বেঁচে থাকাটাও একটা বিস্ময়ের ব্যাপার। এবং দারুণ একটা ব্যাপার। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠছি। বাইরে পাখি ডাকছে, হাওয়া বইছে, সূর্যের ঝলমলে আলো টাটকা গন্ধ নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে ঘরের মধ্যে, এসব ব্যাপারকে দারুণ না বললে দারুণ বলবেন কোন জিনিসকে?
আমি হয়তো দৃশ্যকল্পটা ঠিকঠাক ফুটিয়ে তুলতে পারলাম না আপনার চোখের সামনে। ঠিক আছে, আরেকবার চেষ্টা করি— নিমগ্ন এক অরণ্যের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন। চারদিকে বিরাটাকার বৃক্ষ উদ্বাহু আকাশের দিকে উঠে গেছে। গুল্ম-লতা ছড়িয়ে আছে চারপাশে। বুনোফুল আর অজান্তা পাতার গন্ধে নেশা ধরে গেছে মগজের নিউরনে। চোখ বুজে আসতে চাইছে আপনা থেকেই। কিন্তু এতো ভয়াবহ সৌন্দর্যের মধ্যে আপনি চোখ বন্ধ করতে পারছেন না। কেননা আপনি আপনার প্রিয়তম মানুষের হাত ধরে হাঁটছেন।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ শুনতে পেলেন ঝর্ণার কুল কুল শব্দ। আরেকটু এগিয়েই দেখতে পেলেন স্বচ্ছ কাকচক্ষুর মতো টলটলে জলের ছোট্ট একটা হ্রদ। পাড় থেকে তাকালেও একদম হ্রদের তলা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। এমনই স্বচ্ছ সবুজ জল সে সরোবরের। হ্রদের জল দেখে আপনার দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। প্রিয়তমার হাত ধরে সাঁই করে এখনই ঝাপ দিয়ে পড়তে ইচ্ছা হচ্ছে হ্রদের জলে। তো, দেরি কেন?
না, আপনি এ মুহূর্তে ঝাঁপ দিতে পারেন না। কারণ আপনি শুয়ে আছেন আপনার বিছানায়। বিছানা থেকে ঝাঁপ দিলে সোজা সিমেন্টের মেঝেতে গিয়ে পড়বেন এবং মাথা ফাটিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড করবেন। তার চেয়ে ভালো, আপনি লেখাটা পড়া শেষ করুন। তারপর একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে, সত্যিই আপনি টলটলে সরোবরের জলে ঝাঁপ দেয়ার লায়েক, নাকি নালায়েক!

দুই
দিস ইজ ইমাজিনেশন। কল্পনাশক্তি। একজন লেখক যখন একটি উপন্যাস বা গল্প লিখেন তখন তিনি তার ইমাজিনেশনকে কাজে লাগান। কল্পনাশক্তির ভেতর দিয়ে তৈরি করেন গল্পের একটি প্লট, কিছু চরিত্র, চরিত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং একটি কল্পনাপ্রবণ কাহিনি। যিনি কল্পনায় যতো তুখোড়, তার গল্পও ততো সুডৌল। যিনি ইমাজিনেশনকে যতো বেশি নিরেট এবং নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করতে পারেন বইয়ের পাতায়, তিনিই কালজয়ী হন। কিন্তু যার ইমাজিনেশনে খুঁত থেকে যায়, কল্পনায় যিনি কাঁচা, তার গল্প বা উপন্যাস পাঠককে তার লেখা পাঠে ধরে রাখতে পারে না। দিস ইজ অল অ্যাবউট ইউর ইমাজিনেশন অ্যাবিলিটি।
তিন
দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশজুড়ে বিস্তৃত অ্যামাজন বন পৃথিবীর সবচে বড় বন তো অবশ্যই, পৃথিবীর সবচে মনোমুগ্ধকর বনও। এ বনে অনেক ধরনের উপজাতিদের বাস। এসব উপজাতির মানুষগুলো এখানেই জন্মেছে, এখানেই বড় হয়েছে এবং এখানেই সভ্যতাহীন তাদের বসবাস। তাদের কাছে গিয়ে যদি আপনি প্রশ্ন করেন— ‘এই মাতাল বনানী আপনাদের কেমন লাগে?’ বিশ্বাস রাখুন, তারা আপনার দিকে বিতৃষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাবে।
বছরের পর বছর ধরে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা এই বনের মধ্যেই বসবাস করছে। এই গাছপালা, তরুলতা, পশু-পাখির সঙ্গে সমাজবদ্ধ হয়ে বেঁচে থাকছে। তাদের কাছে অ্যামাজনের গহীন অরণ্য তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। বৃক্ষের উদ্বাহু আকাশযাত্রা, বুনোফুলের ঘোরলাগা সুবাস, পাখির কলকাকলি, হরিদ্রা গুল্ম-পাতা তাদেরকে কোনোভাবেই বিস্মিত করে না। ঝর্ণার কুল কুল বয়ে যাওয়া, হ্রদের স্বচ্ছ স্ফটিক জলের ধ্যান তাদের বিমোহিত করে না খুব বেশি। কেননা এ বনানী, পশু-পাখি, এ ঝর্ণা-হ্রদ তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। বেঁচে থাকার অবলম্বন দেখে কেউ বিস্মিত হয় না। তাদের কাছে অ্যামাজন স্রেফ বেঁচে থাকার এক সংগ্রামী অবলম্বন।
কিন্তু অ্যামাজন আপনার কাছে এক বিস্ময়ের নাম। এ বনের প্রতিটি পাতার মধ্যে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে বিস্ফোরিত বিস্ময়। প্রতিটি সবুজ আপনাকে চমকে দেবার জন্য প্রতীক্ষমাণ। প্রতিটি জলের ধারা আপনার চোখের তারার ছলকে উঠা অভিভূত দৃষ্টির জন্য ইন্তেজার করছে। কারণ আপনি কখনো অ্যামাজন দেখেননি। ভিডিও, বইপাঠ আর বর্ণনা শুনে আপনি শুধুমাত্র অ্যামাজনের কল্পনা করেছেন। এ কারণেই অ্যামাজন আপনার কাছে বিস্ময়ের।
অ্যামাজন আপনার জন্য বিপুলা বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষা করছে। অ্যামাজনের বিস্ময় পৃথিবীতে আপনাকে স্বাগতম!
চার
ইমাজিনেশন একটি আর্ট, এটি শিখতে হয়, রপ্ত করতে হয়। ইমাজিনেশন ডেভলপ করার অন্যতম চাবিকাঠি হলো বিস্ময়। আপনাকে বিস্মিত হতে হবে। বিস্ময়ের পরত দিয়ে একের পর এক তৈরি হয় ইমাজিনেশনের সিঁড়ি। আপনাকেই ঠিক করতে হবে আপনি ঠিক কতোটা বিস্ময়বাদী।
এখন আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে আপনি কী কারণে বিস্মিত হন, কী দেখে বিস্মিত হন, কী কল্পনা করে বিস্মিত হন। অ্যামাজন? কিন্তু অ্যামাজন আপনি যাবেন কীভাবে? অনেক হ্যাপার ব্যাপার। তারচে’ আমি আপনাকে বিস্মিত হওয়ার কিছু সবক শেখাতে পারি। একদম সিম্পল।
আপনার চারপাশে একবার তাকান, আপনি যেখানেই আছেন। যেখানে বসে এ লেখা পড়ছেন। সবকিছু স্বাভাবিক, তাই না। কয়েকটা জানালা, একটা দরজা, বাইরে কিছু দালান-বাড়ি বা টিনের ঘর, এক টুকরো আকাশ, কিছু গাছ, কয়েকটা পাখি ডাকছে… এই তো! বিস্মিত হবার মতো কিছু কি পেলেন? নেই, তাই না! আসলে বিস্মিত হবার মতো কিছুই নেই আপনার এখানে। আমি এমনিই আপনার সঙ্গে মজা করছিলাম।
তাহলে অন্যভাবে শুরু করি। বাইরের গাছটার দিকে তাকান। কী গাছ ওটা? আম, না নারিকেল? নিজেকে কখনো একটা নারিকেল গাছ ভেবেছেন? একবার ভাবুন নিজেকে একটা নারিকেল গাছ। ভাবুন— আপনার মাথার উপর ঝিরঝির করে দুলছে পাতা। ছোট ছোট ডাবের কাঁদি ঝুলছে আপানার গলায়, হীরের কণ্ঠাভরণ হারের মতো। আপনি প্রতিদিন তাদের জন্য মাটি থেকে শুষে আনছেন জল, উর্বরতা, বেড়ে উঠার প্রয়োজনীয় হরমোন। বেঁচে থাকার জন্য প্রতি পাতায় পাতায় গ্রহণ করছেন কার্বন ডাই অক্সাইড। মানুষের জন্য শোষণ করে সে কার্বন আবার পরিপাক করে বিলোচ্ছেন অক্সিজেন। মানুষ বাঁচছে। মানুষ আপনার গলার হীরের হার থেকে পেড়ে নিচ্ছে কচি ডাব। আপনার সন্তানকে আপনার সামনে দা দিয়ে কেটে ভেতর থেকে ঢকঢক করে পান করছে সুমিষ্ট পানীয়। মানুষকে তৃপ্ত করার আনন্দে আপনার বুকটা গর্বে ভরে উঠে। আপনি প্রস্তুতি নেন আবার আরেক কাঁদি ডাবকে পরিপুষ্ট করার জন্য।
আপনি কি একটা নারিকেল গাছ হবেন? একবারের জন্য কি একটা নারিকেল গাছের গর্ব হবেন? নিজেকে একবারের জন্য হলেও একটা নারিকেল গাছ ভাবুন। আপনি গাছের অহঙ্কার দেখে বিস্মিত হয়ে যাবেন।

নিজেকে কখনো আকাশ ভেবেছেন? আপনি স্পর্শপবিত্র নীল। আপনার বুকে অজস্র নক্ষত্র। সন্তানের মতো বুক আগলে তাদের ধরে রেখেছেন। প্রতি বিন্দু সময়ে একেকটা নক্ষত্র ঘুরপাক খাচ্ছে মহাকাশে, ছুটে চলছে মহাকাশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে অজস্র তারকারাজি। গ্যালাক্সিসুদ্ধ নিয়ম করে ঘুরছে নিজের বলয়ে। আপনার বুক থেকে ফুঁসে উঠছে ধুসর মেঘ, বৃষ্টি নামছে ধরার বুকে। আপনি নীলাকাশ। একবার ভাবুন নিজেকে, আপনি অনন্তকালের মহাকাশ।
একবার ভাবুন নিজেকে একটা পাখি। একবার একটা দালানের ইট ভাবুন। একবার একটা জানালা। যেখানে চোখ রেখে আপনিই তাকিয়ে দেখেন অবাক পৃথিবী। পৃথিবীর সবকিছুই বিস্ময়ে ভরপুর। কেবল আপনার দৃষ্টি থেকে বিস্ময় হারিয়ে গেছে। আপনি বিস্মিত হবার বাল্যশিক্ষা ভুলে গেছেন।
পাঁচ
বিপুল বিস্ময় নিয়ে বেঁচে থাকার মন্ত্রণা শিখতে হবে। মানুষ বিস্ময়ে বাঁচে। বিস্ময়ে সৃষ্টি করে নতুন নতুন। বিস্ময় যেদিন শেষ হয়ে যাবে, তারপর বেঁচে থাকা অর্থহীন। নিজের ভেতর বিস্ময় তৈরি করার উপাদান কখনো শেষ হতে দেবেন না। যখন বিস্ময়ের কমতি পড়ে যাবে জীবনে, চলে যান কোনো নিরুদ্দেশ। দূরে, হয়তো ভিন্ন লোকালয়ে; কিংবা লোকালয় ছেড়ে অন্য কোথাও। সাগরের কাছ থেকে বিস্ময়ের দীক্ষা নিন, দীক্ষা নিন বিরাট বিভূতিমান পাহাড়ের কাছ থেকে। অরণ্যের কাছে যান, মানুষের কোলাহল থেকে তুলে আনুন বেঁচে থাকার বিস্ময়। পথ থেকে কুড়িয়ে নিন বিস্ময়, প্রেমিকার ঠোঁটের কম্পন দেখেও দীক্ষা নিতে পারেন ঘোরলাগা বিস্ময়ের। মোটমাট সহজকথায়, পৃথিবীতে বিপুলা হয়ে বাঁচতে হলে, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে বেঁচে থাকতে হলে আপনাকে বিস্মিত হতে হবে প্রতিনিয়ত। ওটাই জীবন! বিস্ময়হীন যাপিত জীবন কেবলই শকটচাকা।
জীবন যখন আর কিছুতেই বিস্মিত হবে না, এবার তবে ছুটি নিন। বন্ধু, আলবিদা!
প্রতিভা থাকলেই সেটাকে কাজে লাগাতে হবে, এমন ভাবাটাও বোকামি। কিছু প্রতিভা অকেজো থাকবে, কিছু প্রতিভা ধ্বংস হোক। কিছু প্রতিভা পৃথিবীর বিস্ময় দেখে দেখে কাটিয়ে দেবে জীবন। পৃথিবীর বিস্ময় দেখার জন্য যে প্রতিভা দরকার, সে-ও বা ক’জনের আছে!
যারা আঁকছে, যারা লিখছে, যারা নির্মাণ করছে তারা বিস্ময়হীন। যারা হাসছে, যারা হাঁটছে, যারা সৃষ্টি করছে, যারা খবরহীন কোথাও কোথাও চলে যাচ্ছে— তারাই জীবনের আলেক্সান্দার। তারা বিস্ময় কুঁদে তুলে আনছে অসংখ্য জীবন বেঁচে থাকার তুমুল আবেহায়াত! তাদের কাছেই জেনে নিন, বিস্ময়ে বিপুলা হয়ে বেঁচে থাকবার গুপ্ত সবক!
ইজানিশেন মানেই তো বিস্ময়।
