ইতিহাসবিখ্যাত ইয়ারমুকের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ডাক এসেছে সেখানে যাবার। ক্ষুধিত চিতার মতো ইকরামা রাদিয়াল্লাহু আনহু ছুটে গেলেন ইয়ারমুকের যুদ্ধবিক্ষুব্ধ প্রান্তরে। প্রচণ্ড লড়াইয়ে থর থর করে কাঁপছিলো ইয়ারমুকের প্রান্তর। পারস্যবাহিনীর বিশাল রণসজ্জার কাছে মুসলমানদের নগণ্য সংখ্যাকে হাস্যকরই মনে হয়। তবুও প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছেন মুসলিম বীরগণ।
যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের একপর্যায়ে মুসলমানদের পরাজয়বরণ করার উপক্রম হলো। এমনকি অনেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তগ্রহণ করলো। সাধারণ দৃষ্টিতে মুসলমানদের পরাজয় স্বাভাবিক ছিলো, কারণ মুসলমানরা সর্বসাকুল্যে ছিলো মাত্র ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশ হাজার আর রোমানরা ছিলো এক থেকে দেড় লাখের বিশাল বাহিনী।
এমন সময় দেখা গেলো ইকরামা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে। যুদ্ধের তীব্রতা দেখে তিনি ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন। তরবারির খাপ ভেঙে ফেললেন এবং কোনোরকম পরোয়া না করে রোমানদের ব্যুহে ঢুকে পড়লেন।
তখন খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ‘হে ইকরামা! এমন কাজ করো না। কারণ তা মুসলমানদের জন্য কষ্টদায়ক হবে।’
ইকরামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘হে খালিদ! আমার ব্যাপারে চিন্তা করবেন না। কারণ রাসুলের সাহচর্য আপনি আমার চেয়ে বেশি পেয়েছেন। আর আমি ও আমার পিতা তো রাসুলুল্লাহর ঘোর দুশমন ছিলাম। তাই আমাকে পাপমোচন করার সুযোগ দিন। আপনি ভয় পাবেন না, বহু রণক্ষেত্রে রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। আর আজ বুঝি রোমানদের থেকে পালিয়ে যাবো? নিশ্চিত থাকুন, তা কিছুতেই হবে না।’
এরপর পেছন ফিরে মুসলমানদের মাঝে বজ্রকণ্ঠে আহ্বান করলেন, ‘কে আছো যে মৃত্যুর শপথগ্রহণ করবে?’
তার চাচা হারেস ইবনে হিশাম, জিরার ইবনে আজওয়ারসহ চারশত মুসলমান তাঁর হাতে আমরণ লড়ার শপথগ্রহণ করলেন।
তারা খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বের বাইরে মরণপণ যুদ্ধ করলেন এবং প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুললেন। অকস্মাৎ বিদ্যুতের মতো তারা রোমানবাহিনীর ভেতরে ঢুকে গেলেন এবং পুরো রোমানবাহিনীর ভিত নাড়িয়ে দিলেন।
তাদের এ অভাবনীয় প্রতিরোধের ফলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেলো এবং অবশেষে বিজয় এসে পদচুম্বন করলো মুসলমানদের।
আর সেই চারশ’জন অকুতোভয় মৃত্যুঞ্জয়ীর প্রায় সবাই শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে বেহেশতের সবুজপাখি হয়ে গেলেন।
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। রণাঙ্গনজুড়ে পড়ে আছে আহত-নিহত সৈনিকদের দেহ। একপ্রান্তে দেখা গেলো তিনজন মুজাহিদ পড়ে আছেন। ক্ষতস্থান থেকে অবিরত রক্তপ্রবাহ তাদের অত্যন্ত দুর্বল করে ফেলেছে। এ তিনজন হারেস ইবনে হিশাম, আইয়াস ইবনে আবি রবিআ এবং ইকরামা ইবনে আবুজাহেল রাদিয়াল্লাহু আনহুম।
তাঁদের শুশ্রূষার জন্য এগিয়ে এলো স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দল। তাঁদের কাছে পান করার জন্য পানি চাইলেন হারেস ইবনে হিশাম। তাঁকে পানি দেয়া হলে ইকরামা তৃষিত নয়নে তাঁর দিকে তাকালেন। হারেস তখন বললেন, ‘তাঁকে পানি দাও।’
ইকরামার কাছে পানি নেয়া হলে তিনি দেখলেন, আইয়াস তাঁর দিকে তৃষ্ণার্তচোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। ইকরামা তখন বললেন, ‘আইয়াসকে পানি দাও।’
আইয়াসের কাছে যেতে যেতে তিনি পার্থিব তৃষ্ণার সমস্ত হিসাব চুকিয়ে পান করে নিয়েছেন বেহেশতের ‘শারাবান তহুরা’। ওপারের ডাকে সাড়া দিয়ে মিলিত হয়েছেন পরম আরাধ্য প্রভুর সঙ্গে। আর কোনোদিন পিপাসা লাগবে না তাঁর।
স্বেচ্ছাসেবকদল জলদি এলেন হারেস ইবনে হিশামের কাছে। কোথায় ইবনে হিশাম? ইবনে হিশাম তো এখানে নেই! এখানে পড়ে আছে কেবল তাঁর প্রাণহীন বিক্ষত দেহ। তাঁর আত্মা যে আগেই মিলিয়ে গেছে বাতাসে! এতোক্ষণে পৌঁছে গেছে বেহেশতের বাগিচায়। কাওসার সরোবরে এখন তিনি জুড়িয়ে নিচ্ছেন অবারিত প্রবল তৃষ্ণা।
স্বেচ্ছাসেবকরা হারেসের চলে যাওয়া দেখে জলদি ফিরে এলো ইকরামার কাছে। না, ইকরামাও নেই। শুধু আকাশপানে অপলক চেয়ে আছে তাঁর দুটো তৃষ্ণার্ত চোখ। যেচোখ আমরণ পান করতে চেয়েছে জান্নাতি শরাব। দুনিয়ার দু’ ফোটা জলে কীভাবে মিটবে তার তৃষ্ণা কোনোদিন? বেহেশতি সবুজপাখি হয়ে তিনি উড়ে গেছেন আকাশ সুদূরে। যাবার বেলায় রেখে গেছেন ঝরেপড়া কয়েকটি পালক। যে ঝরেপড়া পালকের প্রতিটি বিন্দুবিসর্গে লেখা আছে আত্মদানে মাতোয়ারা উম্মতের বিজয় সংবিধান। সে পালকের অলঙ্কারে রক্তাক্ষরে লিখে গেছেন পৃথিবীর কাছে সমর্পিত রক্তের ঋণ।
আর এভাবেই ত্যাগের মমতা দিয়ে, রক্তমাখা তৃষ্ণা দিয়ে ইকরামা ইবনে আবুজাহেল মোচন করেছিলেন তাঁর পূর্বজীবনের পাপরাশি আর পঙ্কিল অতীত।
গ্রন্থ : হাজার বছরের ভালোবাসা
[সূত্র : আল-বিদায়া ওয়াননিয়াহা ও সুওয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবা]