ধরুন—
একমনে ল্যাপটপে কাজ করছেন, অথবা শুয়ে শুয়ে বই পড়ছেন, অথবা বসে বসে মোবাইল টিপছেন; হঠাৎ আপনার মনে হলো কেউ আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। আপনি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন, একটি মেয়ে বালিশে মাথা রেখে আপনার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে কোনো কৌতূহল নেই, কোনো মুগ্ধতা নেই, কোনো দুঃখবোধও নেই; শুধু নিষ্পলক আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আপনি ভ্রূ কুঁচকে মেয়েটির দিকে তাকাতেই সে মুখ ভেংচি দিয়ে চোখ নামিয়ে অন্যদিকে পাশ ফিরে শুলো। আপনি কিছুটা অবাক হয়ে মনে মনে একটু মুচকি হাসলেন। আপনার কি মনে হচ্ছে, আপনি আবার নতুন করে এই মেয়েটির প্রেমে পড়ছেন?

ধরুন— 
রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেছে। ঘুম থেকে জেগে দেখলেন, আপনার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে একটি মেয়ে। নিপাট শঙ্কাহীন জুবুথুবু ঘুম। তার এলোচু্লে মুখের অর্ধেকটা ঢাকা, চুল ছড়িয়ে আছে আপনার বুকে, বালিশজুড়ে। মেয়েটির পিঠের নিচে আপনার হাত, অনেকক্ষণ একভাবে থাকার কারণে হাত ব্যথা করছে। কিন্তু আপনি হাত সরিয়ে নিতে পারছেন না। হাত সরাতে গেলেই মেয়েটির ঘুম ভেঙে যেতে পারে। আপনি মেয়েটির ঘুম ভাঙাতে চাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে, তার ঘুম ভেঙে গেলেই হারিয়ে যাবে কিছু হীরন্ময় মুহূর্ত।

আপনি মেয়েটির মুখ থেকে চুলগুলো সরিয়ে তার মুখের দিকে তাকালেন। তার গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। শিশুর মতো নিরুপদ্রব ঘুমন্ত মুখ। তার মুখটা দেখে আপনার বুকের মধ্যে কেমন হাহাকার জন্ম নিলো- আহা! এমন একটা মুখ বুকে নিয়ে আরও হাজারটা জীবন বেঁচে থাকা যায়!

ধরুন—
থাক, আর ধরাধরি করে লাভ নেই। যে দৃশ্যকল্প দুটো এখানে আঁকা হলো, এটা পড়ে আপনার কেমন লাগলো? ভালো লাগার কথা। বিবাহিতদের চেয়ে অবিবাহিতদের বেশি ইন্টারেস্টেড হওয়ার কথা এবং এটা তাদের জন্যই লেখা।

বিয়েপূর্ব প্রেম জিনিসটা তো এখন খুবই সস্তা! এতোই সস্তা যে, প্রেমিক জানে তার প্রেমিকার আরও দু-চারটে ‘পরপুরুষ’ আছে, আবার প্রেমিকাও জানে তার প্রেমিকের দু-চারটে ‘পরনারী’ ডালভাত। কী কুৎসিত মেন্টালিটি আমাদের! পশুবৃত্তি বলে যে কথাটা আমরা শুনি, এটা তো তার চেয়েও জঘন্যতম আচরণ। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, একটা প্রেম না করলে তার বন্ধুসমাজে সামাজিক স্ট্যাটাস থাকে না। এবং সেটা স্কুল থেকেই করতে হয়! কী বিশ্রী অবস্থা!!

কথাবার্তা বলার আগে মাওলানা তারিক জামিল সাহেবের একটা নীতিকথা জেনে নেই— যে সমাজে বিয়ে যতো ব্যয়বহুল হয়, সে সমাজে ধর্ষণ-ব্যভিচার ততো বেশি সহজ ও সস্তা হয়ে যায়!

আমাদের সমাজে বিয়ে নিয়ে বড় দুশ্চিন্তা। ছেলে-মেয়ে উভয়ের। তাদের পরিবার তো আছেই। আমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়, পরিচিতজন অনেককে দেখি— তাদের বিয়ের কথা বললেই তারা নাভীমূল থেকে দীর্ঘশ্বাস উগড়ে দিয়ে বলেন, বিয়ের জন্য এই পরিমাণ মান্থলি ইনকাম লাগবে, ক্যারিয়ার বিল্ডআপ করতে হবে, বাড়িতে এমন ঘর লাগবে, সমাজে স্ট্যাব্লিস্ট হতে হবে… নানা ধরনের ফাউল কথাবার্তা।

একটা দিন যাচ্ছে মানে আপনি নিজেকে একটা দিনের জন্য ঠকাচ্ছেন। আপনি যে টেনশন একা বহন করছেন, সে টেনশনের ভাগী হওয়ার জন্য আরেকজন আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। অথচ আপনি ‘বিয়ে’ নামক অদেখা ভয়ানক ক্যাপসুল গিলে তার কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছেন।

একটা হাদিসের ঘটনা বলি। এক সাহাবি তার বন্ধু আরেক সাহাবিকে বললেন, অমুকের মেয়েকে আমি বিয়ে করতে চাই। প্রস্তাবটা তুমি তার কাছে নিয়ে যাও। সাহাবি বন্ধুর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ওই লোকের বাড়ি গেলো। মেয়ের বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। মেয়ের বাবা পাত্রের ব্যাপারে শুনে বললেন, না, তাকে আমার পছন্দ নয়। তবে তুমি যদি আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাও তাহলে তোমার কাছে মেয়েকে বিয়ে দিতে প্রস্তুত।

সাহাবি কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, আমি রাজি। কনের বাবা কনের কাছে গিয়ে তার হ্যাঁ-সূচক মতামত নিয়ে সেখানেই দুজন সাক্ষীর সামনে তাদের বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। সাহাবি ফিরে এসে বন্ধুকে এ ঘটনা জানালে বন্ধু সহাস্যে তাকে মোবারকবাদ জানালো।

এই হচ্ছে বিয়ে। আর আমাদের সমাজে বিয়ে মানে জমিদারের মচ্ছব যেন। হাজারো ঢাকঢোল পেটাতে হয়। কয়েকদিন নবাবের খরচের মতো দেদার খরুচে বাহুল্য। স্ত্রীকে এটা দিতে হবে, আত্মীয়-স্বজনকে এটা খাওয়াতে হবে, অমুক শপিং করতে হবে, এতোজনকে দাওয়াত করতে হবে, গায়ে হলুদ, বৌভাত, ওলিমা, বিবাহোত্তর সংবর্ধনাসহ আরও অসংখ্য কাজ কারবার। এসবের বেড়াজালে আটকে একটা ছেলের বা মেয়ের সুন্দর একটা অনাগত জীবনের পথ শুধু শুধু দীর্ঘায়িত করার কোনো মানে হয়?
আপনার কি মনে হচ্ছে না, আপনি বিয়েকে ব্যয়বহুল এবং বয়সবহুল করছেন বলেই সমাজে ব্যভিচার ও অনৈতিক যৌনচারের প্রসার ঘটছে?

গ্রামের অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিতদের মধ্যে বিয়ে নিয়ে দুর্ভাবনার ট্যান্ডেন্সি কম। আমার চে বয়সে আট-দশ বছরের ছোট পাড়াতো কিছু ভাই-ভাতিজা এমন আছে, যারা এরই মধ্যে দুটো করে বিয়ে করে ফেলেছে। কী করবে, এক বিয়ে টেকেনি; মাস না ঘুরতেই আরেক বউ ঘরে তুলে এনেছে। কার এমন দায় পড়েছে এতো সমাজ, এতো লোকলজ্জার ফালতু সেন্টিমেন্ট আঁকড়ে ধরে নিজেকে ঠকানোর?

ছেলেদের জন্য বিয়ের পারফেক্ট বয়স, আমার মতে— ২৫।

এর থেকে যতো দেরি হবে ততোই নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন। জীবনের স্বাভাবিক গতি থমকে যাবে। কোনো কাজেই নিজেকে পারফেক্ট লাগবে না। ক্যারিয়ার, ইনকাম, স্ট্যাটাস ফালতু জিনিস। আপনার স্ত্রীর রিজিকের ভাগ্য আল্লাহ লিখে রেখেছেন। তার রিজিকের চিন্তা আপনাকে না করলেও হবে। ওটা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিন। আপনাদের কাজ হলো, ঝটপট একটা বিয়ে করে ফেলা। কোনোরকম বাহুল্য ছাড়া। এরপর মন দিয়ে ভালোবাসাবাসি। একজনের দিকে আরেকজনের অপলক তাকিয়ে থাকা। রাত দুপুরে ঘুম থেকে জেগে বুকের মধ্যে ফুটফুটে একটা মুখ আবিস্কার করে সারারাত জেগে থাকা।