে শত বর্ষ এগিয়ে রাখতে পারি। বিশেষত স্যানিটেশনের ব্যাপারে বাংলাদেশ মিলেনিয়াম গোল অর্জনে যে অভিনব অগ্রগতি দেখিয়েছে, তা বিশ্ববাসীর জন্য মডেল হতে পারে। ভারতের জন্য তো অবশ্যই। হাগন কর্মসূচিতে বাংলাদেশের অগ্রগতি শতভাগ সাফল্য অর্জন করেছে।

২০০০ সালে বাংলাদেশের ৩৩ শতাংশ মানুষ খোলা জায়গায় মল ত্যাগ করত। ২০১৫ সালে তা ১ শতাংশে নেমে আসে। ২০১৬-এর জানুয়ারিতে ঢাকায় সার্কভুক্ত দেশগুলোর মন্ত্রী পর্যায়ের স্যানিটেশন-বিষয়ক সম্মেলনে (স্যাকোসান) খোলা জায়গায় মলত্যাগমুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম ঘোষণা করা হয়। মাত্র ১৫ বছরে বাংলাদেশ এই সাফল্য অর্জন করে।

ভারতের উচিত, স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নেয়া এবং তাদের দেশের নাগরিকদের বেশি করে বাংলাদেশে পাঠানো, যাতে করে তারা শিখে নিতে পারে- ময়দানের চেয়ে বাথরুমে ত্যাগ করা কতো মহান, কতো আনন্দের।

ধর্মীয়ভাবেও হিন্দুধর্ম পবিত্রতা বিষয়ে ততোটা উৎসুক নয়, যতোটা না পবিত্রতার ব্যাপারে বাংলাদেশে ইসলাম প্রভাব বিস্তার করে আছে। মূলত যারা গরুর গোবর আর গোমূত্র দিয়ে মন্দিরের পবিত্রতার জ্ঞানপাঠ করে, তাদের কাছে হাগন পবিত্রতার কথা বলাটাও একপ্রকার বোকামি বৈকি!