হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন একজন সন্ত ব্যক্তি, একভাবে দেখলে আমার কাছে এমনটিই মনে হয়। তাকে নিয়ে নানা কথা আছে, মানুষ তাকে নিয়ে নানা কথা বলতে পছন্দ করে, তার সাহিত্যকর্মকে নাক সিঁটকানো লোকেরও অভাব নেই। কিন্তু মানুষকে মুগ্ধ করার তার যে দক্ষতা, লেখার ভেতর দিয়ে মানুষের মনোজগতকে বদলে দেবার যে ক্যারিশমাটিক ক্ষমতা; এ কেবল একজন ধ্যানমগ্ন দরবেশের সঙ্গেই তুলনা করা যায়।
তার জনপ্রিয়তার কথা বাদ থাক, ও নিয়ে কথা বলতে গেলে ঢের বলতে হবে। যেভাবে একক সাম্রাজ্য শাসনের নজির তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন, বাংলাদেশে আর কোনো লেখক তো বটেই অন্য কোনো প্রবল ব্যক্তিত্বও তার মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেননি। না কোনো নায়ক বা নেতা, না কোনো গায়ক বা সেলিব্রেটি। সাহিত্যের অঙ্গনে জনপ্রিয়তায় তার ধারে কাছেও কেউ ছিলো না।
তার এমন জনপ্রিয়তার কারণ কী? খুব সাধারণ একটি ধারণা— সমাজের সাধারণ মানুষের কথাকে একটু অন্যরকম করে বলা। এই যে ‘অন্যরকম করে বলা’, এটাই তাকে আর সবার চেয়ে আলাদা করে উচ্চকিত করেছিলো। সাধারণ মানুষের কথা সৈয়দ শামছুল হক, ইমদাদুল হক মিলন, জাফর ইকবালসহ আরও অনেকেই বলেন; কিন্তু অন্যরকম করে বলাটাই হলো আর্ট। এটাই তার জনপ্রিয়তার মূল কারণ। গল্প সবাই বলতে পারে, কিন্তু মানুষকে মুগ্ধ করার মতো গল্প বলাটা সবাই পারে না।
সাধারণভাবে আমরা যখন সবার সঙ্গে বসে গল্প বলি তখন আমাদের হাত, মুখ, চোখসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নানা ধরনের প্রকাশভঙ্গি থাকে। একেকজনের অঙ্গভঙ্গি একেকরকম এবং বলার ভঙ্গিও আলাদা। যে নিজের আঙ্গিক দক্ষতা দিয়ে গল্প বলতে পারে, তিনিই বেস্ট স্টোরি টেলার। কিন্তু লেখার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি প্রকাশ করা অনেক কঠিনসাধ্য ব্যাপার। কেননা লেখার মধ্যে কেবল কালো অক্ষর দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করতে হয়। এখানে হাত-পা, চোখ-মুখের কোনো অঙ্গভঙ্গি প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। এ কারণে কালো অক্ষরের গল্পের মধ্যেই এমনভাবে গল্প বলতে হয় যাতে পাঠকমাত্রই লেখকের গল্প বলাতে আকৃষ্ট হয়ে যায়। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন এই গল্প বলার উস্তাদ।
হুমায়ূন আহমেদ তার বহু উপন্যাসে প্রচুর আধ্যাত্মিক চরিত্র এনেছেন। মূলত তার শৈশব-কৈশোরের একটা বিরাট অংশ প্রভাবিত ছিলো আধ্যাত্মিক বিষয়াদি দিয়ে। তার নানা, মামা এবং আরও বেশ কিছু আধ্যাত্মিক চরিত্রকে তিনি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। এগুলো পরবর্তীতে তাকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিলো। তার প্রায় উপন্যাসে অতিপ্রাকৃত (সুপার ন্যাচারাল) নানা বিষয় আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। অধিকাংশ বিষয়কেই তিনি অমীমাংসিত রেখেছেন।
কখনো বিজ্ঞানের মাধ্যমেও তিনি অতিপ্রাকৃত বিষয়ের সমাধানের চেষ্টা করেছেন আবার কখনো দেখিয়েছেন, বিজ্ঞানও অনেক জায়গায় ব্যর্থ। রসায়নে পিএইচডি করা তার মতো ব্যক্তির বিজ্ঞানের ওপর থেকে আস্থা হারানো তার আধ্যাত্মিকতাকে আরও প্রবলভাবে প্রকাশ করেছে। বিজ্ঞান যখন চাঁদে মানববসতি স্থাপনের তোড়জোড় করছে, তখন তিনি ভরা পূর্ণিমা জোছনায় ঋষি সিদ্ধার্থের মতো গৃহত্যাগের প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রাত পার করেছেন। বিজ্ঞান এবং ন্যাচারাল ও সুপার ন্যাচারাল ব্যাপারকে তিনি যেভাবে যুত্থবদ্ধ করেছিলেন, এ সময়ের তরুণ-তরুণীদের কাছে বিষয়টি নানাভাবেই আকর্ষণ করার মতো। সর্বোপরি, তার নিজস্ব গল্প বলার আলাদা একটা স্বকীয়তা তো ছিলোই।
তিনি নাগরিক মানুষ ছিলেন, পয়সা-কড়িরও কমতি ছিলো না। ইচ্ছা করলে ঢাকা শহরে বেশ অ্যাপার্টমেন্ট-ফ্ল্যাট কিনে দেদার করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তার অর্জিত প্রায় সকল অর্থ ব্যয় করেছেন তার নন্দনকানন নুহাশপল্লীকে প্রাকৃতিক বানানোর পেছনে। বর্তমানে নুহাশপল্লী পিকনিক স্পট হলেও হুমায়ূন আহমেদের কাছে এটা ছিলো ধ্যানস্থানের মতো। তিনি এখানে বৃক্ষ, পাখি, জলের কাছে আসতেন ধ্যান করতে। নাগরিকতা তাকে কখনোই তার আধ্যাত্মিকতা বিলীন করতে পারেনি।
তিনি ধার্মিক ছিলেন না, এ কথা বলা যতোটা সহজ— তিনি ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন না; এ কথা বলাটা একেবারেই অপাঙক্তেয়। এবং সবশেষ কথা হলো, তিনি যেভাবে ঐশ্বরিক চিন্তা করতেন সেটাকে ধার্মিকতার চেয়েও অনেক আগুয়ান বলে ধরে নেয়া যায়। এ কারণে তাকে ‘পাগড়ীহীন দরবেশ’ বললেও অত্যুক্তি হবে না।