রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়া, বিভিন্ন মুসলিম কান্ট্রি তো বটেই, জাতিসংঘ এবং বেশকিছু হাইপ্রোফাইল ডেভেলপড কান্ট্রিও তাদের ইনভলবমেন্ট জারি রেখেছে। এটা আশার সংবাদ নিঃসন্দেহে। কিন্তু এর মধ্যেও কিছু অযাচিত প্রশ্ন আপনার আমার চিন্তার দোরগোড়ায় অ্যাটাক করতে পারে।
ঘটনা হলো, রোহিঙ্গা ইস্যু কিন্তু নতুন সহিংসতা নয়। সাম্প্রতিক সহিংসতার চেয়ে অনেক ভয়াবহ সহিংসতা সেখানে গত পাঁচ বছরে সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু এবারই বিশ্বের লাটসাহেবরা একযোগে তাদের পাছা মোবারক উপর্যুপরি নাড়াচাড়া শুরু করেছেন। এর পেছনে একটি বেদনাদায়ক কারণ আছে।
সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে সবাই জানি, আরাকান অঞ্চলের নির্যাতিত মুসলিমরা নিজেদের সার্ভাইভালের জন্য একটি সশস্ত্র সংগঠন বিল্ডআপ করেছে, যার নাম- আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি, সংক্ষেপে ‘আরসা’। এই সংগঠন গত বছরখানেক আগে বেনামে বার্মিজ আর্মিদের ওপর অ্যাটাক করে বেশ কয়েকজন সোলজারকে হত্যা করে এবং এ ঘটনার পরবর্তীতে স্থানীয় রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর ভয়াবহ সহিংসতা শুরু হয়। গত মাসখানেক আগে এই ‘আরসা’ নতুন করে বার্মিজ সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ করে বেশ কয়েকজন বার্মিজ সেনাকে হত্যা করে, ফলশ্রুতিতে নতুন করে সহিংসতা শুরু হয় এবং সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের নরক গুলজার কায়েম হয়।
এ ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের সাইকোলজিক্যাল থট একেবারে সাফ- মরতেই যখন হবে তখন কয়েকটাকে নিয়ে মরি! দ্যাটস ইট! আরাকানিদের চিন্তার লেভেল যখন এ ধরনের দেয়ালে পিঠঠেকা অবস্থায় রুখে দাঁড়ানোর পজিশনে চলে এসেছে, বিশ্বমোড়লরা তখনই নড়াচড়া শুরু করলেন। কারণ, এতোদিন রোহিঙ্গা মুসলিমরা শয়ে শয়ে মারা গেছে, কার কি যায় আসে-এই ছিলো তাদের মনোভাব। কিন্তু সেখানে যখনই সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হলো তখনই তারা রোহিঙ্গাদের সবচে সমব্যথী হয়ে গেলেন। আজ ইন্দোনেশিয়ার ফরেইন মিনিস্টার আসছেন বাংলাদেশে, ইন্ডিয়ার প্রাইম মিনিস্টার যাচ্ছেন ইয়াঙ্গুন, মালালা ইউসুফজাই বাংলাদেশের প্রশংসায় স্তূতি ঝারছেন, আমাদের তোফায়েল আহমেদ এবং মোহাম্মদ হানিফ সাহেবরাও গোটা দশেক বুকডন দিয়ে যুদ্ধংদেহি মনোভাব নিয়ে মায়ানমার সরকারকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন; ওদিকে জাতিসংঘ তো কুলুর বলদ আছেই, আরও বিস্তর ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েটরা বাণী-টাণী দিয়ে ধুন্ধুমার অবস্থা। কক্সবাজারের উখিয়ায় না খেয়ে মরতে বসা রোহিঙ্গাদের মনে আহ্লাদে প্রশ্ন আসতেই পারে- ‘এতোদিন কোথায়া ছিলেন?’
অবস্থাদৃষ্টে যা দৃশ্যমান, এসব হেভিওয়েট পার্সনরা মূলত রোহিঙ্গাদের সমব্যথী হতে বড় বেশি ব্যথাতুর নন, তারা আতঙ্কিত ‘আরসা’ নামীয় বন্দুকবাজদের নিয়ে। সাধারণ রোহিঙ্গারা কুকুরের মতো না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে বহুকাল থেকেই। বাংলাদেশ আর কিছু না পারুক, নিজের সর্বস্ব সাধ্য দিয়ে তাদের আশ্রয়টুকু দিতে কখনো কসুর করেনি। প্রায় ছয় লাখের অধিক রোহিঙ্গা বর্তমানে বাংলাদেশের রিফিউজি ক্যাম্পগুলোতে বসবাস করছে। কে এতোদিন খবর নিয়েছে তাদের? কিন্তু যখনই সংগঠিতভাবে সশস্ত্র ‘আরসা’র উদ্ভব ঘটলো তখনই সবাই টং করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কিছু একটা করতেই হবে-ডু ইট নাউ!
এখন প্রশ্নটা আপনাকে করতেই হবে, বিশ্ব কি আসলেই রোহিঙ্গাদের নিয়ে কিছু করতে চাচ্ছে? নাকি সালভেশন আর্মিকে নির্মূল করতে চাচ্ছে? তারা কি ‘আরসা’কে নব্য কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী মনে করে ভীত?
সম্পূরক উত্তর ১: বিশ্ব যদি রোহিঙ্গাদের জন্য সত্যিই কিছু করতে চায় তাহলে তাদের জন্য মায়ানমারে নিরুপদ্রব বাসস্থানের নিশ্চয়তা দিতে হবে। হয়তো তাদের আলাদা জাতিসত্তার স্বীকৃতি দিয়ে তাদের বার্মিজ মূল জনগোষ্ঠির সঙ্গে অঙ্গীভূত করে সকল নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নয়তো তাদের জন্য আলাদা ভূখণ্ডের ব্যবস্থা করে দিতে হবে, যেখানে তারা আলাদা জাতিগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
সম্পূরক উত্তর ২: আর যদি বিশ্ববিবেক মনে করেন, যেকোনো উপায়ে আরসাকে নির্মূল করে খেল খতম করতে হবে, তাহলে মনে রাখা প্রয়োজন- মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষ ভয়শূন্য হয়ে যায়। নানা চক্রান্ত করে আজকের সালভেশন আর্মিকে রুখে দেয়া গেলেও ভবিষ্যতে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে আরও অনেক আরসার উদ্ভব ঘটবে। ঘটাটাই স্বাভাবিক, বাঁচার অধিকার আদায়েই মানুষ রুখে দাঁড়ায়, হত্যাকারীর টুঁটি চেপে ধরতে প্রবৃত্ত হয়। হোক সে যতোই শক্তিশালী আর যতো মারণক্ষমতাসম্পন্ন।
সুতরাং, নির্যাতিতের কান্নাই একসময় বারুদ হয়ে জ্বলে ওঠবে, এই বিশ্বাস তাদের মনে রাখতে হবে।
পুনশ্চ প্রশ্ন: ক্ষমতা এবং অধিকার আদায়ের উৎস তবে কি সত্যিই বন্দুকের নলের মধ্যে নিহিত? বিশ্বমোড়লদের আতঙ্কিত সমবেদনা দেখে এমনই মনে হচ্ছে।