দুদিন আগে হলো কি, আমি মসজিদ থেকে মাগরিবের নামাজ পড়ে বের হচ্ছি, এমন সময় দেখি নয়নের (ছদ্মনাম) ছেলেটা রাস্তা দিয়ে দোকানের দিকে যাচ্ছে। বাচ্চা ছেলে, বয়স বড়জোর চার-পাঁচ। এর আগে ওকে আমি চিনতাম না। চিনেছি সপ্তাহ দুয়েক আগে। সেদিনও পথেই দেখা হয়েছিল। দেখেই মনে হয়েছিল, এটা সম্ভবত নয়নের ছেলে। তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম।

দুদিন আগে মাগরিবের পর ওকে একা একা দোকানের দিকে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখন কই যাস তুই?’
‘দোকানে যাই।’
‘এখন দোকানে যাবি কেন? একা একা আবার ফিরতে পারবি?’
‘পারুম। আমি একলা একলাই যাই। ভূত দেখলে ভূতেরে মাইরা ভর্তা বানায়া ফালামু।’
ছেলেটার জন্য মায়া হলো। অবশ্য ওকে দেখলেই আমার কেমন একটা অসহায়বোধ হয়। ওর মায়ের জন্য। প্রেম করে বিয়ে করে সংসার হলো না। নয়ন নাকি তালাক দিয়ে দিয়েছে। তবু সে নয়নের বাড়ি ছাড়বে না। নয়ন যদি কখনো হাসিমুখে একটু কথা বলে, সেই হাসির বিনিময়ে সে আরও এক বছর নয়নের জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু নয়ন আসে না। সে নাকি আরেকটা নিকা করছে। তাতেও ওই মেয়ের কিছু যায় আসে না। নয়নের মা ওকে সে বাড়িতে খেতে দেয় না। এমনকি নিজে রান্না করে খাবে, সে সুযোগও দেয় না। তার বাড়িতে ওই মেয়ের নামে চুলা জ্বলা নিষেধ। মেয়ের মা বা বাবা মাইলখানেক দূরের বাড়ি থেকে মেয়ের জন্য দু’বেলা ভাত-তরকারি নিয়ে আসে। মা আর ছেলে ওগুলো খেয়েই পড়ে থাকে ‘স্বামীর ভিটায়’।
ছেলেটা দোকানের দিকে চলে গেলেও আমি মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকি। একটা বোবা অসহায়ত্ব আসে মনের মধ্যে। ছেলেটা খেলতে খেলতে যাচ্ছিল। একটু দূরে গিয়ে জোরগলায় বলে উঠল, ‘মুসলমানি করানোর পর আমার মা’য় কইছে, আমারেও মাদরাসায় ভর্তি কইরা দিবো। আমিও মাদরাসায় পড়বো।’
ওর আচমকা এমন কথা শুনে আমার ভেতরে মিশ্র অনভূতি হলো। একটা ভালোলাগা, ছেলেটার কথা শুনে মুখে অকারণে আলতো হাসি চলে এলো। আরেকটা অনুভূতি বেদনার। ওই মেয়েটা, নামটা যেন কী—ভুলে গেছি—সেই মেয়েটা তার ছেলেকে মাদরাসায় পড়াতে চায়। কী কারণে? কারণ সে দেখেছে, তার প্রেম-করা স্বামী হয়েছে একটা বদমাশ। তার শশুরবাড়ির লোকজন হয়েছে বদমাইশের আরেক কাঠি সরেস। সে চায় না তার ছেলেও তাদের মতো হোক। তার ছেলে হবে সহমর্মী, অনুভূতিশীল, সমাজের সম্মানিতজন, মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল এবং পরকালের জন্য আখেরি সম্বল। সর্বোপরি সে কামনা করে, তার ছেলেটা একজন ভালোমানুষ হবে। বাপের মতো হারামি যেন না হয়।
এসব কারণেই হয়তো চেয়েছে, তার ছেলেকে মাদরাসায় পড়িয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে। ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি মানুষের এই যে আস্থা, ভালোমানুষ হওয়ার কারিগরি বিদ্যা যে মাদরাসায় দেয়া হয়, এই আত্মবিশ্বাস মানুষের অন্তর থেকে এখনও শেষ হয়ে যায়নি। পৃথিবীর বহু মানুষের মনে এখনও বদ্ধমূল ধারণা, সত্যিকারের ভালোমানুষ হওয়ার সূতিকাগার ওই মাদরাসাগুলো। ওই আলেম-হাফেজরাই সমাজের সবচে সজ্জন ব্যক্তি। তারা সত্যবাদী, তারা ন্যায়বান, তারা দুর্নীতিহীন, তারা নারীর মর্যাদা রক্ষাকারী, তারা কন্যাসন্তানের আমানতদার, তারা আখেরাতে যেমন তেমনি দুনিয়াতেও মানুষেল মানবিক সকল শুভকাজের ভরসাস্থল।
আজকের আলেম-হাফেজদের উচিত নয় মানুষের এই ভরসার জায়গাটা নষ্ট করা।

ডায়েরি, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ভোর ৫টা ৫৩


Leave a Reply

Your email address will not be published.