সম্ভবত আবু তাহের মিসবাহ সাহেবের কোনো একটা লেখায় এমনটি পড়েছিলাম— রিকশাচালকের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে কখনো বাগ-বিতণ্ডা করো না। এতে তার কিছুই হবে না, তোমার সম্মান নষ্ট হবে।
এটা পড়ার পর দুই শ্রেণির লোকদের সঙ্গে পারতপক্ষে কখনো ভাড়া নিয়ে বিতণ্ডা করি না— রিকশাচালক এবং বাসের কন্ডাক্টর। পারলে দু-চার টাকা বেশি দিয়ে দেই। দুটো কারণে।
এক. সম্মান নষ্ট হওয়ার বিষয়টি তো খুব স্বাভাবিক। রিকশাচালক বা কন্ডাক্টরের কাজই হচ্ছে আপনার কাছ থেকে দুই বা পাঁচটি টাকা বেশি নেয়া। এতে সে নিজের সম্মানের মোটেও ধার ধারে না। কিন্তু দু’ টাকার জন্য আপনি যদি তার সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হন তাহলে আপনার হাজার টাকার সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে। আশপাশের সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখবে। আপনার জন্য অনেকে করুণাও দেখাবে হয়তো। এমনি করে দু’ টাকার জন্য নিজের সোপার্জিত সম্মান নষ্ট করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
দুই
পাঁচটি টাকার ব্যাপারই তো মাত্র। আপনার কাছে পাঁচটি টাকা কোনো ব্যাপারই না। বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে কোথাও বসলে দুশো-চারশো টাকা এমনিই চলে যায়। মোবাইলে টকটাইম আর এমবির জন্য প্রতিদিন চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা বরাদ্দ থাকেই। সেখানে রিকশাচালককে পাঁচটা টাকা বেশি দিলে পকেটটা খুব বেশি আহাজারি করবে না।
আপনার মতো দশজনের কাছ থেকে পাঁচ টাকা করে পেলে ওর এক কেজি চালের দাম হয়ে যাবে। ছেলেমেয়ের স্কুলড্রেস কিনে দিতে পারবে। বাড়িতে বৃদ্ধ মায়ের জন্য কিনতে পারবে একটি চাদর। শীতের রাতে রিকশা চালাতে কষ্ট হয় বলে কিনতে পারবে একটা মাফলার।
আমি এমন অনেককে জানি, যারা বাস কন্ডাক্টরকে ভাড়া কম দিতে পারাটাকে একধরনের বীরত্ব মনে করে। বন্ধুরা কয়েকজন একসঙ্গে থাকলে, দুই টাকা ভাড়া কম দিয়ে এক বন্ধু অন্যদের দিকে একটা বীরপুরুষের দৃষ্টিতে তাকায়— দেখছোস আমার ক্ষমতা!
রিকশাচালকের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে ঝগড়া করাটাকে কেউ কেউ নিজের একটা নাগরিক অধিকার মনে করে। রিকশাচালক তো আপনার কাছে ভিক্ষা চায়নি, শরীর দিয়ে পরিশ্রম করেছে, দুটো টাকা বেশি দাবি করতেই পারে। রিকশা চালানো কোনো সহজ কাজ নয় বাপধন! দুজন তিনজনকে বসিয়ে রিকশার প্যাডেল মারা, দেখতে সোজা মনে হলেও পায়ের পাতা গড়িয়ে দরদর করে ঘাম পড়ে।
পাবলিক বাসে স্টুডেন্ট ভাড়া নামে এক ধরনের ভাড়াব্যবস্থা চালু আছে। বাংলাদেশে সুযোগের সবচে বড় অপব্যবহার সম্ভবত এই স্টুডেন্ট ভাড়ার নামে হয়। এটা ঠিক, স্টুডেন্ট ভাড়ার হকদার ছাত্ররা। কিন্তু এটা সেইসব ছাত্রদের জন্যই প্রযোজ্য যারা সত্যিকারার্থে ফুল ভাড়া দিতে অক্ষম। যাদের ফুল ভাড়া দিলেও রাতে অভুক্ত থাকার আশংকা নেই, তাদের উচিত বাসের কন্ডাক্টরকে সঠিক ভাড়া প্রদান করা। ছাত্রাবস্থায় ফ্রি’র অভ্যাস হয়ে গেলে কর্মজীবনে এ অভ্যাস বদঅভ্যাসে পরিণত হওয়া স্বাভাবিক।
আপনি রিকশাওয়ালা আর কন্ডাক্টরকে দু টাকা কম দিতে অনেক সময় গালিগালাজে লিপ্ত হন, কখনো হাত তোলার মতো গর্হিত কাজও করে ফেলেন। শুধুমাত্র কয়েকটি টাকার হক আদায় করতে। আপনার কি কখনো মনে হয় না— সরকার, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, মোবাইল কোম্পানি, কর্পোরেট দুর্নীতি প্রতিদিন আমাদের দ’লে পিষে, আমাদের রক্ত-ঘাম চুষে কোটি কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে?
রিকশাওয়ালা আর বাসের কন্ডাক্টরের সঙ্গে অযথা যে দেমাগ, ক্ষোভ, রোষ দেখান, সেটা পুষে রাখুন। যেখানে সেখানে অযথা ক্ষয় করবেন না। সময় সুযোগ এলে ওই রাঘববোয়ালদের টুঁটি চেপে ধরে তারপর নিজের হকের কথা বলবেন। এতে আপনার ও জাতি, উভয়েরই লাভ হবে।