বহু সংস্কৃতি এবং বহু জাতিসত্তার ভারত একদিন ভাঙবেই। তবে এই ভাঙন রোধ করতে বিজেপির অস্ত্রটা বেশ কৌশলী। বিজেপি ধরতে পেরেছে, জাতি এবং সংস্কৃতিতে ভারতীয় জনগণ রাজ্যগতভাবে বহুধা বিভক্ত থাকলেও ধর্ম সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তারা এক—সকলেই হিন্দু। এই হিন্দুত্ববাদই হলো বিজেপির সবচে বড় অস্ত্র। ফলে, তারা ভারতীয় হিন্দু জনগণের মাঝে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল করাতে চাচ্ছে যে, নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তা বা সংস্কৃতিতে আমরা আলাদা হলেও ধর্ম আমাদের এক—আমরা সবাই হিন্দু; ‘জয় শ্রীরাম’ আর ‘জয় হিন্দ’ আমাদের সকলের পরিচয়।

‘সেভেন সিস্টার’ বলে পরিচিত ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্য—অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরা রাজ্যে একসময় জোরেশোরে আলাদা রাষ্ট্রের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম অব্যাহত ছিল। ক্ষুদ্রাকারে এখনও রয়েছে বটে, তবে অনেকটাই স্তিমিত। স্বাধীনতাকামী এই সশস্ত্র গোষ্ঠীকে ভারতীয় সরকার বলে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’। যেমন কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদী, ঝাড়খণ্ডের মাওবাদী বিচ্ছিন্নতাবাদী, ত্রিপুরার উলফা বিচ্ছিন্নতাবাদী। ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ মানে হলো যারা ভারতের কেন্দ্রীয় শাসন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী এবং আন্দোলনরত।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার একদিকে কঠিন সামরিকশক্তি প্রয়োগ করে তাদের দমন অব্যাহত রেখেছে, অন্যদিকে ধর্মীয় প্রোপাগান্ডা চালিয়ে জনগণকে বুঝানো হচ্ছে—রাজ্যে রাজ্যে জাতিগত বিভেদ থাকলেও ধর্মের দিক দিয়ে আমরা সবাই এক ও অভিন্ন। শ্রী নরেন্দ্র মোদি সবার মাথায় দেবতাদের আশীর্বাদের হাত বুলিয়ে বলছেন, জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি আলাদা—তাতে কিছু যায় আসে না মেরে ভাই! আমরা সবাই রামের নামে উৎসর্গিত। ভারত আবার হবে সেই স্বপ্নের রামরাজ্য। 

এটা হলো ধর্মের নামে ব্ল্যাকমেইলিং। 

সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে, ভারতের রাজ্যগত সংহতি এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য বিজেপির সবচে বড় অস্ত্র হলো ধর্ম, হিন্দুত্ববাদ। এ কারণেই ধর্মীয়ভাবে অনেকটা মধ্যপন্থী কংগ্রেসকে কুপোকাত করা মোদির ‘জয় শ্রীরাম’ তত্ত্ব কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতীয় হিন্দুদের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। 

মোদির অনাগত রামরাজ্যে সেখানকার মুসলিমদের নিয়ে বড় একটা হিসেব-নিকেশ নেই। হিন্দু রাষ্ট্রে বাজতে থাকা শঙ্খ আর উলুধ্বনির মাঝে যদি থাকতে পারো তো থাকো, নয়তো নিজের রাস্তা নিজে মাপো। রামরাজ্যে ম্লেচ্ছ-যবনদের এমনিতেও থাকার অধিকার নেই। নাগরিক হিসেবে ভোটে আর আধার কার্ডে নাম থাকবে, বাদবাকি খোদার মর্জি!

কাশ্মির শেষ পর্যন্ত কতখানি নিজের মর্জির ওপর টিকে থাকতে পারবে সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ আঞ্চলিক রাজনীতির হিসাবে অনেকের বখরা আছে। সবার বখরা যদি ঠিকঠাক থাকে তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখানে অহেতুক নাক গলাতে আসবে না। 

এখানে দুটো বিষয় মাথায় রাখতে রাখতে হবে। ১. ভারত আন্তর্জাতিকভাবে সবচে বড় পণ্যের বাজার। কোনো দেশই অযথা আবেগ দেখিয়ে এত বড় বাজার হাতছাড়া করার রিস্ক নেবে না। 
২. অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে এই বিশাল বাজারই বৃহৎ আকার এবং বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দেশ ভারতের তুরুপের তাস। ভারত যেকোনো মূল্যে তার এই বিরাট আকার ও জনসংখ্যাকে বিভক্ত হতে দেবে না। জনগণকে একাট্টা রাখতে মোদি প্রবর্তিত চিরন্তন দৈব অস্ত্র হিন্দুত্ববাদ তো আছেই, আরও আছে ভারতীয় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি, ক্রিকেটের আইপিএল, শিবসেনা, আরএসএস, হিন্দু মোর্চাসহ রামভক্ত নানা কারিকুলাম।

সারা পৃথিবীতে যখন ‘ইসলামি খেলাফত’ নাম শুনলেই সন্ত্রাসবাদের ধোঁয়া তোলা হচ্ছে, তখন এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না নিশ্চয়, খুব শিগগির ভারতে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ইতিহাসের প্রথম ‘হিন্দুত্ববাদী খেলাফতব্যবস্থা’!


১ Comment

Mamun Abdullah · ১৮ সেপ্টেম্বর , ২০১৯ at ২:৪০ পূর্বাহ্ণ

আমার এক ইন্ডিয়ান কলিগ সেদিন বলছিলো, মুদি নাকি চাইছে হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে। কিন্তু চেন্নাই, হায়দারাবাদ, কেরেলা বা আরও যেসকল স্টেট আছে, তারা নাকি মানছে না আর না-ই মানবে। ইশ্, এনিয়ে একটা ধন্ধ লাগলে ভালোই হতো। হয়তো ঐক্য নষ্ট হবে।

Comments are closed.