৮৪০ খ্রিষ্টাব্দের এক ভোরবেলা।
বাল্টিক সাগরের পশ্চিম তীর ঘেঁষে এগিয়ে এলো জাহাজটি। আটলান্টিকের পূর্ব উপকূল ধরে টানা কয়েকদিন চলার পর নর্থ সি পাড়ি দিয়ে জাহাজের কাপ্তান জোয়ান ডি উলফ ঢুকে পড়েছে বাল্টিক সাগরের নিস্তরঙ্গ জলরাশিতে। নর্থ সি থেকে বাল্টিক সাগরে প্রবেশ করা বরাবর তাঁর অপছন্দের কাজ। স্কটিশ আর ইংলিশ উপকূল পার হয়ে করসরের গ্রেট বেল্ট নামের সরু একটা খাঁড়ি দিয়ে ঢুকতে হয় বাল্টিক সাগরের লম্বা মাথাটায়। এখান দিয়ে বাল্টিক সাগরে ঢুকলেই তাঁর মনের মধ্যে কেন যেন একটা অনাহূত ভয় এসে শিরশির করে ওঠে। আবার অজানা একটা চাপা আনন্দও গুঙিয়ে ওঠে ভেতরে। আজও হয়েছে। ব্যাপারটা কেন হয়, সে জানে না।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এ অঞ্চলটা পশ্চিমের আটলান্টিকের চেয়ে খানিকটা উষ্ণ। চারদিকে নিচু পাহাড় আর ঘন জঙ্গল থাকায় উত্তর মেরুর হিম ঠাণ্ডা খুব একটা কাবু করতে পারে না পরিবেশকে। যদিও এখন শীতের মৌসুম, জাহাজের ডেকে দাঁড়ানো কাপ্তান জোয়ান ডি উলফ মাথা থেকে হ্যাট খুলে ফেলেছে। এস্তোনিয়ার দিক থেকে আসা মৃদু বাতাসে উড়ছে তাঁর ধুসর লালচে চুলের প্রান্তদেশ। ভোরের মৃদু আলোয় পশ্চিম উপকূলের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে সে। দু’হাত পেছনে, ভোরের ধুসর আলোয় পেছন থেকে তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে ক্যাসাব্লাঙ্কার উপকূলে দাঁড়ানো সটান লাইটহাউজ।
পালে বাতাস লাগছে না খুব একটা, কয়েকজন দাসমাল্লা হালকা চালে বৈঠা চালাচ্ছে নিচের পাটাতনে বসে। জাহাজের কাঠের খোলে ছলাৎ শব্দ শেষ না হতেই পুনর্বার আবার একই ছন্দ শব্দ করে ভেঙে দিচ্ছে ভোরের নিষ্কম্প নীরবতা। জাহাজের চিফ মেইড ল্যান্ডমে নিজের কেবিন থেকে বাইরে এসে কাপ্তানকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পেছনে এসে দাঁড়ালো। একবার গলা খাঁকাড়ি দিয়ে জানতে চাইলো, ‘জাহাজ কি ন্যাট্টারো দিয়ে ঢুকবে নাকি লুসটেন দিয়ে?’
চিফ মেইডের কথায় কাপ্তানের মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। শুধু ছোট্ট করে মাথাটা একবার সামান্য উঁচু করে পশ্চিম উপকূলের দিকে ইঙ্গিত করলো। জোয়ান কথা কম বলে। ল্যান্ডমে ওটুকু মাথা নাড়ানোতেই বুঝে গেলো তার করণীয় নির্দেশনা। সতেরো বছর ধরে সে প্রতিদিন একটু একটু করে শিখেছে জোয়ানের মাথা নাড়ানোর সারমর্ম। বছরের পর বছর ধরে সাগরের উত্তাল ঢেউ আর আকাশের নীলাদ্রি সীমানার মাঝে জোয়ানের সঙ্গে জাহাজ নিয়ে ঘুরেছে সে পুরো আটলান্টিক, নর্থ সি, বাল্টিক সাগরের অসংখ্য নাম না জানা খাঁড়ি আর নদীতে। অসংখ্য অভিযানে একজন লড়েছে আরেকজনের পায়ে পা মিলিয়ে। জোয়ানের জন্য নিজের বুক পেতে দিয়েছে শত্রুর তির আর তলোয়ারের কোপের নিচে। জ্বলন্ত শত্রুজাহাজের মধ্যে ঢুকে পড়েছে কখনো। হাসতে হাসতে শত্রুর গলা আর ধর আলাদা করেছে জোয়ানের চোখে চোখ রেখে। জোয়ানের জন্য জীবন বাজি ধরতে হাজারবার প্রস্তুত সে।
তবে তার সঙ্গে কাপ্তান জোয়ানের সম্পর্কটা মুনিব আর ভৃত্যের। কিন্তু সে কি জোয়ানের বন্ধুর চেয়ে কোনো অংশে কম? সাগরবক্ষে জাহাজ লুটতে গিয়ে যতোবার সে জোয়ানের প্রাণ বাঁচিয়েছে, তা কি শুধু একজন ভৃত্যের দায়িত্ব? এর বেশি কিছু নয়? প্রায়ই সে একা একা ভাবে- জোয়ান কি কখনো তাকে তার বন্ধু হিসেবে ভাববে না? একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ল্যান্ডমে জাহাজের ডেক ছেড়ে নিচে চলে গেলো।
ভয়ঙ্করদর্শন জাহাজটি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢুকে গেলো ন্যাট্টারোর ছোট বড় অসংখ্য দ্বীপবেষ্টিত গোলকধাঁধার মধ্যে। নতুন কেউ জাহাজ নিয়ে এ দ্বীপের অভয়ারণ্যে এলে নির্ঘাত গোলকধাঁধায় আটকে থাকবে দিনের পর দিন। বিশ মাইল এলাকাজুড়ে ছোট বড় প্রায় হাজারখানেক দ্বীপ দিয়ে ঘেরা এ সুইডিশ উপকূল। প্রাকৃতিকভাবেই এখানে তৈরি হয়েছে এ অঞ্চলের জলদস্যুদের লুকিয়ে থাকার এক নিরাপদ অভয়ারণ্য। জোয়ান ডি উলফও বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় এ উপকূলীয় অভয়ারণ্যে এসে অবসর কাটায়। সাগরের নোনাপানি আর নৌ লড়াইয়ের অসংখ্য ক্ষত নিয়ে তার জাহাজ ধুঁকতে ধুঁকতে আসে এখানে। জাহাজের প্রয়োজনীয় মেরামত আর সঙ্গী দস্যুদের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে প্রায় মাসখানেক থাকে এখানে। তারপর তাজাদম হয়ে আবার বেরিয়ে পড়ে ইংলিশ, স্প্যানিশ কিংবা পর্তুগিজ জাহাজ লুটতে।
তবে এবার সময়ের অনেক আগেই চলে এসেছে সে। আসতে হয়েছে ভিন্ন কারণে। প্রতিবার এখানে আসার সময় অবসরের আনন্দে তার মন চনমন করতে থাকলেও এবার হৃদয় ব্যথায় ভারী হয়ে আছে। অব্যক্ত কষ্টে গত কয়েকদিন কারো সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। দস্যুদের চোখে কখনো জল আনতে নেই, কিন্তু হৃদয়ের কান্না তো সকল লৌকিকতার আড়াল। তার হৃদয় তো দস্যু নয়। সে হৃদয়েও ভালোবাসা মুকুর ফোটায়, প্রেম এসে ঢেউয়ের মতো ঝাপটা দিয়ে যায়, বন্ধুর মৃত্যু-কান্না আছড়ে পড়ে নীরবে।
জোয়ান ডি উলফের চোখের কোণে এক বিন্দু জল এসে দৃষ্টি ঝাপসা করে দিলো। সে চোখ বন্ধ করে শেষবার বন্ধু হাশিম আল-হিলালের চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করলো, পারলো না। মৃত মানুষের চেহারা এতো সহজে চোখে ধরা দেয় না। বুকভাঙা কান্না বের হতে চাইলো, কিন্তু নিজেকে দমিয়ে রাখলো সে। হাজার হাজার মানুষের লাশ দেখেছে সে, শত শত মানুষ নিহত হয়েছে তার জাহাজের পাটাতনে। আজ সেই জাহাজে করে সে তার বন্ধুর লাশ বয়ে নিয়ে এসেছে বাল্টিক সাগরের এই জনবিরল উপকূলে। হাশিমের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে সমাহিত করতে এসেছে রজারবার্গের সেই বুনোফুলে আচ্ছাদিত নির্জন পাহাড়ের পাদদেশে। একবার নিজেই স্বগতোক্তি করলো মনে মনে- ‘হাশিম, বন্ধু আমার! আমি তোমাকে তোমার ভালোবাসার কাছে নিয়ে এসেছি! বুনোফুলের সুবাস পাচ্ছো? আমি আমার কথা রেখেছি বন্ধু…!’
সলসিডানের ঘন অরণ্যের ভেতর দিয়ে জাহাজ এগিয়ে যেতে লাগলো রজারবার্গের বুনোফুলে আচ্ছাদিত উপত্যকার দিকে।
[ আরও কয়েকটা পর্ব লেখার ইচ্ছা আছে। মুসলিম ইতিহাসের একটি বিশেষ ঘটনাকে তুলে ধরতে এ ফিকশনের জন্ম। ইতিহাসের সত্য নিয়ে নিতান্তই ফিকশন তৈরির চেষ্টা। ]