সেদিন বাংলাবাজার নবপ্রকাশে বসেছিলাম। কাউন্টারে আসাদ বা ইসহাক কেউ নেই। আমি এমনিই দোকানদার দোকানদার ভাব নিয়ে বসে আছি। এমন সময় একটা ছেলে এলো কাউন্টারের সামনে। আমাকে দেখে কী কারণে যেন তার চেহারায় একটা ভরসার ভাব চলে এলো। সামান্য ইতস্তত করে ব্যস্তসমেত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাই, “পুশিদাহ রাজ” আছে?’

আমি না শোনার ভাণ করে আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যরি, কী নাম বললেন?’

“পুশিদাহ রাজ” বইটা আছে নাকি আপনাদের কাছে।”

আমি দুঃখ ভারাক্রান্ত মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, ‘না ভাই, নেই। সামনের ওই দোকানটায় দেখুন, ওই যে ওটায়…।’

ছেলেটি গভীর প্রত্যাশা নিয়ে নির্দিষ্ট দোকান অভিমুখে যাত্রা করলো। যুবকের চেহারা আর পোশাক দেখে যতোটুকু ধারণা করলাম, সদ্যই বিয়ে করেছে হয়তো। সুতরাং, নানা আবশ্যিক কারণে একখানা ‘পুশিদাহ রাজ’ তার এখন না হলেই নয়।

‘পুশিদাহ রাজ’ উর্দু একটা কিতাবের নাম। যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘গোপন রহস্য’ ‘অপ্রকাশিত রহস্য’—এমনতর কিছু একটা হবে। এ উর্দু বইটি বাংলাবাজারের বেশ কয়েকটি প্রকাশনী বিভিন্ন চটকদার নামে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছে। আপনারা জেনে অবাক হবেন, বাংলাবাজারের বেস্টসেলার বইয়ের মধ্যে এই পুশিদাহ রাজের অনুবাদ অন্যতম।
কী আছে এই বইয়ে? ওই তো, যা থাকে আর কি! কলিকাতা আর মাদ্রাজ হারবালের বিজ্ঞাপনে যেসব কথা খোলামেলা লেখা থাকে, সেসব কথাই ইসলামি ঢঙে লেখা হয়েছে এ বইয়ে। উঠতি পোলাপান, বিয়েপ্রত্যাশী কিংবা সদ্যবিবাহিত তরুণ-যুবকরাই এর প্রধান খদ্দের। বিয়ে-পরবর্তী সময়ে কীভাবে স্ত্রী-সংসর্গ লাভে ব্রতী হতে হবে, তার আনুপুঙ্খিক বর্ণনা থলথলে ভাষায় বিবৃত হয়েছে বইটিতে। লাভের মাঝে লাভ যেটা, এসব বর্ণনাকে নানা ইসলামিক সূত্র দিয়ে ভালো একটা ধর্মীয় আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে বইজুড়ে। জানি না, এসব সূত্র কই থেকে যোগাড় করা হয়েছে বা এসব পড়ে কার বিবাহিত জীবনে কী ফায়দা হয়েছে। তবে এটুকু বলতে পারবো, এসব বই পড়ে নাবালেগও বালেগ হয়ে যায়, আর যারা বালেগ তারা বল্গাহীন হয়ে পড়ে।
দুই
যাক সে কথা। গত বছরের শুরুতে একটা নিউজ পড়েছিলাম- ২০১৫ সালে চট্টগ্রামে আদালত কর্তৃক বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ২০ হাজার! কী ভয়াবহ সংবাদ! মাত্র একটি জেলার এতোগুলো সংসার এক বছরে শেষ হয়ে যায়? তাহলে ঢাকার অবস্থা কী? নিশ্চয় আরও ভয়াবহ!
প্রিয়তমা রচনার অন্যতম কারণ—বাংলাভাষী মানুষের সামনে রাসুল ও তাঁর স্ত্রীদের দাম্পত্যজীবনকে সগৌরবে তুলে ধরা। কতোটা পেরেছি জানি না, তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি—মুসলিম নারীদের জন্য উম্মুল মুমিনিনদের জীবন ও জীবনের গল্পের চেয়ে শিক্ষণীয় আর কিছু হতে পারে না। এতো প্রেমময় আর ভালোবাসায় পূর্ণ ছিল তাদের সংসার, আমরা কখনো সে সাংসারিক প্রেম আগ্রহভরে পাঠ করে দেখিনি।
আমাদের লৌকিক সমাজের প্রায় প্রতিটি পরিবারে আজকাল শোনা যায় স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য কলহ, মানসিক টানাপোড়েন, পরস্পরের বিশ্বাসহীনতা, সংসার ভাঙার করুণ সুর। দাম্পত্য কলহের বিষবাষ্প যেন ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে আমাদের চারপাশের সমাজ। কিন্তু আমরা নিজেদের কি কখনো রাসুল ও তাঁর স্ত্রীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছি? কখনো কি তাঁদের সংসারের আদলে আমাদের সাংসারিক সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার চেষ্টা করেছি? হয়তো কখনো করা হয়নি। অথচ তাঁদের জীবনে রয়েছে প্রেম আর ভালোবাসায় পূর্ণ এক সংসারের ছায়াছবি। তাঁদের দাম্পত্যজীবনের অসংখ্য অনুপম শিক্ষা সমগ্র পৃথিবীর জন্য শিক্ষণীয়। অনাগত সকল সভ্যতার জন্য তাঁদের সাংসারিক প্রেম নক্ষত্রের মতো জাজ্বল্যমান। যে গ্রহণ করবে, তার জীবন আলোকিত হবে।

এ গ্রন্থ সেই সুখী আর প্রেমময় জীবনের গল্পই বলেছে।

সবার পাঠোদ্দীপনা কামনা করছি।