রফিকের বাবা ইবরাহিম মণ্ডল ইজতেমা থেকে চিল্লায় চলে গেছেন। এক চিল্লা। বাড়ি থেকে চিল্লার প্রস্তুতি নিয়ে যাননি, ইজতেমার ময়দানে গিয়ে তাশকিল হয়ে চিল্লার নিয়ত করে ফেলেছেন। সেখান থেকেই রোখ—দিনাজপুরের খানসামা উপজেলায়। ইজতেমা তিন দিনের মামলা। সেই হিসাব করে শীতের কাপড়ও খুব একটা নেননি। কিন্তু উত্তরবঙ্গে শীতের প্রকোপ এখনও ডাকাবুকো। শীতের এ ক’দিন কীভাবে যে কাটবে, আল্লাহ মালুম! তবে আশার কথা, মাঘ মাস আসতে আসতে শীত কমতে শুরু করেছে। সপ্তাহ দুয়েক আগের রেকর্ডভাঙা শীত এখন অনেকটাই কাবু।

ইবরাহিম মণ্ডল ইজতেমায় যাওয়ার কারণে সংসারের সকল দায়িত্ব এসে পড়েছে রফিকের ওপর। বাজার-সদাই তো যেন তেন, ক্ষেত-খোলা দেখাশোনার মহতী কর্মও তাকে দেখতে হচ্ছে। পৌষ মাসের মাঝামাঝি থেকে ইরি বোনার মৌসুম। বিলজুড়ে কাদামাটি আর নতুন চারার মচ্ছব চলছে। কামলাদের হাঁকডাক, এ ক্ষেত ও ক্ষেতে গেরস্থদের দৌড়ঝাপে পুরো বিলে রৈ রৈ অবস্থা।

এবার মণ্ডলের ধান বোনার মতো জোয়ানো ছিল চার ক্ষেত। কিন্তু চার ক্ষেতে ধান বোনা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার, দেখভালের ব্যাপারটা। বাড়িতে কাজের লোক তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। একমাত্র ছেলে রফিক, কলেজে পড়ে। চাষবাসের সঙ্গে তার সম্পর্ক নামকাওয়াস্তে।

মণ্ডলেরও বয়স হয়েছে, ক্ষেত-খোলা নিয়ে এখন আর এই ধানাই পানাই ভালো লাগে না। মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আর মাসে-দুই মাসে তাবলিগে সময় লাগিয়ে দিন পার করে কোনোমতে আখেরাতটা ধরতে পারলে হয়। তাই পশ্চিম বিলের ক্ষেতটা ইজতেমায় যাওয়ার আগে বর্গা দিয়ে গিয়েছিলেন পশ্চিমপাড়ার পাঞ্জুর কাছে। বাকি তিন ক্ষেত বোনার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ম-ল চলে যাওয়ার পর রফিক একটু দূরবর্তী বড় ক্ষেতটা ও পাড়ার মালেক চাচার কাছে বর্গা দিয়ে দিয়েছে। এখন দুটো ক্ষেত কেবল। এ দুটো বাড়ির সামনেই। দুটো মিলে ত্রিশ-পয়ত্রিশ শতাংশ। তার মধ্যে একটা দিন চারেক আগে বোনা শেষ হয়েছে, বাকি ক্ষেতটা রয়ে গেছে।

 

দুই

ফজরের নামাজ পড়ে সাইকেলটা নিয়ে রফিক দৌড় দেয় বহুরা বাজারের দিকে, ওখানেই কামলার বাজার। মৌসুম শুরু হতেই উত্তরবঙ্গ থেকে শত শত কামলা এসে জড়ো হয় বাজারের আশপাশে। বাজার লাগোয়া স্কুল-কলেজের বারান্দায় রাত্রিবাস, ভোর হলে চলে আসে বাজারে। আশপাশের কয়েক গ্রামের গেরস্থরা ফজরের নামাজের আগেই বাজারে এসে কামলার দামাদামি শুরু করে। কাজের ধরন অনুযায়ী দরদাম করে নিয়ে যায় যোগ্য কামলা।

রফিক এর আগে কখনো কামলা বাজারে আসেনি, আজই প্রথম। মাঘ মাসের কুয়াশায় আচ্ছন্ন রাস্তা, বিশ হাত দূরের কিছুও দেখা যায় না। শীত খানিকটা কম, কিন্তু কুয়াশায় ছেয়ে গেছে বিলমাঝারি পাকা রাস্তাটা। কুয়াশার ছটা এসে লাগছে নাকে-মুখে। গায়ে চাদর আর মাথায় কানটুপি থাকায় রক্ষে। তবু পায়ে বেজায় ঠান্ডা লাগছে, প্যাডেল মারতে গিয়ে পায়ের আঙুলের মাথা শির শির করে ওঠছে থেকে থেকে। নাকের মাথাও জ্বালা করছে।

বাজারে এসে দেখে, অনেক গেরস্থ বাজার থেকে কামলা নিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে। একেকজনের সঙ্গে দুজন পাঁচজন করে কামলা, নানান বয়সী। গায়ে-চেহারায় উত্তরবঙ্গের দারিদ্রের ছাপ সবার। কেউ কেউ ঠান্ডা কমাতে বিড়ি ধরিয়ে জোরসে ধোঁয়া ছাড়ছে ফোঁস ফোঁস করে। গাঢ় কুয়াশার সঙ্গে রুপালি ধোঁয়া মিশে একাকার।

নিজের ঠান্ডা রেখে ওদের কথা ভাবে রফিক। এখন গিয়ে বিলের ঠান্ডা পানিতে ধানের চারা বুনতে হবে ওদের। শীতল কাদামাটিতে পায়ের গোড়ালি ডুবিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চারা বোনা—কী কষ্টটাই না লাগবে! ওদের কষ্টের তুলনায় এই সামান্য ভোর-কুয়াশা, কিছু নয়। টাকা কামানো এতো সহজ না বেটা! নিজেকে আরেকবার সাহসী করার ফুরসত খোঁজে রফিক।

রফিক সাইকেল থেকে নামতে নামতে কামলার বাজার পড়তির দিকে। গেরস্থরা আরও আগে এসে যোগ্য ব্যক্তিদের বগলদাবা করে নিয়ে গেছে নিজ ভূঁইয়ে। এখন মাত্র শ’খানেক দেশি-বিদেশি কামলা রয়ে গেছে, এদের খরিদ্দারও কম না। এক কামলার সঙ্গে কথা বলে আরেকজনকে যাচাই করতে গেলেই আগেরজনকে নিয়ে যাচ্ছে কোনো গেরস্থ। বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বাজারব্যবস্থা। বাজারে যোগানের চেয়ে চাহিদা বেশি মনে হয় রফিকের। অর্থনীতির এমন অসাম্য নীতি বলবৎ থাকলে মূল্যস্ফীতি ঘটবে খুব শিগগির। কামলা-বাজারে এসে অর্থনীতির এই সাধারণ সূত্রটা মাথায় আসতেই কলেজে কমার্স পড়ার উপকারিতা যেন টের পায় রফিক।

দু-চারজন কামলার কাছে গিয়ে দামদস্তুর করে, ‘কত কইরা?’

‘কী কাম?’

‘হালি বোনা।’

‘হালি বুনতে যামু না।’

রফিক মোটামুটি তব্দা খেয়ে যায়। কামলাদের তাহলে আলাদা ডিমান্ডও থাকে! মানে অপশন পছন্দ করার ব্যাপারও আছে তাহলে! বাহ, কে বলে বাংলাদেশে স্বাধীনতার সুফল নেই? একজন কামলা তার ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ পছন্দ করার সুযোগ পাচ্ছে—গেরস্থ ইচ্ছা হলে নেবে না হলে নাই—এর চেয়ে বড় স্বাধীনতা আর কী হতে পারে? স্বাধীনতার এমন অপ্রত্যাশিত সুফল দেখে সকাল সকাল মনটা ভালো হয়ে যায়। রফিক এতদিন মনে করেছে, টাকা দিয়ে কামলা এনে তাকে দিয়ে যা ইচ্ছা কাজ করানো যায়—হালি বোনা থেকে শুরু করে গাছ কাটা—সব। কিন্তু এখন দেখছে, বাজারব্যবস্থায় সাম্যও আছে। মজদুরদের রক্ত-ঘাম চুষে শোষণের দিন আর নেই।

বাজার এখনও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। চোখের পলকে গেরস্থরা টোক্কা মেরে কামলা নিয়ে যাচ্ছে, দাঁড়িয়ে দু’কথা বলা যাচ্ছে না। যা করতে হবে তাড়াতাড়ি। আজকে কামলা দিয়ে হালি বুনতে না পারলে ক্ষেত শক্ত হয়ে যাবে, তখন আবার নতুন করে চাষ দিয়ে বুনতে হবে। আবার আরেক খরচ।

রফিক কাঁচা-পাকা দাড়িওয়ালা এক কামলাকে জিজ্ঞেস করে, ‘চাচা, যাইবেননি?’

‘৫০০ কইরা।’

‘সেইটা বুঝলাম, হালি কিন্তু বুনতে হবে!’

‘সমস্যা নাই, হালি বুনুম। কয়জন লাগবো?’

‘দুইজন। দুইজন আছেননি?’

‘আছি, এই দুইজন। কোন গেরাম?’

‘ফুলতলা, আমার পিছে পিছে আসেন।’

রফিকের আর উপায় ছিল না। আর মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করলে খালি হাতে ফিরতে হতো। কামলার সঙ্গে দামদস্তুর ঠিক হওয়ার পর নিজেকে কৃষক হিসেবে ভাবতে ভালো লাগছে। যাক, কামলার ব্যবস্থা তো অন্তত করতে পেরেছে। তার কৃষক-মুকুটে আরেকটা পালক যোগ হলো। গর্বিত হওয়ার মতো ব্যাপার বটে! কামলা দুজনকে পেছনে আসতে বলে রফিক আগে আগে সাইকেল ধাক্কিয়ে ক্ষেতের পথ ধরে।

 

তিন

কামলাদের একজন যে দেশি কামলা, রফিক সেটা আগে বুঝতে পারেনি। বুড়ো লোকটার বাড়ি দুই-তিন গ্রাম পরে, মাটুয়াপাড়া। রফিক মনে করেছিল দেশি কামলা বলতে তাদের এলাকায় এখন আর কোনো প্রাণি অবশিষ্ট নেই। এ এলাকার লোকজন যারা আগে কামলা দিত, তারা সবাই এখন অটো ভ্যান-ট্রলি চালিয়ে বেশ কামাই রোজগার করছে। ওদের গ্রামেই কত কামলা ছিল, কিন্তু এখন একজন লোকও কামলা দেয় না, একজনও না।

আধবুড়োর বাড়ি মাটুয়াপাড়া, লোকে ডাকে মাইট্যাপাড়া। ওই গ্রামের পাশের গ্রামে রফিকের বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। সে হিসেবে বুড়ো তার বোনের বাড়ির এলাকার লোক, সুতরাং সামান্য হলেও তাকে আলাদা খাতির করতে হবে। বোনের এলাকায় তার বাপের বাড়ির নাম সর্বদা রৌশন রাখাই নিয়ম। ব্যত্যয় হলে বোন নাখোশ হবে। বোন নাখোশ হলে বিরাট সমস্যা!

অন্যজন অবশ্য রংপুইর‌্যা, মানে উত্তরবঙ্গের। উত্তরবঙ্গের যেকোনো জেলা থেকে কামলা এলে তাদের রংপুইর‌্যা নামে ডাকা হয়। বয়সে তরুণ। দাড়ি-গোঁফে পরহেজগার পরহেজগার মনে হয়। পুরোনো একটা প্যান্টের সঙ্গে শার্ট পরেছে। কিন্তু সেই প্যান্টে তাকে যেন কেমন কাকতাড়ুয়ার মতো লাগছে। বাজার থেকে ক্ষেতে আসতে আসতে মনে হলো, এ শার্ট-প্যান্টের ভেতরে সে খুব অস্বস্তিতে আছে। মাথা নিচু করে হাঁটছে। মাইট্যাপাড়ার বুড়ো ফুঁক ফুঁক করে বিড়ি ফুঁকলেও সে বিড়ি টানাটানিতে নাই। নিম গাছের দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজছে আর বিড় বিড় করে কী যেন আওড়াচ্ছে।

‘আপনের বাড়ি রংপুর কই?’ রফিক সামান্য কৌতূহল নিয়েই জিজ্ঞেস করে।

‘দিনাজপুর।’

‘কোন উপজেলা?’

‘খানসামা উপজেলা।’

রফিকের চট করেই মনে পড়ে যায়, তার আব্বাও দিনাজপুরের খানসামা উপজেলায় চিল্লা লাগাতে গেছেন। ‘আচ্ছা, আমার আব্বা তো চিল্লায় আছেন খানসামা উপজেলায়। তাহলে আপনাগো বাড়ির কাছেই আছে মনে হয়।’

কামলা লোকটা দাঁত মাজায় একটু বিরতি নেয়। এতক্ষণ রফিকের সাইকেলের পাশে পাশে হাঁটছিল, ওর কথা শুনে একটু পেছনে এসে হাঁটতে থাকে। রফিক বিষয়টা ধরতে পারে না। সে আবার প্রশ্ন করে, ‘আপনের গ্রামের নাম বলেন তো। দেখি, আব্বায় আপনাগো বাড়ির আশপাশেও থাকতে পারে। আপনাগো বাড়ির হাল-হাকিকত জানতে পারবে। কী বলেন?’

লোকটার মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখা গেল না। রফিক পেছন ফিরে দেখে, তাদের রেখে সে পথের পাশে পেশাব করতে বসেছে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া। লোকটা সেই যে পিছে পড়ে রইলো, ক্ষেতে আসার আগ পর্যন্ত আর সমানে হাঁটলো না।

 

চার

হেঁটে কামলাদের নিয়ে থাইল ফালানো ক্ষেতের কাছে চলে আসে রফিক। থাইলের ক্ষেত থেকে আগে হালি উঠাতে হবে। শ’খানেক আটি হালি উঠিয়ে তারপর ক্ষেত বোনা। কামচুরি না করলে দুই কামলা দিনে দিনে শেষ করে ফেলতে পারবে।

ইরি ধানের থাইল ফেলা হয়েছে বড় ক্ষেতে। থাইল জিনিসটা চিনবেন কিনা জানি না, কিছু বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে বৈকি। ইরি ধান বুনতে হলে প্রথমে বাড়িতে রাখা গত বছরের পুরোনো ধান নির্বাচন করতে হবে। পুরোনো মৌসুমি ইরিও বোনা যায় আবার রাজভোগ-পায়জাম বা অন্য জাতের ধানও বোনে অনেকে। তবে আকছার লোক ইরিই বোনে। এটাই মোটা চাল, যেটা সারা বাংলাদেশের মানুষ তিনবেলা খাওয়ার জন্য রোজ পথে নামে।

ধান নির্বাচন করার পর কৃষক কতখানি জায়গা বুনবেন সে অনুযায়ী ধান নিতে হয়। আধা মণ বা এক মণ, বা যতটুকু লাগে। এই ধান বড় মাটির চাইড়ায় পানির নিচে ভিজিয়ে রাখতে হবে একদিন। পরদিন চাইড়া থেকে উঠিয়ে দুয়ারের পাশে খড় বিছিয়ে সেখানে ধানগুলো স্তূপ করে রাখতে হবে। স্তূপের উপর আরেক প্রস্থ ভেজা খড় দিতে হবে এবং খড়ের উপর একটা ছালা বা চট বিছিয়ে দিতে হবে, যাতে ভেতরের ধানগুলো আলো-বাতাস না পায়। এভাবে ধানগুলোকে তিন-চার দিন খড় দিয়ে ঢেকে রাখলে ভেজা ধানগুলো থেকে গ্যাড়া উঠবে। গ্যাড়া মানে পুঁই, নতুন চারার তাতানো আগা।

ধানগুলো গ্যাড়ানোর আগেই বীজতলার ক্ষেত প্রস্তুত করতে হবে। এটা করতে হবে অগ্রহায়ণ মাসের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময়ে, তাহলে পৌষের শেষ এবং মাঘের শুরুতে ইরি মৌসুমে ঠিকমতো হালি পাওয়া যাবে। বীজতলার জন্য যে ক্ষেত প্রস্তুত করা হয় সেটাকে ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার দিয়ে একটা চাষ দিয়ে নিতে হবে। ক্ষেতে পানি না থাকলে সেচ পাম্প ব্যবহার করে ক্ষেতে পানি দেয়াটা আবশ্যক। সবচে ভালো হয় যদি বীজপানিতে হালির ধান ফেলা যায়।

বীজপানি হলো, বর্ষা মৌসুমে ক্ষেতে যে পানিটা আসে সে পানিটা কার্তিক অগ্রহায়ণ পর্যন্ত ক্ষেতে থাকে। এ পানিটা মাটির উর্বরতার জন্য বিশেষ উপকারী। তাই সেচের পানির চেয়ে এ পানিটা ব্যবহার করা অধিক ফায়দামন্দ। গেরস্থরা যেটা করে, অল্প বীজপানির ক্ষেতে একটা কলাগাছ টেনে পুরো ক্ষেতটা সমান করে নেয়। যদি পানি বেশি থাকে তবে উঁচি বা বোলের মাধ্যমে বাড়তি পানিটুকু ক্ষেত থেকে সেচে অন্য ক্ষেতে ফেলে দেয়। ক্ষেতটা কাদা কাদা হলে এবার পুঁই-উঠা ধানগুলো ধামায় করে নিয়ে এসে কায়দামতো ছিটিয়ে দিলেই প্রাথমিক কাজ শেষ।

ব্যাস, এখন শুধু একটাই কাজ—ক্ষেতের সদ্য ছিটানো ধানগুলো শালিক, বক, কবুতর, অতিথি পাখি আর আশপাশের বাড়ির নচ্ছার হাঁস-মুরগির ঠোকর থেকে রক্ষা করা। এ জন্য ক্ষেতের চারপাশে জাল দিয়ে বেড়া দিয়ে দিয়ে দেয় অনেকে। অনেক গেরস্থ মাঝে মাঝে এসে পাহারা দিয়ে যায়। তবে উড়ুক্কু পাখিদের জন্য কাকতাড়ুয়া বানানোটা জরুরি।

বেশিদিন নয়, দিন দশেক পাহারা দিয়ে রাখলেই ধানের পুঁই থেকে জন্ম নেবে নতুন একেকটি চারা। হলদে সবুজ রঙের নতুন একেকটা জীবন মাথাচাড়া দিয়ে জানান দেবে নিজের জন্মনাদ। পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে সোল্লাসে হেসে বলবে—ভয় নেই বন্ধু আমার! আমি এসেছি, তোমার ক্ষুধার সকল জীর্ণতা দূর করতে। চেয়ে দেখো, সোনালি ধানের রেশ লেগে আছে আমার গায়ে; একজন মানুষকেও মরতে দেবো না ক্ষুধার জ্বালায়!

 

পাঁচ

হালি উঠানো শেষ হয়ে যায় বেলা দশটার দিকে। রফিক কামলাদের খাবার নিয়ে আসে ক্ষেতে। ওখানে বসেই খেয়ে নেয় দুজন। খাওয়া শেষে বিশেষ দেরি হয় না, ঝটপট হালি বুনতে চলে যায় তারা।

লালমনিরহাটের লোকটাকে নিয়ে কেন যেন অযথাই কৌতূহল হচ্ছে রফিকের। লোকটাকে দেখতে একেবারে কামলাদের মতো লাগছে না। একটু ভদ্রগোছের। কামলাদের চেহারায় যে রোদেপোড়া তামাটে ভাব থাকে, তার চেহারা সেরকম নয়। চেহারায় কেমন একটা লালিত্যে ভাব আছে। কামলাদের সঙ্গে চেহারাটা কোনোভাবেই যাচ্ছে না। বিষয়টা রফিকের মনে খচ খচ করতে থাকে।

দুপুরে খাবার নিয়ে এসে রফিক দেখে, দেশি বুড়ো কামলাটা ক্ষেতের আইলে বসে বিড়ি টানছে। বিদেশি কামলাটাকে আশপাশে দেখলো না।

রফিক জিজ্ঞেস করে, ‘আরেকজন কই?’

‘ওই যে, ক্ষেতের আইলে নামাজ পড়তেছে।’

রফিক হতচকিত হয়ে তাকায়। খানিক দূরের একটা ক্ষেতের আইলে গামছা বিছিয়ে নিবিষ্টমনে নামাজ পড়ছে লোকটা। কী অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। দিগন্তছোঁয়া বিলে ধানের নতুন চারার অগণিত সারি, তার মাঝখানে সেজদা করছে রুকু করছে একজন মানুষ। মনে হচ্ছে বিলের সমস্ত ধানের চারা তার মুসল্লি। তার আল্লাহু আকবার ধ্বনির সঙ্গে সকল চারা আন্দোলিত হয়ে নুয়ে পড়ছে বিস্তীর্ণ কাদামাটিতে। যেন সমস্ত সবুজ পশ্চিম আকাশের পানে সেজদায় অবনত হচ্ছে তার সঙ্গে।

রফিক লোকটার জন্য বসে থাকে। নামাজ শেষ করে ভাত খেতে বসলে রফিক জিজ্ঞেস করে, ‘ভাইজানের নাম কী?’

‘জি, কোহিনূর মিয়া।’

‘লেখাপড়া করছেন নাকি কিছু?’

‘জি, কিছু তো করছি…।’

পাশ থেকে দেশি লোকটা বলে ওঠে, ‘সে তো হাফেজ, পুরা কুরআন মুখস্থ তার। পেটের দায়ে আইছে এই কামে। নইলে তার মতো লোক এইখানে আসে কোনোদিন!’

রফিক আরেকবার বিস্মিত হয়। চোখগুলো বড় করে তাকায় তমিজ করে ভাত খেতে বসা লোকটা দিকে! রফিক এবার কিছুটা বুঝতে পারে। এ কারণেই তো লোকটাকে আর দশজন কামলা থেকে আলাদা লাগছিল।

‘তো, হাফেজ হয়েছেন যখন, কোনো মাদরাসা টাদরাসায় পড়ান না?’

‘জি, পড়াইছি।’ লোকটা কথা খুব একটা খোলতাই করে বলে না।

‘তাহলে মাদরাসা-মসজিদ রাইখ্যা এই দেশে কামলা দিতে আসলেন কেন?’

‘আসলাম আর কি…!’

‘আসলাম আর কি’ মানে কী? মাদরাসায় পড়ানো তো কত সম্মানের কাজ। সেইটা রাইখ্যা আপনে মানুষের বাড়িতে কামলা দিতে আসছেন, এইটা তো অসম্মানজনক কাজ।’

রফিক ভেবেছিল কোহিনূর মিয়া তার এ কথায় রেগে উঠবে। কিন্তু উত্তরবঙ্গের মানুষের স্বভাব অন্যরকম, ধৈর্য এদের চরিত্রের ভূষণ। বাটি থেকে মাসকালাইয়ের ডাল নিতে নিতে ধীর গলায় বললো, ‘মাদরাসায় পড়িয়ে কয় টাকা বেতন দেয় মানুষ? সাত বছর এক হেফজখানায় পড়াইছি, বেতন পাইতাম আড়াই হাজার টাকা। এর মধ্যে বিয়ে করছি, একটা বাচ্চাও হয়েছে। বাচ্চার বয়স নয় মাস। আড়াই হাজার টাকা দিয়ে সংসার চলে? আমাদের এলাকার লোকজন এ এলাকায় আইসা কাজ করে। মাসে তাদের আট-দশ হাজার টাকা ইনকাম। তাদের সংসার সুন্দর চলছে। তাহলে হাফেজ হয়া সম্মান নিয়ে বাইচা থাইকা আমার লাভ কী? সংসারের অভাব-অনটন তো সম্মান দিয়া দূর করা যায় না। সম্মান ধুইয়া জীবন চলে না ভাইজান। আর তাছাড়া, এখানে আইসা তো আমি চুরি-ডাকাতি করতেছি না, কাজ কইরা খাইতেছি। মানুষের কাছে ভিক্ষা করার চেয়ে কাজ করে খাওয়া অনেক সোয়াবের। এটা আল্লাহর রাসুলের সুন্নত…।’

আব্বার কথা মনে পড়ে রফিকের। ওর আব্বা ইবরাহিম মণ্ডল ধর্মের দাওয়াত নিয়ে গেছেন দূর দিনাজপুরের খানসামায়। অথচ খানসামা থেকে একজন ধর্মীয় মানুষ জীবিকার সন্ধানে ছুটে এসেছে ওদের গ্রামে। কার হিজরতটা পুণ্যময়? তাবলিগের ছয় উসুল নিয়ে ধর্মের দাওয়াত দিতে যাওয়া ইবরাহিম মণ্ডলের? নাকি স্ত্রী-সন্তানের জীবিকার সন্ধানে ছুটে আসা কোহিনূর মিয়ার?

 

সৌজন্য: অন্যপরশ, বইমেলা ২০১৯ সংখ্যা