এই নিঃসঙ্গ মিনারটির নাম ‘মিনার-এ-জাম’। পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম ঐতিহাসিক মিনার। আফগানিস্তানের ‘ঘোর’ প্রদেশের প্রাচীন ফিরোজকুহ শহরে নির্মিত হয়েছিল মিনারটি, ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ‘হারিরুদ’ নদী, কোথাও স্রোতস্বিনী, কোথাও বা সরু। বর্ষা মৌসুমে থাকে নীল জলের প্রবল স্রোত, শীত মৌসুমে প্রবল তুষারপাতে থাকে ঢাকা, আর গ্রীষ্মের খরায় শুকিয়ে খরখরে।

হারিরুদ নদীর পাশে ১১৯২-৯৩ সালে ‘মিনার-এ-জাম’ নির্মাণ করেন সে সময়ের আফগান শাসক সুলতান গিয়াসুদ্দিন মুহাম্মদ। তিনি হয়তো আপনার কাছে খুব একটা পরিচিত নন, তবে তার ছোট ভাইয়ের নাম আপনি নিশ্চয় শুনে থাকবেন—সুলতান মুইজুদ্দিন (শিহাবুদ্দিন) মুহাম্মদ ঘোরি, ভারতে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করেছিলেন যিনি।

১১৮৬ সালে গিয়াসুদ্দিন লাহোরে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে গজনবি সালতানাতকে পরাজিত করে আফগানিস্তানে নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং পর্বতবেষ্টিত দুর্গম ফিরোজকুহ শহরকে করেন তার গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। তার এই বিজয়ের স্মারকস্বরূপ ১১৯০ সালে ফিরোজকুহ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা হারিরুদ নদীর পাশে নির্মাণ শুরু করেন ‘মিনার-এ-জাম’। ১১৯৩ সালে নির্মাণ শেষ হওয়া অনিন্দ্যসুন্দর মিনারটি সে সময়ে ছিল পৃথিবীর সবচে উঁচু মিনার: ২১৩ ফুট।

মিনারের গায়ে আরবি কুফি শৈলীতে ফারসি ভাষায় লেখা আছে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত, সুলতান গিয়াসুদ্দিনের বিজয়নামা, ক্যালিগ্রাফিক ও জ্যামিতিক নকশা, নির্মাণের সাল ইত্যাদি। মিনারের ভেতর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্যাঁচানো সিঁড়ি, যা দিয়ে একদম মিনারের চূঁড়ায় পৌঁছানো যায়। সুলতান হয়তো সন্ধেবেলা এখানে বসে হিন্দুকুশ পর্বতমালায় অস্ত যাওয়া গোঁধূলী দেখে মুগ্ধ হতেন।

সুলতান গিয়াসুদ্দিন মুহাম্মদের ভাই মুইজুদ্দিন মুহাম্মদ ঘোরি ছিলেন দুঃসাহসী ও উচ্চাভিলাষী। লাহোরে গজনবি শাসকদের পরাজিত করে তিনি রাজ্যজয়ের বাসনায় আরও পূর্বদিকে এগিয়ে আসেন। সিন্ধ, পাঞ্জাব, কাশ্মির জয় করে ১১৯০ সালে তিনি বর্তমান ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের ‘তরাইনে’ দিল্লির রাজা পৃথ্বিরাজের মুখোমুখি হন এবং শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও মারাত্মক আহত হন। দুই বছর পর ১১৯২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তরাইনে আবার পৃথ্বিরাজের মুখোমুখি হন এবং তাকে পরাজিত ও হত্যা করে দিল্লিতে মুসলিম শাসন প্রবর্তন করেন।

দিল্লি জয় করার পর মুহাম্মদ ঘোরি তার ভাই গিয়াসুদ্দিনের মতো একটি বিজয়-মিনারের নির্মাণকাজ শুরু করেন, যেটি হবে মিনার-এ-জাম-এর চেয়েও উঁচু ও দর্শনীয়। কিন্তু নানা রাজনৈতিক কারণে তার জীবদ্দশায় মিনারের নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর পর পরবর্তী সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেক মিনারটির নির্মাণকাজ শেষ করার চেষ্টা করেন। তবে তিনিও সফল হননি। অবশেষে পরবর্তী সুলতান ইলতুৎমিশ মিনারটির নির্মাণ শেষ করেন এবং সেটি দিল্লির ‘কুতুব মিনার’ নামে বিখ্যাত হয়ে যায়।

দুই

আবার মিনার-এ-জামে ফিরে আসা যাক। ১২০৩ সালে আফগান সুলতান গিয়াসুদ্দিন মুহাম্মদের মৃত্যুর পর তার ভাই দিল্লির সুলতান মুহাম্মদ ঘোরি আফগানিস্তান শাসন করেন। তবে ১২০৬ সালে তার মৃত্যু হলে পরবর্তী দিল্লির শাসকগণ আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতা নিজেদের করায়ত্তে রাখতে পারেননি। ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে খাওয়ারেজম সুলতাম দ্বিতীয় মুহাম্মদ খাওয়ারেজমি ফিরোজকুহ জয় করে আফগানিস্তানের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তবে তিনি স্থিত হওয়ার আগেই পূর্ব ও মধ্য এশিয়ায় শুরু হয় তাতার-তাণ্ডব। তাতার-ঝড়ের প্রলয়ংকারী ছটা এসে পড়ে ফিরোজকুহের উপরও।

১২২৩ খ্রিষ্টাব্দে মঙ্গোল বিজেতা চেঙ্গিস খানের ছেলে ‘তোলুই খান’ ফিরোজকুহ আক্রমণ করে পুরো শহর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেন। তবে তাতাররা শহর ধ্বংস করলেও রক্ষা পায় মিনার-এ-জাম। তারা হয়তো ওয়াচটাওয়ার হিসেবে ব্যবহারের জন্য এটি ধ্বংস না করে বরং সংরক্ষণ করে রাখে।

তার পর থেকে এখনও বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ৯০০ বছর আগে নির্মিত মিনার-এ-জাম। যদিও মিনারের নানা অংশে কিছুটা ভাঙন ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তবু মূল কাঠামো এখনও ঋজু ভঙ্গিতে পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছে মুসলিম বিজয়ের স্মৃতিচিহ্ন।

পরিশিষ্ট ১

সুলতান মুহাম্মদ ঘোরি দিল্লি জয় করার আগে ১১৭৫ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান পাকিস্তানের মুলতান জয় করেছিলেন। মুলতান জয়ের পর তিনি শহরের গভর্নর ও প্রধান বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেন মোল্লা সিরাজুদ্দিনকে। ১১৯৩ সালে মোল্লা সিরাজুদ্দিনের ঔরসে জন্মগ্রহণ করে এক পুত্রসন্তান। তিনি তার নাম রাখেন মিনহাজ। এই মিনহাজই পরবর্তীতে মিনহাজ-এ-সিরাজ নাম ধারণ করে রচনা করেন তাবাকত-এ-নাসিরী নামে ইতিহাসের এক আকর গ্রন্থ। বঙ্গ অঞ্চলে মুসলিম বিজয় ও খিলজি শাসনের ইতিবৃত্ত জানার একমাত্র উৎস গ্রন্থ হিসেবে যেটি বরিত হয়ে আসছে বহু শতাব্দী থেকে।

পরিশিষ্ট ২

কোনো কোনো পশ্চিমা আর্কিওলজিস্ট দাবি করেছেন, প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ‘ঋগ্বেদ’-এ যে সরজু নদীর কথা বলা হয়েছে, এই হারিরুদ নদীই হচ্ছে সে সরজু নদী। জরথুস্ত্র ধর্মগ্রন্থ ‘আভেস্তা’য় এ নদীকে ‘হারয়ু’ নামে সম্বোধন করা হয়েছে। সম্প্রতি লিথুনিয়ার একদল আর্কিওলজিস্ট হারিরুদ নদীর কোলে প্রথম শতাব্দীর কিছু বৌদ্ধ প্রত্নতত্ত্ব খুঁজে পেয়েছেন। প্রত্নতত্ত্বগুলো নির্দেশ করছে, খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে এখানে সম্ভবত কোনো বৌদ্ধ বিহার ছিল।

পরিশিষ্ট ৩

১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে মিনার-এ-জামের আশপাশের এলাকায় এক প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ চালানোর সময় সেখানে একটি ইহুদি কবরস্তানের সন্ধান পাওয়া যায়। শুধু কবরস্তানই নয়, পাওয়া যায় ইহুদিদের বসবাসের চিহ্ন এবং প্রার্থনাগৃহের নমুনা। এই দুর্গম পর্বতসংকুল স্থানে কি একসময় ইহুদিদের বসতিও ছিল?

এই সূত্র ধরেই তবে কি শুরু হবে নতুন এক উপাখ্যানের যাত্রা? কে জানে…!