জোরে পা চালিয়েও কাজ হলো না। নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। বেশ রাত। যার খোঁজে এসেছিলেন, তার বাড়ির সামনে এসে দেখেন, ঘরের বাতি নেভানো। তার মানে তিনি শুয়ে পড়েছেন ততক্ষণে। হয়তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন। এই অসময়ে তাকে আর ডাকাডাকি করাটা ভালো মনে করলেন না। কী আর করা! সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদি.) নিজের গায়ের চাদরটি খুলে ওই লোকের বাড়ির বাইরে বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন।

রাত আরও গভীর হলো। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই শুরু হলো মরুঝড়। প্রবল দমকা বাতাসে মরুর বালি পাক খেয়ে আছড়ে পড়তে লাগল যেখানে সেখানে। বালির ঝাপটা এসে লাগতে শুরু করল ইবনে আব্বাসের চোখে মুখে। রুক্ষ মরুঝড় থেকে বাঁচতে তিনি নিজের চাদর দিয়ে চোখ-মুখ ঢেকে বাড়ির বাইরে গুটিসুটি মেরে বসে রইলেন। তবু বাড়ির লোকদের ডাকলেন না।

একসময় ভোর হলো। ততক্ষণে থেমে গেছে মরুঝড়। পুবাকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। বাড়ির মালিক ফজরের নামাজ পড়তে ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। বাড়ির বাইরে এসে দেখেন, ইবনে আব্বাস তার বাড়ির সামনে চাদর বিছিয়ে বসে আছেন। তার চোখ-মুখ এবং সারা শরীর বালিতে আচ্ছন্ন। অনিদ্রায় লাল হয়ে আছে চোখ দুটো।

তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ওই ব্যক্তি আঁতকে উঠলেন। তিনিও সাহাবি। ইবনে আব্বাসের সম্মান তার কাছে কম নয়। তিনি হায় হায় করে বলে উঠলেন, ‘ইয়া আল্লাহ! হে নবীজির চাচাতো ভাই, আপনি আমার কাছে এভাবে…? আমাকে ডাকলেই পারতেন। অথবা আমাকে খবর দিলে আমিই বরং আপনার সঙ্গে দেখা করতে চলে যেতাম।’

ইবনে আব্বাস চাদর থেকে ধুলো ঝারতে ঝারতে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, ‘না, তা হয় না। আপনার কাছে একটি হাদিস শুনতে এসেছি। সুতরাং আমি আপনার মুখাপেক্ষী। আমারই দায়িত্ব আপনার কাছে আসার। নবীজির একটি হাদিস শোনার আশায় আপনার কাছে আগমন।’

এরপর ইবনে আব্বাস ওই সাহাবির কাছ থেকে উদ্দিষ্ট হাদিসটি শুনলেন।

সূত্র: আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসির: ১৩/৭৮

——–

এই উম্মতের সবচেয়ে বড় নেয়ামত তার জ্ঞান-অন্বেষা। উম্মতে মুসলিমার আত্মিক এবং জাগতিক সকল উন্নতির চাবিকাঠি লুক্কায়িত আছে তার জ্ঞান-সাধনায়। তার ইহ এবং পরকালীন মুক্তি প্রোত্থিত জ্ঞানের বহুমুখী বিস্তৃতির ছায়াতলে। এই জ্ঞান-সাধনার ফলেই যুগ যুগ ধরে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল আরব থেকে স্পেন, আফ্রিকা, হিন্দুস্তান পর্যন্ত। মুসলিমরা যে অঞ্চলে গিয়েছে, সেখানেই তারা প্রতিষ্ঠা করেছে বহুমুখী জ্ঞানের শত শত বিদ্যায়তন। ফলে ইতিহাসে নির্মাণ হয়েছে সোনালি শতাব্দী।

একজন ইবনে আব্বাসের জ্ঞান-অন্বেষার উদাহরণ এখানে বলা হয়েছে। কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে জ্ঞান-অন্বেষার এমন হাজারো দাস্তান ছড়িয়ে আছে। মক্কা, মদিনা, কুফা, দামেশক, বুখারা, সমরকন্দ, কর্ডোভা, আনাতোলিয়া, কাশগড়, হিন্দুস্তান―এমন প্রতিটি মুসলিম শহরের দেয়ালে কান পাতলে এখনও শোনা যাবে সেই জ্ঞানের প্রতিধ্বনি। এই জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাঠ আর গবেষণার ফলশ্রুতিতেই রচিত হয়েছিল আমাদের অমর ইতিহাস। যে ইতিহাস নিয়ে আমরা এখনও গর্ব করি।

একসময় কী হলো? আমরা আমাদের জ্ঞান-অন্বেষাকে সংকুচিত করে ফেললাম। আমরা পাঠ্যপুস্তকের নির্দিষ্ট একটা গণ্ডির মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ করে ফেললাম। এর বাইরে অন্য সকল জ্ঞান আমাদের কাছে হলো পরিত্যাজ্য। ফলাফল যেটা দাঁড়াল, আমরা আমাদের বিধিবদ্ধ জ্ঞানের ক্ষুদ্র বেষ্টনীতে আটকা পড়ে গেলাম আর আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রদর্শিত বাদবাকি সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান আয়ত্ত করে নিল বুনো পশ্চিম।

বিগত দুই-তিন শতাব্দীতে আমাদের জ্ঞান নিয়ে বুনো পশ্চিম ইউরোপে সৃষ্টি করল রেনেসাঁ, শিল্প বিপ্লব, আমেরিকা তৈরি করল যন্ত্র সভ্যতা। একটা টিকার জন্যও এখন আমাদের পাশ্চাত্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়―তারা আবিষ্কার করে দান করলে তবেই না আমাদের রোগমুক্তি হবে!

আর আমরা আজ কেবল পূর্বপুরুষদের সেইসব জ্ঞান আর ইতিহাস নিয়ে বড়াই করে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলে নিজেদের নপুংসকতা ঢাকার চেষ্টা করি। এগুলো আমাদের লজ্জাজনক কর্মকাণ্ড। ‘অমুক শহর আমাদের ছিল’ ‘অমুক জিনিস মুসলিমদের আবিষ্কার’ ‘অমুক সভ্যতা আমাদের নির্মাণ’―এসব বুলি কপচানো আমাদের ‘বদঅভ্যাসে’ পরিণত হয়েছে।

এসব সস্তা বুলি কপচানো ছেড়ে আমাদের উচিত আবার জ্ঞান-সাধনায় ডুব দেয়া। ধর্মীয় জ্ঞান এবং জাগতিক জ্ঞানের মিশেলে যে সভ্যতা তৈরি করেছিল আমাদের পূর্বসূরীরা, আমাদের আবার সে পথেই হাঁটতে হবে। অযথা সস্তা আবেগ আর বুকভাঙা হা-হুতাশ আমাদের কোনো কাজেই আসবে না। যদি না আমরা নিজেরা জ্ঞানের পথে হাঁটি।