আচ্ছা, লেখক হওয়ার জন্য কি জন্মগত কোনো গুণ লাগে নাকি চেষ্টা-সাধনার মাধ্যমেও এটি অর্জন করা যায়? এই প্রশ্নটা আমি নিজেকেই নিজে হাজারবার করি, প্রায়ই। নিজেই আবার এর উত্তর দেই। উত্তরটা কখনো এদিক কখনো ওদিক হয়। তবে আমি ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতোটুকু বুঝি, কবি-লেখক হওয়ার জন্য আসলে জন্মগত একটা লেখক সত্ত্বা না থাকলেই নয়। ওটা লাগে, না থাকলে আর যাই হোক ‘ভালো’ লেখক হওয়া যায় না।
আমাকে নানা সময় অনেক বন্ধু প্রশ্ন করে থাকেন, আমার লেখক হওয়ার খুব ইচ্ছা। কীভাবে লেখক হতে পারবো?
আমি তাদের উত্তর দিতে বিব্রত বোধ করি। ভিতরে ভিতরে হাঁস-ফাঁস করি। আসলেই তো, লেখক হওয়া যায় কীভাবে? আমি তখন চোখ বুজে বড় বড় লেখকদের জীবনী হাতড়াতে থাকি। দেখতে থাকি তারা কীভাবে লেখক হয়েছেন।
কিন্তু সমস্যা হলো, একজনের জীবনের গল্প আরেকজনের জীবনের গল্পের থেকে একেবারে আলাদা ম্যাটারিয়ালে গড়া। সবার জীবন গঠনই ভিন্ন ভিন্ন। রবীন্দ্রনাথ একভাবে লেখক হয়েছেন তো নজরুল আরেকভাবে, নাসিম হেজাযি এক সন্ধিক্ষণে তো আলি মিয়া নদভী অন্য সন্ধিক্ষণে, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এক মেরুতে তো ড্যান ব্রাউন আরেক মেরুতে। সুতরাং আমার ভাবনা আরও ভীত হয়ে পড়ে। তবে কি লেখক হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো স্ট্রাকচারই নেই?
আসলেই নেই। নবীন লেখকদের জন্য, যারা এখনো লিখবো লিখবো করছে, তাদের জন্য এই তথ্য যেমন হতাশার তেমনি আশাবাদেরও। আমি পরিপূর্ণ সৎ থেকে বলছি, লেখা-লেখি শেখার জন্য মূলত কোনো ধরা বাঁধা নিয়ম নেই। লেখা লেখি গুণটা জন্মগতভাবে নিয়ে আসতে হয় কিছুটা হলেও। তারপর সেই গুণটা তার চারপাশের পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক জীবনযাপন, উদ্বুদ্ধ হওয়ার নানা উপকরণের মাধ্যমে কখনো ধারালো হয়, আবার যদি সেই গুণটা উন্মেষের পরিবেশ না পায় তাহলে সেটি অনেক সময় অঙ্কুরেই মরে যায়।
এ কারণেই যারা নতুন লেখা-লেখির তালিম নিতে আগ্রহী তাদের জন্য আশাবাদের কথা বলছি। আগে আপনি জানুন যে, আপনার ভিতরে লেখক সত্ত্বা আছে কি-না। সেটা জানা যাবে খুব সহজেই। চট করেই ডায়েরী লেখার অভ্যাস করুন। সাতদিনের দিনপঞ্জি লিখে এমন কাউকে দেখান যিনি লেখা-লেখির ব্যাপারে সমঝোদার। তিনি যদি বলেন আপনাকে দিয়ে হবে, তাহলে তো কথাই নেই, আগে বাড়ুন। আর যদি বলে, মোটামুটি চালিয়ে নেয়া যায় তাহলেও দমে যাবেন না। হয়তো আপনার ভিতরের লেখক সত্ত্বা এখনও আপানার লেখা-লেখির যোগ্য কোনো মোটিভ বা উপকরণ পায়নি, যার কারণে আপনার লেখাটা সুন্দর বা সাবলীল হয়নি।
এখন আপনার কাজ হচ্ছে চারপাশের পৃথিবীটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ (অবজার্ভেশন) করা। তারপর দেখুন কোন বিষয়টি নিয়ে লিখতে আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। দিনপঞ্জি লেখা অনেকের ভালো নাও লাগতে পারে। কেউ হয়তো আকাশ নিয়ে লিখতে ভালোবাসে, কেউ ভালোবাসে মাকে নিয়ে, বোনকে নিয়ে, প্রিয় মানুষকে নিয়ে, কেউ হয়তো নদী-বিল-হাওড় নিয়ে লিখতে আগ্রহ বোধ করে, কেউ রাজনীতি, আর্তমানবতা, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি নিয়ে লিখতে পছন্দ করে, যার যেটা ভালো লাগে সেটা নিয়েই লেখা-লেখি চালিয়ে যাওয়া একান্ত কর্তব্য। যখন আপনি আপনার কলমের যোগ্য উপকরণ পেয়ে যাবেন তখন দেখবেন কলমের বা কিবোর্ডের ভিতর থেকে আপনা আপনিই বেরিয়ে আসছে তাজা তাজা উপাদেয় লেখা। ভয় পাওয়ার কারণ নেই।
আরেকটি বিষয় মনে রাখা খুব প্রয়োজন। লেখক বলেই আপনাকে সব বিষয়য়ে কলম চালাতে হবে বা সব বিষয়ে কলম চালনায় পারদর্শী হতে হবে- এমন কোনো আইন নেই এবং এমন কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। পৃথিবীর বড় বড় উপন্যাসিকদের বেশিরভাগই জীবনে এক লাইন কবিতা লিখেন নি। আবার শত শত কবি জীবনে একটা গল্পও লিখতে পারেন নি। সুতরাং আপনি যে বিষয়টি সবচে ভালো লিখতে পারেন সে বিষয়টি নিয়েই বেশি বেশি লিখুন। তাহলেই আপনি আপনার ক্ষেত্রে স্পেশালিস্ট হতে পারবেন। আর আপনি যদি সব বিষয়ে সমানতালে কলম চালাতে চান তাহলে আপনি কোনো বিষয়েই স্পেশালিস্ট হতে পারবেন না। আখেরে আপনি কলমসৈনিক না হয়ে হয়ে যাবেন কলম্বাস। যারা কলম দিয়ে নানা ধান্ধা-ফিকির করে বেড়ায়।
শেষমেশ যে কথাটি বলবো সেটি অনেকের কাছেই আনকোরা আজনবি লাগতে পারে, তবে আমি যতোটুকু বুঝি সেই ভাবনা থেকে বলছি- লেখক হওয়ার জন্য অনেকে বিভিন্ন ধরনের কোর্স করে থাকেন। এই কোর্স করা লেখক আমি আমার জীবনে খুব কম দেখেছি। কোর্স করে রিপোর্টার, প্রুফরিডার, সম্পাদক হয়তো হওয়া যায় কিন্তু লেখক হওয়া যায় কি না, সত্যি বলছি আমি জানি না।
তবে হ্যাঁ, কোর্স আপনাকে একটা সঠিক গাইড লাইন দিতে পারে চিন্তার, চেতনার। যেটি লেখা-লেখির জন্য উৎকৃষ্টমানের কাঁচামাল। কিন্তু কেউ যদি মনে করে, কোর্স করার পর সে একজন সত্যিকারের লেখকে পরিণত হবে তাহলে তাকে বোকার স্বর্গের আদিবাসী বলা ছাড়া আর কোনো গতান্তর থাকবে না। তাই কোর্সকে লেখক জীবনের সিঁড়ি না ভেবে লেখা-লেখির ট্রাফিক সিগন্যাল মনে করুন। আর বেশি বেশি অধ্যয়ন করুন পৃথিবীর সমস্ত বই। তারপর আপনার লেখক হওয়া ঠেকায় কে!