খুব ক্লান্তি লাগে আজকাল। যখন অন্ধকার হয় রাত…। কিন্তু আমার আসলে রাতের ব্যাপারে কোনো অনুযোগ নেই। যখন সমগ্র পৃথিবী দিন-দুপুরে হাঁটু মুড়ে হামাগুড়ি দিয়ে ডাকছে অন্ধকারকে, মাংসল যুবতীর নধর দেহের মতো খাবলা দিয়ে খাচ্ছে গ্রাস গ্রাস অন্ধকার; তখন রাতকে কেন অন্ধকারের দোহাই দিয়ে অভিযুক্ত করার দুরাশা; ভাল্লাগে না এইসব। 

আমি খুব ধার্মিক লোক, জানেন! খুব বিশ্বাস টিশ্বাস করি ধর্মে। যেমনটা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় করেন। শীর্ষেন্দু না বলে আমি কি অন্য কারো নাম বলতে পারতাম? পারতাম। কিন্তু কাকে আমি এই আলোকোজ্জ্বল অন্ধকারে শূলিতে চড়ানোর দুঃসাহস দেখাতে পারি? সকলে যার যার কুতুবখানার বিরাট দস্তাবেজ খুলে মাসয়ালা খোঁজেন, ফতোয়া খোঁজেন, মুহুর্মুহু হাততালি আর জিন্দাবাদের পর তারা আসমানের দিকে দুই হাত তুলে কিসের প্রার্থনা করেন, আমি বুঝি না। প্রার্থনার ভেতরে-বাহিরে কেউ কেউ আমিন বলেন, আস্তে এবং জোরে। আর তখনই পৃথিবীর কোথাও মসজিদে লাগানো হয় আগুন!

যখন বিরাট বিরাট রামদা হাতে শিবসেনাদের দেখি, ধর্মের নামে যারা কোপাচ্ছে মানুষের থকথকে মগজ, তখন আমার ভেতর থেকে মুহূর্তে উবে যায় কবরের সওয়াল-জওয়াবের ভয়। মুফতিরা যখন একে অন্যের ব্যাপারে ফতোয়া দিয়ে হা হা করে হাসেন, ভিডিওবক্তব্যে কুৎসা গেয়ে জিকির করেন: ইয়া নবি সারাম আলায়কা… তখন আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই পুলসিরাত। মাইরি বিশ্বাস করুন, বিজলির ন্যায় আমার পায়ের তলা দিয়ে পার হয়ে যায় চুলের চেয়েও চিকন ব্রিজ। দেখি, আমি দাঁড়িয়ে আছি ঈশ্বরের মুখোমুখি। সেখানে কোনো শিবসেনা নেই, কোনো মাওলানা-মুফতি নেই, কেউ কোথাও আমিন বলছে না, ঈশ্বরের গলায় ঝুলছে না ক্রুশ। 

এই আমি কি পাপী? এমন নিদানকালে কে আমার সাক্ষ্য দেবে যে আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম। এমন ক্লান্ত যে আমি কোনো মসজিদে আগুন লাগাতে যেতে পারিনি, ফতোয়া দেয়ার জন্য দামি কেতাব কেনার সামর্থ্য আমার ছিল না, কখনো কোনো মিছিলে যাইনি, ভোট চাইনি, ফেসবুকে লিখিনি এমন কথা যা শুনলে মুহূর্তে রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকবে ধার্মিকদের এবং তারা দলে দলে হায় হোসেন হায় হোসেন করতে করতে চলে যাবে ইরাক কিংবা সিরিয়ায়। 

কয়েকটি আমগাছ, কিছু বাঁশপাতা, ঢেঁকিশাক, মরিচফুল, পেঁপে গাছের ডাল, খয়েরি ডানার কয়েকটি শালিক এসেছে আমার সাক্ষ্য দিতে। সকাল-বিকাল মসজিদে যাওয়া-আসার পথে প্রতিদিন দেখা হতো এদের সাথে। আমি তিন তসবিহ পড়তাম আর তারা হেলেদুলে জিকির করতো, শিরশির শব্দ হতো। আমি ভাবতাম, বাতাসে দুলে ওঠে বুঝি! আজ জানলাম, তারা ঈশ্বরের আদালতে আমার মামলার শুনানির প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

ক্লান্তি এলে, এইসব বৃক্ষ-তরুলতা-পাখিদের নিয়ে যেতে চাই হাউজে কাউসারের পাশে। আপনারা নিয়ে যাবেন দলিল-দস্তাবেজ, রাশি রাশি সোয়াব-কেতাব, গুচ্ছ গুচ্ছ গালি-মাদারচোদ! 

আমার কি-ই বা আছে, ঘাস-পাতা-ঢেঁকিশাক-পাখি আর বাতাসে গুঁড়ো করা মিহি মিহি ঈশ্বরকণা!