দুজন বন্ধুর কথা বলি। দুজনই আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন। উচ্চশিক্ষিত। সম্প্রতি তারা বড়লোক হওয়ার শর্টকাট রাস্তায় নেমেছেন।

একজন খুঁজছেন ‘তক্ষক’ নামের আজিব এক সরীসৃপ প্রাণী। দেখতে গিরগিটির মতো এ প্রাণির দাম নাকি শত কোটি টাকা! শুনে আমি তাজ্জব!! এ প্রাণির ভেতরে নাকি ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক কী এক দুর্ধর্ষ ক্ষমতা আছে, ড্রোন-ফাইটার প্লেন নামিয়ে ফেলা যায় মুহূর্তে। নাসা পর্যন্ত হন্যে হয়ে খুঁজছে এ প্রাণী!

একবার পেলেই হয় জাহাঙ্গীর ভাই, আপনারে দুই-চাইর দশ লাখ দিয়া সারাজীবন বসায়া বসায়া খাওয়াবো ইনশাআল্লাহ!
বন্ধু আমাকে আশ্বস্ত করেছে। দেশব্যাপী তার নেটওয়ার্ক কাজ করে চলেছে।

আরেকজন খুঁজছে প্রাচীন সীমানা পিলার। এও এক আজিব চিজ! এই সীমানা পিলার একসময় বৃটিশরা পুরো উপমহাদেশে নির্দিষ্ট দূরত্বে দূরত্বে স্থাপন করেছিলো বজ্রপাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে। কাজের জিনিস ছিলো, কাজ হতো ওতে।

বৃটিশরা চলে গেলেও তাদের পিলার রয়ে গেছে। এগুলোরও নাকি আশ্চর্য মহাকর্ষীয় ক্ষমতা আছে। মহামূল্যবান ধাতুতে তৈরি নাকি এসব পিলার। একবার পেলেই হয়, নাসার সঙ্গে সরাসরি ডিনারে বসার সুযোগ। কোটি তো কোটি, কোটির পরও দু-একটা শূন্য যোগ করার তাগিদ দিয়েছে বন্ধু আমার।

মজার বিষয় হলো— এই বন্ধু পিলার খুঁজতে অভিনব এক পদ্ধতি কাজে লাগিয়েছে। তার পরিচিত এক জিনসাধককে ধরে জিনের মাধ্যমে চলছে পিলার অনুসন্ধান। গায়েবের খবরাখবর জিন ভাই বেরাদাররা যদি দিতে পারে, সামান্য ধাতব পিলার তো নস্যি!

সে-ও আমাকে কোটি টাকার থোক বরাদ্দ দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ধন্য করেছে!

দুই
অর্থই কি মানুষকে প্রকৃত সুখ দিতে পারে? বিষয়টি নিয়ে আমি বেশ কিছুদিন থেকে ভাবছি। না, তাত্ত্বিক ভাবনা নয়, আমি আমার নিজেকে সামনে রেখে ভাবছি। আমার অনেক টাকা হলে আমি কি সুখী হবো? বড় বাড়ি বানাতে পারলে মা-বাবা কি আপ্লুত হবেন? প্রাণ খুলে আশীর্বাদ দেবেন আমায়? মাসে মাসে গয়না পেলে স্ত্রীর ভালোবাসা কি বৃদ্ধি পাবে? সন্তান চাহিবামাত্র দামি ফোন দিলেই কি আমার ভবিষ্যৎ সুখনিশ্চিত?

চারদিকে মানুষের ব্যস্ত জীবন। হন্যে হয়ে ঘুরছে মানুষ টাকা রোজগারের জন্য। সকাল হতেই অফিস যাচ্ছে একদল, একদল ব্যবসায় যাচ্ছে বিরাট বিজনেস করতে, একদল সন্তানকে বড় অফিসার বানানোর জন্য ভোর পাঁচটায় উঠিয়ে ইয়া বড় ব্যাগ কাঁধে দিয়ে স্কুলে পাঠাচ্ছে।

একদল তরুণ হন্তদন্ত হয়ে কোচিংয়ে যাচ্ছে, একদল যুবক হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে বিসিএস গাইডবুকে, একদল লোক আরও দামি চাকরির আশায় ইন্টারভিউ দিয়েই যাচ্ছে বছরের পর বছর। আট-দশ লাখ টাকা উপরমহলে দিতে তাদের মোটেও কুণ্ঠা নেই। আর একদল যুবক অস্ত্র নিয়ে হয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসী। সবাই টাকার লিপ্সায় বিভোর।
অথচ অর্থ যতোটা সুখ নিয়ে আসে, অ-সুখ নিয়ে আসে তার চেয়ে শতগুণ।

বিরাট ধনীলোক যারা, খোঁজ নিয়ে দেখুন— তার আর আপনার বেদনার মধ্যে খুব বেশি তফাত নেই। তার সুখী হওয়ার উপকরণ আর আপনার সুখী হওয়ার উপকরণে তেমন ব্যবধান নেই। মানুষের মৌলিক সুখের উপায় উপকরণ খুবই সীমিত। সে মৌলিকত্বে ধনী-গরিবের তেমন কোনো মানবিচার নেই।

বি ভেরি পজেটিভ— অঢেল অর্থোপার্জন মানেই সফল জীবন নয়। সফল জীবন সেটাই, আপনি নিজের জীবনকে যেভাবে দেখতে চান।

 

তিন
কেউ কখনো ভাবতেই শেখেনি— টাকাই সুখের একমাত্র মাধ্যম নয়। আমরা ছোটবেলায় ছড়া শিখি—
লেখাপড়া করে যে
গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে।

হোয়াট দ্য রং উইথ আস? লেখাপড়া কেন আমার গাড়ি-ঘোড়ার নিশ্চয়তা দেবে? আমার হাত আছে, পা আছে, কাজ শিখবো, কাজ করে খাবো। দিনশেষে লেখাপড়াকে কেন আমি রোজগারের মাধ্যম বানাচ্ছি? এখানে একটা বড় গলদ রয়ে গেছে।

পশ্চিমের এই ‘চাকরির জন্য শিক্ষা’ আর ‘ক্যারিয়ারের জন্য জীবন’ স্লোগান আমাদের শিক্ষিত সমাজকে একেকটা যন্ত্রে পরিণত করছে। একেকজন ছাত্র গ্র্যাজুয়েট হয়ে বের হচ্ছে মানে, একেকটা টাকা কামানোর মেশিন মাঠে নামছে। যেখানে যেভাবে পারছে, দলাই মলাই করে টাকা নিয়ে ঘরে ফিরছে। টাকার প্রশ্নে কোনো সততার মানদণ্ড নেই।

এই ট্যান্ডেন্সি ভেঙে ফেলা দরকার। শিক্ষাকে টাকা কামানোর অস্ত্র না বানিয়ে জ্ঞানার্জনের হাতিয়ার বানানোর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। যাতে করে, শিক্ষিত হওয়া মানেই যেনো আপনাকে টাকার পেছনে ছুটতে না হয়। শিক্ষা যেনো কারো জীবিকা অর্জনের একমাত্র অবলম্বন না হয়।

 

চার
কী অদ্ভুত সুন্দর পৃথিবী! একটা সকাল একা একা হেঁটে দেখুন, কেমন করে নতুন একটা দিন মলাট খুলছে আপনার সামনে!

রাতের বিপুলা মহাকাশের দিকে তাকান, নিজের মহত্ব টের পাবেন। স্রষ্টা কেন আপনাকে সবচেয়ে আশরাফ করে বানিয়েছেন, নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকলে বুঝতে পারবেন। বৃক্ষশোভা, তরুলতা, ঘাসের চোখ নেই, আপনার আছে। এই বিভূতি ভাগ্যগুণে মেলে।

প্রতিদিন সকালে নিজের ‘আমি’কে একবার করে ধন্যবাদ দিন, ‘আমি’ হয়ে জন্ম নেবার জন্য। নিজের মানবজন্মকে স্বার্থক ভাবুন, নিজের এমন সর্বশ্রেষ্ঠ মা-বাবার ঔরসে জন্ম নেয়ার জন্য। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে গভীর একটা নিঃশ্বাস নিন, তারপর চোখ বুজে বলুন—
জীবনের সুখ এখানে, এখানেই…!