শুরুতে একটা কৌতুক বলি।
এক মহিলা তার স্বামীর জন্মদিনে তাকে কিছু গিফট করবে বলে একটা গিফটশপে ঢুকেছে। দোকানির কাছে গিফটের বিষয়টি বলতে সে নানা গিফট আইটেম দেখাচ্ছে মহিলাকে।
: আপা, একটা সুন্দর রিস্টওয়াচ উপহার দিতে পারেন, ভাইয়া খুশি হবে।
:: না, ঘড়ি ওর আছে একটা। অন্যকিছু…
: তাহলে একটা পার্পল টাই নিয়ে যান, মানাবে বেশ…
:: টাই আছে ওর একটা।
: তাহলে একটা পারফিউম নিয়ে যান!
:: নাহ, পারফিউমও ওর আছে একটা।
: তবে একটা বই নিয়ে যান গিফট হিসেবে।
:: আরে না, বইও ওর আছে একটা…
বইও যে সংসারে একটা-আধটা থাকলে আর প্রয়োজন হয় না, এ বড় আচম্বিত বিদ্যা!
০২
তরুণ প্রজন্মের স্যোস্যাল নেটওয়ার্কে বিচরণ শুরু হতে একটা আশঙ্কা ছিলো— বইপাঠের আগ্রহে সম্ভবত এবার একটা বড় ধ্বস নামবে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো হতাশ্বাসের জন্য তৈরি হচ্ছিলো। বিভিন্ন নিউজ আর পরিসংখ্যানও আশঙ্কাজনক সংবাদ দিচ্ছিলো ক্ষণে ক্ষণে। তাছাড়া, নেটসংস্কৃতির দৌরাত্ম্যের ফলে বিশ্বের বড় বড় কিছু নিউজ এজেন্সি, নিউজপেপার, ম্যাগাজিনের প্রিন্ট সংস্করণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ শঙ্কা আরও ঘনীভূত হয়। ফলে ধরেই নেয়া হয়েছিলো, বইয়ের স্থান এবার কেবল পাবলিক লাইব্রেরি আর জাদুঘরের সংগ্রহশালা। চোখে ভারী ফ্রেমের চশমাপরা ছেলেটিকে নীলক্ষেতে গম্ভীর মুখে আর খুঁজতে দেখা যাবে না পাওলো কোয়েলোর পুরোনো কোনো বই।
কিন্তু বাস্তবিক অর্থে কিছুদিনের মধ্যেই ঘটলো ঠিক উল্টোটা। ফেসবুক-টুইটার বা অপরাপর অনলাইন প্লাটফর্ম নতুন করে প্রচুর পাঠকশ্রেণি তৈরি করে দিলো। আরও সুখের কথা হচ্ছে— নতুন এই পাঠকশ্রেণি আগের হুমায়ূনীয় পাঠকশ্রেণির চেয়ে অনেক বেশি সচেতন, অনেক বেশি মনোযোগী, গুণে-মানে অনেক সম্পন্ন। এমনকি বই কেনার ব্যাপারেও বাঙালির যে বদনাম রয়েছে, এই নতুন জোয়ার সে বদনাম ঘুঁচিয়ে বাঙালিকে বই কেনায় প্রলুব্ধ করেছে।
০৩
বইমেলায় যারা নিয়মিত যান তারা আমার কথার সঙ্গে খুব বেশি দ্বিমত করবেন না। বছর চার-পাঁচ আগেও যারা বইমেলায় কেবল ঘুরতে যেতেন, তারা এখন ব্যাগভরা বই নিয়ে তৃপ্তমুখে বইমেলায় স্টলে স্টলে ক্যাটালগ সংগ্রহ করেন, হাতে টাকা এলে আবার কিনবেন বলে।
রকমারি.কম-এর অফিসিয়াল পরিসংখ্যান যতোদূর জানতে পেরেছি, তাদের সেল বরাবর ঊর্ধ্বমুখী। নইলে এতোদিন ধরে তারা ব্যবসা করতে পারতেন না এবং তাদের অনুসরণ করে আরও শত শত বইবিক্রির অনলাইন প্লাটফর্মও তৈরি হতো না। এসবই কিন্তু বইপাঠ এবং বই কেনার প্রতি নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টির ফলাফল।
ফেসবুকে বইপ্রেমী ছেলেমেয়েদের বিরাট বিরাট গ্রুপ রয়েছে। এখানে ঢুঁ মারলে বুঝা যায়, বইয়ের প্রতি বাঙালির আগ্রহ এবং ভালোবাসা বাড়ছে বৈ কমছে না। ওয়ার্ল্ডওয়াইড অনলাইন শপ অ্যামাজন.কম বা রিভিউ সাইট গুডরিডস.কম-এ চোখ রাখলেও সার্বজনীন বইয়ের প্রতি পাঠকের ভালোবাসার নমুনা সহজেই ধরা পড়বে।
পিডিএফ নামে বইয়ের যে সফট সংস্করণ, সেটাও কিন্তু কোনোভাবেই বইপাঠক এবং বইপ্রকাশের অগ্রযাত্রাকে রুখতে পারছে না। এটা বরং অনেকভাবে নতুন বইপাঠক তৈরি করে দিচ্ছে।
০৪
এই যে অনলাইন এবং বিস্তৃত বাধাহীন স্যোস্যাল নেটওয়ার্ক, এতো পাঠোপকরণ থাকার পরও বইয়ের প্রতি নতুন করে আগ্রহী হবার একটা অন্তর্নিহিত কারণ— যেটা আমার মনে হয়েছে, অনলাইন পপুলারিটি। অনলাইনে পপুলার হওয়ার জন্য প্রচুর বিদ্বান হতে হয়। এখানে আপনাকে পাঠককে আকৃষ্ট করতে কিছু লিখতে হবে এবং ভয়ের বিষয় হলো, আপনি কিছু একটা হুটহাট ভুলভাল লিখে পার পেতে পারবেন না। পাঠক এখানে সচেতন, লাইভ এবং বাধাহীন। এমন নয় যে, আপনি একটি বই লিখলেন, পপুলারিটি পেলেন, পাঠক আপনার অগোচরে আপনার প্রশংসা করলো নাকি নিন্দা করলো আপনি জানতেও পারলেন না। কিন্তু অনলাইনে একজন সেলিব্রেটির যেকোনো লেখার প্রতিটি লাইন তার পাঠকশ্রেণি জহুরির দৃষ্টিতে দেখে থাকেন।
এ কারণে— অনলাইনে কিছু লিখতে হলে একজন লেখককে সত্যকথন, ইনফরমেশন, রেফারেন্স, ভাষাজ্ঞান, সাধারণ জ্ঞান, রসবোধ সর্বোপরি সূক্ষ্মদর্শিতার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হয়। আর এসব কিছু জ্ঞানের চাবিকাঠি বইপাঠ ব্যতীত কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
এই বোধই অবচেতনভাবে নতুন করে পাঠক তৈরিতে অন্যতম নেপথ্য কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
আরেকটি কারণ— শো-অফ। সাধারণ পাঠকরা একটি বই পড়ে যখন অনলাইনে তার পাঠপ্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, সেটা হাজারজনকে প্রভাবিত করছে। একটি বই পড়ে ভালো লাগলে আগে আপনি দুইজন-চারজনকে পার্সোনালি জানাতে পারতেন। কিন্তু এখন একজন পাঠক একটি বই পড়ে পাঠপ্রতিক্রিয়া বা রিভিউ যখন ফেসবুকে প্রকাশ করেন সেটা হাজারজন পড়ছে, মতামত জানাচ্ছে এবং বইটি পড়তে অনুপ্রাণিত হচ্ছে।
এভাবেই একটি ভালো বইয়ের বিজ্ঞাপন পাঠকের বদৌলতে শতবার হয়ে যাচ্ছে অনলাইনে। এটাই হচ্ছে একটি ভালো বইয়ের অনলাইন সেল্ফ অ্যাডভের্টাইজিং।
তাই বলছি, যতোই পিডিএফপ্রেম, অনলাইন নিউজপোর্টাল পাঠক বাড়ুক, বই চিরন্তন। বই হাজার হাজার বছরের পাঠোপকরণ, এতো সহজে এর বিলুপ্তি নেই।