১৩৫৪ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাস।
মুলকে বাঙ্গালার রাজধানী পাণ্ডুয়া থেকে ২৩ মাইল দূরবর্তী একডালা দুর্গ। দুর্গ না বলে এটাকে বরং দুর্গনগরী বলাই ভালো। প্রায় ৬৫ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত একডালা দুর্গ। শাহী প্রাসাদ থেকে শুরু করে সেনানিবাস, প্রশাসনিক ভবন, হাট-বাজার, আবাসিক এলাকাসহ পুরো এক শহরের মতোই এ দুর্গ। আবার দুর্গটি প্রাকৃতিকভাবে দুর্ভেদ্য। তিন দিকে বালিয়া, চিরামতি ও মহানন্দা নদী দ্বারা এবং অন্যদিকে ঘন অরণ্য দ্বারা পরিবেষ্টিত। তাছাড়া দুর্গটি বিরাট এলাকাজুড়ে কাদামাটির তৈরি দেয়াল দিয়েও ঘেরা। ফলে, বাঙ্গালার অদম্য প্রকৃতি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে এ দুর্গকে করে তুলেছে অপরাজেয়।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে দুর্গনগরী একডালায়। এমন সময় শাহী প্রাসাদ থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন এক দরবেশ। ফরসা মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি আর পরনে পুরোনো আলখাল্লা, মাথায় প্যাঁচানো গামছা আর ঋজু পদক্ষেপে হাঁটার ভঙ্গি বলে দিচ্ছিল, কামেল লোক। দরবেশের পেছনে পেছনে আসছিল চার-পাঁচজন লোক। পোশাক দেখে তাদের বয়স ও পেশা বুঝার উপায় নেই। বুক আর বাহুর স্ফীতি দেখে মনে হচ্ছে সেনাবাহিনীর লোক, কিন্তু পোশাক আশাকে মনে হচ্ছে স্রেফ দরবেশের উৎসর্গিত শাগরেদ। তবে বাজারে ভীড়ের মধ্যে যদি তাদের পোশাকের নিচ থেকে ধারালো ছুরি বেরিয়ে আসে, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
রহস্যময় দরবেশ দুর্গ থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। বেশ খানিকটা হেঁটে পৌঁছে গেলেন দুর্গের পেছন দিয়ে বয়ে চলা মহানন্দা নদীর তীরে। হিজল গাছ আর নলখাগড়ার আড়ালে একটা ঘাট দেখা গেল, ঘাটে ছোট-বড় অনেকগুলো নৌকা ভিড়ে আছে। দরবেশ পেছনে তাকিয়ে তার শাগরেদদের বললেন, ‘তোমরা দুর্গে ফিরে যাও। আমি যথাসময়ে চলে আসব, আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না।’
হন্তদন্ত হয়ে কাছে এলো এক শাগরেদ, ‘মাফ করবেন জাহাঁপনা, আরেকবার ভেবে দেখুন বিষয়টা। এভাবে এতটা ঝুঁকি নিয়ে একা নদী পার হয়ে পাণ্ডুয়া যাওয়া কি ঠিক হবে?’
দরবেশ তাকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘চিন্তা করো না সহদেব, আমার অন্তর সায় না দিলে আমি হয়তো যেতাম না। আমার অন্তর বলছে আমার কিছুই হবে না। সহি সালামতে আমি আবার একডালা দুর্গে ফিরে আসতে পারব। তা ছাড়া, দরবেশ রেজা বিয়াবানি আমার মুরশিদ, আমার পীর কেবলা। তার জানাজায় যদি আমি শরিক না হতে পারি, নিজেকে আমি ক্ষমা করতে পারব না কোনোদিন। তার বরকতের হাত এখনও আমার মাথায় ছায়া দিয়ে আছে।’ বলতে বলতে দরবেশের চোখ ছল ছল করে উঠল।
কম বয়সী এক শাগরেদ এগিয়ে এসে হাত ধরে ফেলল দরবেশের, ‘আব্বাজান, কিন্তু পরিস্থিতি আপনাকে বুঝতে হবে। নদীর ওপারে দুই লাখ সৈন্য নিয়ে ছাউনী ফেলে আছে দিল্লির সম্রাট ফিরোজ শাহ তুঘলক। তিনি যদি কোনোভাবে জানতে পারেন আপনি একডালা দুর্গ থেকে বেরিয়ে পাণ্ডুয়া গেছেন, আপনাকে গ্রেফতারের জন্য পুরো পাণ্ডুয়া শহর তিনি তছনছ করে ফেলবেন। আপনাকে বন্দী করে খুব সহজেই তিনি একডালা দুর্গ দখল করে ফেলতে পারবেন।’
দরবেশ নিজের ছেলের কাঁধে হাত রেখে মমতা নিয়ে বললেন, ‘বেটা, বিশ্বাস কী জিনিস, জানো? বিশ্বাস হলো নিজের অন্তরকে ভয়শূন্য করা। তুমি যা বিশ্বাস করো সেটা করতে কখনো ভয় পাবে না। হজরত বেলাল (রাদি.) যখন এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস করেছিলেন, তখন মক্কার কাফেরদের শত জুলুম অত্যাচার সহ্য করেও বলে গেছেন আহাদ, আহাদ! আমার নিজের ওপর আমার সেই বিশ্বাস আছে। আমি যদি সত্যের ওপর অটল থাকি তবে আল্লাহ কোনো প্রকার বিপদাপদ ছাড়াই আমার মুরশিদের জানাজা শেষে আমাকে ফিরিয়ে আনবেন। যাও, দুর্গে গিয়ে তোমার মা-বোনদের সান্ত্বনা দাও, তাদের পাশে থাকো।’
দরবেশ কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ছোট একটা ছিপ নৌকার দিকে এগিয়ে গেলেন। নৌকায় একজন বিশ্বস্ত মাঝি বসে ছিল আগে থেকেই, তিনি নৌকায় উঠলে সে নৌকার মাথা ঘুরাতে শুরু করল। এমন সময় হালকা পাতলা গড়নের এক দরবেশ দৌড়ে এসে উঠে বসল নৌকার পাটাতনে। দরবেশ তাকে বাধা দিতে দিতে বললেন, ‘কী করছো বায়েজিদ খাঁ? নৌকা থেকে নেমে যাও। ছোট নৌকা, ডুবে যাবে তো!’
দরবেশ বায়েজিদ খাঁ ততক্ষণে নৌকার মাঝখানে শান্ত হয়ে বসে পড়েছে। সে প্রৌঢ় দরবেশকে বললেন, ‘দয়া করে আর কোনো কথা বলবেন না জাহাঁপনা! আমাদের একজনকে অন্তত আপনার সঙ্গে যেতেই হবে। আপনার জীবন-মরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই মুলকে বাঙ্গালার ভবিষ্যত। সমগ্র বাঙ্গালার প্রথম স্বাধীন সুলতান আপনি, আপনার কিছু হয়ে গেলে বাঙ্গালার স্বাধীনতার সূর্যও অস্তমিত হয়ে যাবে। আপনার নিরাপত্তার জন্য আমাদের একজনকে অন্তত সঙ্গে যেতে হবে।’
দরবেশবেশী বাঙ্গালার প্রথম স্বাধীন সুলতান শামছুদ্দিন ইলিয়াস শাহ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, ‘ঠিক আছে, তুমি যা ভালো মনে করো। আমি আমার জন্য অন্য কারো জীবন বিপদে ফেলতে চাইনি।’
নৌকা চলতে শুরু করেছে। নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন সুলতান ইলিয়াস শাহ। হাতের ইশারায় তাদের চলে যেতে বললেন দুর্গে। দরবেশের ছদ্মবেশ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেনাপতি সহদেব রায়, মন্ত্রী ইবরাহিম আলি আর ছেলে সিকান্দার শাহও হাত নাড়ল সুলতানের প্রতি।
দরবেশের ছদ্মবেশে তারাও যেতে চেয়েছিল সুলতানের সঙ্গে। পাণ্ডুয়ার আধ্যাত্মিক পীর রেজা বিয়াবানির মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পর তার জানাজায় অংশ নিতে সুলতানকে বাধা দেওয়া সম্ভব হবে না জেনে তার সেনাপতি ও সভাসদরা দাবি জানিয়েছিল, দিল্লি বাহিনীর অবরোধের এই দুর্যোগকালীন সময়ে পাণ্ডুয়ায় যেতে হলে অবশ্যই তাকে রাতের আঁধারে যেতে হবে এবং সঙ্গে পনেরো-বিশজন চৌকস সেনা নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সুলতান একবাক্যে সে প্রস্তাব না করে দেন। কেননা লোকসংখ্যা বেশি হলে তাদের ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তিনি একা নদী পার হয়ে নদীর ওপাশ থেকে একটি ঘোড়া নিয়ে পাণ্ডুয়া যাবেন এবং নিজ মুরশিদের জানাজা শেষ করে একাই ফিরে আসবেন। এবং তিনি যাবেন দরবেশের ছদ্মবেশে। দিল্লি বাহিনীর কাছে ধরা পড়লেও যাতে তারা তাকে চিনতে না পারে।
রাতের আঁধার কেটে মহানন্দার শান্ত জল বেয়ে তর তর করে এগিয়ে চলছে সুলতানের ছিপ নৌকা। লম্বা নৌকা, মাঝি যতটা সম্ভব কম শব্দে বৈঠা বেয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। নদীর অপর পাড়ে বামদিকে দূরে দিল্লির সম্রাট ফিরোজ শাহ তুঘলকের সেনাছাউনি চোখে পড়ছে। বিশাল সেনাছাউনি, ছাউনির এখানে সেখানে জ্বলতে থাকা মশালের আলোয় নদীর পাড় অনেকটা আলোকিত হয়ে আছে। পাহারাদার সৈন্যদের হাঁক ডাক শোনা যাচ্ছে এত দূর থেকেও।
সেদিকে তাকিয়ে মাথার মধ্যে দুঃসাহসী এক পরিকল্পনা করে ফেললেন সুলতান। নৌকার পাটাতনে বসে থাকা তরুণ বায়েজিদ খাঁর দিকে একবার তাকালেন সুলতান, পরক্ষণেই ভাবলেন, নাহ, এ পরিকল্পনা একা একাই বাস্তবায়ন করতে হবে। বায়েজিদকে বললে সে এখনই নানা কাণ্ড করে ফেলতে পারে।
—————-
বাংলার প্রথম মুসলিম স্বাধীন সুলতান শামছুদ্দিন ইলিয়াস শাহকে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার এরাদা আছে। বাদবাকি আল্লাহর মর্জি…
তথ্যসূত্র:
বাংলাপিডিয়া
তারিখে ফিরোজশাহি, জিয়াউদ্দিন বারানি
বাংলার ইতিহাস, আবদুল করিম
বাংলা দেশের ইতিহাস, রমেশচন্দ্র মজুমদার
বৃহৎ বঙ্গ, দীনেশচন্দ্র সেন
সিন্ধু থেকে বঙ্গ, মনযূর আহমাদ