সদরঘাটে বুড়িগঙ্গার পাড়টা রোমান্টিক। লঞ্চ টার্মিনালগুলো বেশ। মোটের ওপর পরিচ্ছন্ন বলা যায়। নদীর ধারে বলেই কিনা, ময়লা আবর্জনা সব নদীতে ফেলে দিলেই সাফ-সুতরো ঘাট। 

নদীর পাড় পাথরের স্ল্যাব দিয়ে বাঁধানো। বাঁধানো পাড়ে ঢালাই করা রেলিং। সেখানে আমি বসি মাঝেমাঝে। উপরে রঙিন টিনের চাল। রোদ-বৃষ্টির বালাই থেকে আরাম পেতে বেঘোরে লোক বসে থাকে রেলিংয়ের উপর। ঝিরঝির হাওয়া বয়। বর্ষা আর শরতের মৌসুমে নদীর জলটা খানিক ফরসা হয়ে আসে। বানের পানির সোঁদা গন্ধ টের পাওয়া যায় উত্তরের। এখন দুর্গন্ধ নাই জলের গায়ে। পাড়ের আবর্জনা থেকে যা একটু বদ গন্ধ উঠে। মানুষের সঙ্গে আমিও বসে বসে মানুষ দেখি।

প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর মচ্ছব হচ্ছে প্র্রতিনিয়ত। গুমগুম শব্দ করা লঞ্চ এসে ভিড়ে, আবার হুইসেল বাজিয়ে কোনোটা নিরুদ্দেশ হয় দৃষ্টি থেকে। যাত্রীরা আসে, পল্টুনে হাঁটে, লঞ্চে চড়ে নদীর বুকে হারিয়ে যায়। ছোট ছোট গোদারা নৌকা এপার ওপার করে লোকজন। জনপ্রতি পাঁচ টাকা। রিজার্ভ গেলে বিশ। ঘণ্টাপ্রতি দেড় শ। 

নৌকার যাত্রীরা যায়-আসে। আসে-যায়। আমি কর্মব্যস্ত মানুষের পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। কী প্রাণোচ্ছ্বল ছন্দে তারা চলে যায় শ্যামবাজার, বাংলাবাজার, মিটফোর্ড কিংবা নগরের গভীরতার দিকে। সবাই ব্যস্ত। রিকশাওয়ালা, আখের রস বিক্রেতা, ঝালমুড়িওয়ালা, কর্তব্যরত পুলিশ, নৌকার মাঝি, মোবাইল টিপতে থাকা যুবক, কারো অপেক্ষায় থাকা বোরকাপরা তরুণী…এরা সবাই জীবনের প্রয়োজনে ছুটতে ছুটতে এখানে এসে হাজির হয়েছে। আবার চলে যাবে অন্যকোথাও জীবনের তাগিদে। সবার চোখে চকচক করছে আগামী জীবনের হাতছানি। বহুরঙা রঙিন স্বপ্ন বুনে চলেছে গোপনে গোপনে। রাতে ঘুমোতে যাবে আগামী দিনের স্বপ্ন কাঁধে নিয়ে। ঘুম থেকে উঠবে জৌলুসে ভরা হৃদয় নিয়ে। তারপর আবার ছুটে চলা দিন থেকে দিনান্তে। ভরপুর জীবন।

এই নদীর পাড়ে আমি দুঃখ নিয়ে বসি। ঘাঁটাঘাঁটি করি। একজন মানুষের কথা মনে হয়। এই ভরপুর জীবনের মিছিলে আমার মনে পড়ে এমন কাউকে, যে প্রতিদিন ঘুম থেকে জাগে, কিন্তু দিনের শুরুতে তার কোনো স্বপ্ন থাকে না। সারাদিন তার জন্য কোথাও কেউ অপেক্ষা করে না। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে দু চোখে দেখে কেবল রাশি রাশি মরা পিঁপড়ে। ঘুমের মধ্যে সে কোনো স্বপ্ন দেখে না। সে আরেকটা দিনের জন্য জাগে, কারণ একটু পর ভোর হবে। এ কারণে নয় যে, আজকের দিনটাতে তার অনেক কিছু করার আছে। বেলা হয় বলে তার ক্ষুধা পায়। এমন নয় যে, তার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে। রাত হলে বিছানায় ঘুমোতে যায়। ব্যাপার এমনও নয় যে, শরীরের ক্লান্তি কিংবা মস্তিষ্কের নিউরন তাকে ঘুম পাড়ানোর জন্য প্রতীক্ষমাণ।

এমন একজন মানুষের চিন্তা আমি করি বসে বসে। একটা চরিত্র এখানে এসে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ। সে হাঁটে, কারণ তার দুটো পা আছে। গন্তব্যে যেতে হবে, এজন্য নয়। সে মুগ্ধচোখে মানুষ দেখে, তার চোখ এখনও কর্নিয়ার কথা শোনে বলে। প্রেমে পড়ার দৃষ্টির বৈধতা তার নেই। সে পৃথিবী ও সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে চিন্তা করে। কারণ তার চারপাশে পৃথিবী। এই চিন্তা ও ভাবনা বলার মতো মানুষ কোথাও নেই তার। সে ধার্মিক, সে নামাজ পড়ে, সে প্রার্থনা করে। কারণ, দীর্ঘ জীবনে সে এগুলো রপ্ত করেছে। উপরন্তু, পরকাল নিয়ে তার তেমন হতাশ্বাস নেই। 

এমন একটা চরিত্রের চিন্তা মনে এলে আমি চলে আসি সদরঘাট। টার্মিনাল নং ১-এর পূর্ব পাশে। পল্টুন নং ১৮। এম.ভি দেশান্তর। ঢাকা-চাঁদপুর-ঢাকা।