লেখক-অনুবাদক-প্রকাশক—সবার মধ্যে পেশাদারিত্বের অভাব। লেখালেখির ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বটা আসলে কী, সেটাই আমরা এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। পেশাদারী মনোভাবের অভাবে লেখক-অনুবাদকরা লেখালেখিকে কখনোই সিরিয়াসলি নেন না। তারা মনে করেন, লেখালেখিটা একটা শখের বিষয়। সময়-সুযোগ হলে লিখব, ইচ্ছা না হলে লিখব না। কিন্তু তার স্মরণ রাখা প্রয়োজন, তার কাছে লেখালেখি খাম-খেয়ালির বিষয় হলেও প্রকাশকের কাছে বই অনুবাদ করে বা পাণ্ডুলিপি তৈরি করে বই প্রকাশ করা রুটিরুজির প্রশ্ন। একজন লেখক যদি সঠিক সময়ে তার কাজটি শেষ না করে দেন তবে প্রকাশক অবশ্যই ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।

আবার সম্মানীর অর্থ পাওয়ার পরও নির্দিষ্ট সময়ে পাণ্ডুলিপি দিতে পারেননি কিংবা পাণ্ডুলিপি আরেক প্রকাশকের কাছে বিক্রি করেছেন কিংবা অর্থের কথা অস্বীকার করেছেন, এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ বাংলাবাজারের প্রকাশকদের কাছে বসলেই শোনা যায়। অথচ যারা লেখক/অনুবাদক হিসেবে নিজেদের দাবি করছেন তারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমাজের মান্যজন, বড় মাওলানা, মাদরাসার মুহাদ্দিস কিংবা মসজিদের ইমাম সাহেব।

এমন আরও অনেক অপেশাদারী মানসিকতা আমাদের লেখক-প্রকাশকদের মধ্যে ছড়িয়ে আছে, যার পরিশোধন হওয়া প্রয়োজন।

একসময় মনে করা হতো, ধর্মীয় বই লেখা সোয়াবের কাজ তাই বই লিখে সম্মানী নেয়াটা গোনাহ। অতীতে অনেক আলেম-লেখক নিতেনও না। কিন্তু এখন ধর্মীয় বিষয়ে লেখালেখি একটা প্রফেশন হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আমি মনে করি, এটাই হওয়া উচিত। যে লেখক নিজের মেধা, সময়, শ্রম ব্যয় করে একটি বই লিখেলেন, হোক সেটা ধর্মীয়, তাকে অবশ্যই তাঁর প্রাপ্য সম্মানী বুঝিয়ে দেয়াটা কর্তব্য।

তবে সবচে বড় যে বিষয়টি মৌলিক সাহিত্য বা মৌলিক গবেষণাগ্রন্থ রচনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, সেটা হলো আর্থিক বিষয়। বাংলাদেশে ইসলাম বিষয়ে মৌলিক সাহিত্য বা গবেষণাগ্রন্থ লেখার লেখকের যেমন অভাব নেই তেমনি এমন মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করার মতো প্রকাশকেরও অভাব নেই। এর প্রমাণও আছে। বর্তমানে কিছু কিছু প্রকাশনী যোগ্য সম্মানীর মাধ্যমে ভালো লেখকদের দিয়ে অনেক মৌলিকগ্রন্থ প্রকাশ করছেন।

কিন্তু এ ধারা এখনও শক্তিশালী নয়। অনেক ইসলামি প্রকাশনী লেখকসম্মানী বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক বেখেয়াল। এই সম্মানী বিষয়টি যখন পেশাদারিত্বের আবহে উভয় পক্ষকে সমঝদার করবে, তখনই কেবল সৃষ্টিশীল মৌলিক কাজ হতে পারে। অন্যথায় সারাজীবন আমাদের অনুবাদ আর কপি-পেস্টের যাতনা সহ্য করে যেতে হবে। মৌলিক সাহিত্য যেমন সৃষ্টি হবে না, তেমনি সাহসী প্রকাশকও তৈরি হবে না।

বিদেশি উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে একজন লেখক একটি বই প্রকাশ করে আরামে বছরখানেক শুয়ে বসে কাটাতে পারেন। কারণ একটি বই লিখে সম্মানী বাবদ তিনি যে অর্থ পান তা দিয়ে তার পরবর্তী এক বছর আরামছে চলে যায়। এই একটা বছর তিনি নতুন আরও দুটি বই লেখার জন্য যথেষ্ট গবেষণা ও অনুসন্ধানের সময় পান। এ সময়টা কাজে লাগিয়ে তিনি আবার নতুন দুটি বই লিখে ফেলেন।

আর আমাদের প্রকাশনীগুলো যে সামান্য সম্মানী লেখকদের জন্য বরাদ্দ করেন, তা দিয়ে কোনোমতে দু’মাসের বাড়িভাড়া দেয়া যায়। বাজার-সদাই আর সংসার চালানোর জন্য তখন লেখক মহোদয়কে নানা ধান্ধায় ছুটতে হয়। ধান্ধায় দৌড়াতে দৌড়াতে বই লেখার সময় কই! কিন্তু সত্যিকারার্থে যদি আমাদের প্রকাশক আর লেখকদের মাঝে পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠতো তবে লেখকরা যেমন ভালো বই লেখার অনুপ্রেরণা পেতেন তেমনি প্রকাশকরাও মৌলিক বই ছাপিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ পেতেন। দুই নম্বরি করে বিদেশি বই অনুবাদ কিংবা আরেক প্রকাশনীর বই মারিং-কাটিং করে ছাপানোর প্রয়োজন হতো না। লাভবান হতেন দুই শ্রেণির মানুষই।


Leave a Reply

Your email address will not be published.