মহিলা মাদরাসার শিক্ষার্থী ও তাদের জীবন নিয়ে আমি একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশের চিন্তা করছি কিছুদিন থেকে। এই মাদরাসা-জীবনকে উপজীব্য করে কয়েকটি গল্প ইতোমধ্যে লেখাও হয়েছে। আর কয়েকটি গল্পের খসড়া মাথা ও কাগজে টুকে রেখেছি। ফুরসত মিললেই গল্পগুলো একটানে শেষ করে টলটলে একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করে ফেলব শিগগির।

কওমি মাদরাসার জীবন নিয়েও আমি একটি উপন্যাস লেখার কাজ শুরু করেছি। অঘোষিত নানা কারণে সেটি লেখার কাজ শেষ করতে পারছি না। তবে সময় লাগলেও বিরাট কলেবরে রচিতব্য উপন্যাসটিকে চেষ্টা করছি সাহিত্যমানে ক্লাসিক করতে। বাদবাকি আল্লাহর মর্জি।

অনেকে আমাকে পরামর্শ দেন, মহিলা মাদরাসা বা কওমি মাদরাসা নিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখলে লোকে আপনাকে সস্তা ভাববে, কাসেম বিন আবুবাকারের আপডেট ভার্সন মনে করবে, মনে করবে সস্তা পাবলিসিটির জন্য আপনি এমন বই প্রকাশ করছেন!

আপনাদের এমন কেন মনে হয়? মহিলা মাদরাসা বা কওমি মাদরাসা কি আমাদের সমাজের অংশ নয়? এই সমাজে তাদের অবদান কি ক্ষুদ্র? সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে আছে মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণ। তারা সমাজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়াশোনা করছে, কেউ সংসার করছে, চাকরি-ব্যবসা, হাট-বাজার, উন্নয়ন-অগ্রগতি, দুর্দশা-উল্লাসে তারা সবাই একযোগে শরিক হচ্ছে। তাহলে তাদের নিয়ে লিখলে সেটা কেন সস্তামি হয়ে যাবে? সমাজে তাদের অংশগ্রণের স্বীকৃতি দিতে আমাদের অনীহা কেন? সম্মান নাকি অবহেলা?

স্কুল-কলেজের জীবন নিয়ে লিখলে সেটা মহার্ঘ্য সাহিত্যমান পাবে আর মাদরাসা-জীবন নিয়ে লিখলে সেটার সাহিত্যমান কেন সস্তা হয়ে যাবে?

সাহিত্য আয়নার মতো। এই সমাজের জীবন-বাস্তবতা তুলে ধরাই সাহিত্যের প্রধান ধর্ম। আপনি যদি মহিলা মাদরাসাকে সাহিত্যের আয়নায় না দেখাতে পারেন, তাহলে এই মাদরাসা আন্দোলন সমাজে নিজস্বতা তৈরি করতে পারবে না। এটি সবসময় অপাংক্তেয় রয়ে যাবে। সমাজে এর ইমপ্যাক্ট তৈরি হবে না। মহিলা মাদরাসার প্রভাব সর্বস্তরে প্রভাবিত করতে হলে এটিকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সাহিত্যে স্থান দেয়া অত্যন্ত জরুরি।

দুই

এই তো কিছুদিন আগে আমি উত্তরবঙ্গের চাঁপাই, নওগাঁ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট সফর করে এসেছি। সেখানকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কওমি মাদরাসার কমতি থাকলেও দেখেছি, বেশ কিছু মহিলা মাদরাসা সগৌরবে তাদের যাত্রা শুরু করেছে। কিছু কিছু মহিলা মাদরাসার ছাত্রীসংখ্যা পাঁচশো-হাজারের মতো। ইমপ্রেসিভ ঘটনা!

এর মানে হচ্ছে, মহিলা মাদরাসা সমাজের অতীব প্রয়োজনীয় একটি অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। আমাদের এই সমাজে মহিলা মাদরাসার যে তীব্র চাহিদা রয়েছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে সে চাহিদা সমানতালে অনুভূত হচ্ছে দেখে সেটা বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয়।

যদি মহিলা মাদরাসা আমাদের সমাজে অপাংক্তেয় হতো তাহলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলে এই শিক্ষা কার্যক্রম এত সহজে জায়গা করে নিতে পারত না। সমাজে এর চাহিদা আছে বলেই প্রত্যন্ত চরাঞ্চল, দ্বীপাঞ্চল, দুর্গম এলাকায়ও মহিলা মাদরাসা গড়ে উঠছে। এবং সেসব মহিলা মাদরাসা বাংলাদেশের শিক্ষা কার্যক্রমের বিরাট অংশ কব্জা করে নিচ্ছে।

সুতরাং, মহিলা মাদরাসা, কওমি মাদরাসা, হুজুর-মাওলানা—এদেরকে সংস্কৃতি ও সাহিত্যে জায়গা দিতে হবে। হুজুর মানেই কেবল রাজাকার বা চরমপন্থী—এমন চিন্তাধারা সমাজে এমনি এমনি তৈরি হয়নি। আপনি এসবের বিরুদ্ধে কখনো আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ‘গুড হুজুর’ চরিত্র দাঁড় করাতে পারেননি বলে অশুভ চরিত্র জায়গা করে নিয়েছে।

এর বিরুদ্ধে আপনি বক্তৃতায় চেঁচিয়েছেন, ফেসবুকে গালাগালি-ট্রল করেছেন। কিন্তু এ-সব তো অস্থায়ী জিনিসপত্র। এগুলো দিয়ে আপনি সাহিত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবেন না। ‘রাজাকার’ চরিত্র-নির্ভর সাহিত্যের মুখোমুখি গুড হুজুর নিয়ে দাঁড়াতে হলে আপনার সাহিত্যেও গুড হুজুর ক্যারেক্টার নিয়ে আসতে হবে। সাহিত্যের বিরুদ্ধে সাহিত্য দাঁড় করাতে হয়, গলাবাজি না।

বিল-আখের, আরেকজনের লাইন-টানা সীমানা আপনি মানবেন কেন? আপনার নিজের সীমান আপনি নিজে তৈরি করুন। কারণ, আপনি যেখানে গিয়ে দাঁড়াবেন, লাইন ওখান থেকেই শুরু হবে!