সোস্যাল মিডিয়া নিয়ে কিছু জরুরি কথা বলি। সে কথা বলার আগে নিজের সাম্প্রতিক একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করি সবার সঙ্গে।
এ বছর (২০২১) জুন মাসের গোড়ার দিকে আমি ফেসবুকে আমার স্বর্গীয় আইডি (ফেসবুক কর্তৃক ডিজ্যাবল) থেকে অ্যাডলফ হিটলারের একটি ছবি পোস্ট করি। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত চলছিল তখন। পোস্টে ইহুদিদের নিয়ে হিটলারের দু-চার লাইনের বাণীও জুড়ে দেই। ছবি ও লেখা পোস্ট করার কয়েক মিনিটের মধ্যে ফেসবুক থেকে আমাকে নোটিশ দেয়া হয়—আপনার পোস্ট করা ছবি ও লেখা ফেসবুকের ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের’ লংঘন করেছে। আপনি পোস্টটি মুছে ফেলুন। আমি তেমন গুরুত্ব না দিয়ে পোস্টটি বহাল রাখি। কয়েক ঘণ্টা পর আবার আমাকে নোটিশ এবং সতর্কবার্তা দেয়া হয়, আমার আইডি ব্যান করা হতে পারে। কী আর করা, পোস্টটি আমি ডিলিট করে দিই।
কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। পরদিন দেখি, আমার আইডি ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ডিজ্যাবল করে দিয়েছে এবং এক মাসের মধ্যে যথাযোগ্য কারণ দর্শাতে না পারলে আমার আইডি পার্মানেন্টলি ডিঅ্যাক্টিভেট করে দেয়া হবে।
ভালো এক ভেজালে পড়লাম। প্রায় ১২-১৩ বছরের পুরোনো আইডি, কত লেখাজোকা, ছবি, বন্ধু-বান্ধব, ফলোয়ার রয়েছে আইডিতে। এক হিটলারের ছবিতে ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের’ কী এমন ক্ষতি হলো! আমি যথাযোগ্য কারণ জানিয়ে ফেসবুকের হেল্প অ্যান্ড সাপোর্টে লিখিত দিলাম। ফেসবুক থেকে জানাল, করোনার কারণে আমরা লোকবল সংকটে আছি। এ কারণে আপনার ব্যাপারে খুব বেশি কিছু করতে পারছি না। আমাদের সময় হলে আমরা ব্যাপারটা দেখব। কিন্তু তারা আর আমার দিকে সুনজরে দেখেনি। আমি তাদের কাছে মূর্তিমান বাতিলের আতংক হয়ে উপস্থাপিত হলাম।
যাক, যা হবার হয়ে গেছে। আইডি যদি পার্মানেন্টলি ডিঅ্যাক্টিভেট হয়েই যায়, হলে হোক। ও নিয়ে আর কারো শরণাপন্ন হতে মন সায় দেয়নি। ফেসবুক জীবনযাপনের আবশ্যিক অনুষঙ্গ তো নয়, এছাড়াও জীবন বিউটিফুল!
এবং এ ঘটনার পর আমার আইডি পার্মানেন্টলি ডিজ্যাবল করে দেয়া হয়।
নিজের এই ফেসবুক পেজটা ছিল, এখানে হালকা হাজিরা জারি রেখে নিজের কাজ-কামে মন দিলাম। এর সঙ্গে ফেসবুক পেজটিতে আরেকটি জরুরি কাজ করলাম। এই পেজ থেকে আমার বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজন, সেলিব্রেটিজন, নিউজপোর্টাল, সংবাদপত্র—কাউকে ফলো না করে বিদেশি কিছু পছন্দের পেজে ফলো দিলাম শুধু। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, নাসা, নেচার, বিজ্ঞান পত্রিকা, বিবিসি আর্থ, টেড টক ইত্যাদি অদুনিয়াদারী পেজ।
এর ফলাফল যেটা হলো, এই তামাম দুনিয়ার স্বাভাবিক কোনো খবরাখবর আমার কাছে আসে না। যেহেতু আমি সংবাদপত্র পড়ি না, ফেসবুক বা অন্যান্য সোস্যাল মিডিয়ায় যাতায়াতও বন্ধ করে দিয়েছি, ফলে দেশ-দুনিয়ায় কোথায় কী ঘটছে সে ব্যাপারে আমি থাকি অন্ধকারে। বিশেষত জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে লোকজন কী নিয়ে ক্যাচাল করছে, সেগুলো থেকেও আমি থাকি যোজন যোজন দূরে। নিজের প্রয়োজনে মাঝে সাজে পেজে দু-একটা পোস্ট দিয়ে আমি ফেসবুকে নিজের হাজিরা জারি রাখি মাত্র, ও নিয়ে পড়ে থেকে আর সময় নষ্ট করার প্রবণতা নেই।
মজার মজার ঘটনা ঘটছে এর পর থেকে। জাতীয় এবং অজাতীয় কোন বিষয় নিয়ে সোস্যাল মিডিয়া উত্তপ্ত হচ্ছে, কে কাকে মারছে ধরছে, কোথায় গালাগাল হচ্ছে, কোথায় টপিক উপচে পড়ছে, কোন বিষয় নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে—এসব আমি জানতে পারি আমার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে। কথা প্রসঙ্গে তারা যখন আমাকে জানায়, অমুক তো এই করেছে, তমুক তো শ্যাষ কিংবা ওই দেশে এই ঘটনা ঘটেছে, ওই সেলিব্রেটি এমন আকাম করেছে—তখনই কেবল আমি দুনিয়ার খবর সম্পর্কে ওয়কিফ হই। নিজেকে কেমন অন্ধ অন্ধ মনে হয়।
ফেসবুকে অদুনিয়াদারী নিউজফিড ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ সঠাৎ দুনিয়াদারী দু-একজন সেলিব্রেটির পোস্ট সামনে চলে আসে সাজেশন হিসেবে। দেখি, পপুলারিটি কামাইয়ের জন্য একেকজন কী না করছে! এদের কাজ-কারবার দেখলে মনে হয়, আমরা যেন অন্যের জন্য বেঁচে আছি। মানুষ আমাকে কী বলবে, আমাকে কীভাবে দেখবে, ফলোয়াররা কীভাবে আমার প্রতি আরও আকর্ষিত হবে, কীভাবে আমি আরও মহান মূর্তি ধারণ করতে পারব—এসব চিন্তা করেই আমাদের দিন চলে যায়। সোস্যাল মিডিয়ায় আমাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড অন্যকে খুশি করার জন্য। অন্যের লাইক-কমেন্ট পাওয়ার উদগ্র বাসনা আমাদের জীবনের একমাত্র মাকসাদ হয়ে গেছে।
এ কি একজন মানুষের কাঙ্ক্ষিত জীবন? অন্যের বাহবা পাওয়াই কি জীবনের লক্ষ্য? আমি আমার মতো কেন বাঁচি না? আমি যা করব, যা করতে আমার মন ভালোবাসে আমি তাই করব। এতে আমার ফলোয়ারদের ভালো লাগুক বা লাগুক, কী আসে যায়! আমি আমার জীবন যাপন করব। অন্যের কমেন্ট কেন আমার জীবনকে প্রভাবিত করবে? আই ডোন্ট কেয়ার! উপদেশ পাওয়ার জন্য অফলাইনে আমার বহু উপায় আছে, কোরআন-কিতাব আছে, শত শত বই-পুস্তক আছে, অন্যের কমেন্টে কেন আমার লাইফ আপ-ডাউন হবে? মাগনা জিনিস আমি বরাবর নাপছন্দ করি। সস্তার তিন অবস্থা—এ প্রবাদবাক্য শতভাগ সত্য!
পপুলারিটি মানুষের মানবিক প্রবণতা। কিন্তু এই সোস্যাল মিডিয়া আমাদের সেই প্রবণতাকে এমন উদোম করে ছেড়েছে যে পপুলারিটির জন্য আমরা যাচ্ছেতাই করে যাচ্ছি। লাইক, ভিউজ, সাবস্ক্রাইব, কমেন্ট, শেয়ার—এসব যেন আমাদের জীবনধারণের একেকটা মাধ্যম হয়ে গেছে। তর্ক-বিতর্ক, বিবাদ, নিজের মতকে সঠিক প্রমাণিত করার প্রবণতা আমাদের মাঝে তৈরি করছে জিঘাংসা। ফেসবুকই নির্ধারণ করছে কে আমার বন্ধু আর কে আমার শত্রু। যাকে আমরা পার্সোনালি জানি না চিনি না, শুধু ফেসবুকে কোনো তর্কের কারণে মুহূর্তে সে আমাদের শত্রু হয়ে যাচ্ছে। কেউ এসে আমাকে সমর্থন দিল বা আমার পণ্যকে ভালো বলল, সঙ্গে সঙ্গে সে আমার সুহৃদজন হয়ে গেল। অথচ এখানে সে সত্য বলছে না মিথ্যা বলছে বা তার ব্যক্তিগত চরিত্র কেমন—সেসব না দেখেই আমরা মানুষ বিচার করছি। সহমত-ভাই, ফলোয়ার, সাপোর্টারের প্যানপ্যানানি আমাদের পপুলারিটিকে উল্লম্ফিত করে।
মানুষের মনে পপুলারিটির স্বাদ একবার পয়দা হয়ে গেলে, সেটা আরও বাড়ানো একটা নেশায় পরিণত হয়। আর পপুলারিটি হারানোর ভয় তাদের কাছে মৃত্যু সমান!
এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসুন। নিজের জন্য নিজে বাঁচুন। ফেসবুকের জন্য বাঁচবেন না। ফেসবুকের স্ট্যাটাসের জন্য কাউকে বন্ধু বানাবেন না। ফেসবুকে ছবি আপলোড করার জন্য ঘুরতে যাবেন না। ইয়াম্মি লিখে খাবারের ছবি পোস্ট করার জন্য রেস্টুরেন্টে খেতে যাবেন না। নিজের চেহারা আর শারীরিক খোমা দিয়ে পপুলারিটি কামাই করার চেষ্টা করবেন না। যা করার নিজের জন্য করুন, নিজের ভালোলাগার জন্য করুন; ফলোয়াররা যেন আপনার জীবনের পরবর্তী পদক্ষেপকে প্রভাবিত না করে। ট্যুরে গিয়ে ক্যাচ ক্যাচ করে ছবি তুলে গরমাগরম ফেসবুকে পোস্ট করার তাগাদা না নিয়ে সবুজ আর প্রকৃতির কাছে গিয়ে চুপটি করে বসে থাকুন! প্রকৃতি আপনাকে অন্য এক জীবনের শিক্ষা দেবে।
আমার জন্য আলো জ্বেল না কেউ
আমি মানুষের সমুদ্রে গুনেছি ঢেউ
এই স্টেশনের চত্বরে হারিয়ে গেছি
শেষ ট্রেনে ঘরে ফিরব না