শেখ ফজলুল করীম মারুফ পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিয়ে যে পোস্ট করেছিলেন ফেসবুকে, সেই পোস্টের কথাগুলো অনেকেই হয়তো সরল পথে বুঝতে পারেননি বা বুঝতে চাননি। তিনি চরমোনাইকেন্দ্রিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে তাকে তুলোধুনা করার একটা দারুণ মওকা অনেকে হাতছাড়া করতে চাননি। ফলে একতরফাভাবে তাকে দোষারোপ করেই যাচ্ছেন সবাই।
সম্ভবত তিনি তার আলোচিত পোস্টটি মুছে ফেলেছেন ফেসবুক থেকে। আমি তার ওয়ালে গিয়ে লেখাটি পাইনি। তিনি সত্যিকারার্থে লেখাটি পোস্ট করেছিলেন কিনা, সে ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত নই। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকার দরুণ ফোন বা মেসেজে নিশ্চিত হতেও পারছি না। তবু যেসব স্ক্রিনশট ভেসে বেড়াচ্ছে, তার আলোকে দু-তিনটে কথা বলি।
এক.
আমি শেখ মারুফের বক্তব্যের সঙ্গে অনেকাংশে একমত। পহেলা বৈশাখ উদযাপন বা নতুন বছর উদযাপন নিশ্চয় দোষণীয় কিছু নয়। আমরা তো ঘটা করে হিজরি নববর্ষ উদযাপন করি, তাহলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে বাধা কোথায়?
কথা হলো উদযাপনের তরিকা নিয়ে। আমাদের দেশে পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ বরণের যে শোভাযাত্রা ও অন্যান্য আয়োজন হয়, এগুলো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অবশ্যই নিন্দনীয় ও গর্হিত। হোক সেটা যতই সংস্কৃতির দোহাই বা জাতিসত্তার দোহাই, এগুলো কোনোভাবেই বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতিকে লালন করে না। এগুলো হিন্দু সংস্কৃতির পশ্চাদলেহন। আর হিন্দু সংস্কৃতি কীভাবে মুসলিম বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি হতে পারে?
সুতরাং উদযাপনের তরিকার কারণে কৃষিনির্ভর বাংলার প্রয়োজনীয় ‘বাংলা বর্ষের’ নববর্ষকে ঘৃণা করা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাছাড়া এখন নববর্ষের নামে যে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়, এটা গত শতকের আশির দশকে আবিষ্কার করা হয়েছে। এর আগে বঙ্গীয় ইতিহাসে এমন কিম্ভূতকিমাকার বর্ষবরণ শোভাযাত্রার কোনো অস্তিত্ব ছিল না।
অধুনা একটি সাংস্কৃতিক অপভ্রংশের কারণে বাংলা বর্ষবরণকে অচ্ছুৎ ভাবার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
দুই
বিয়ের অলিমার মধ্যে অনুষ্ঠান ও ভালো খানাপিনা এন্তেজামের কথা হাদিসে আছে। নবীজি উৎসাহ দিয়েছেন বিয়ের অলিমায় অনুষ্ঠান করতে। এখন সেই অলিমা ‘অনুষ্ঠান’ উদযাপনে করতে গিয়ে কেউ গায়ে হলুদ ‘হলদি ড্যান্স’ বা ডিজে পার্টির বন্দোবস্ত করলে সেখানে তো নবীজির উৎসাহ বা হাদিসের প্রণোদনাকে দোষ দেয়া যাবে না। দোষ তো আমাদের মানসিকতার, যারা অনুষ্ঠানের নামে হিন্দুয়ানী ও পশ্চিমা সংস্কৃতিকে নিজেদের সংস্কৃতি বানিয়ে নিয়েছি।
বাংলার কৃষিনির্ভর জীবনব্যবস্থাকে ষড়ঋতুর মৌসুমভিত্তিক সুবিধা দেয়ার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছিল বাংলা বর্ষ। এটা বঙ্গভূমির নিজস্ব বর্ষগণনা। আপনারা যারা নগরকেন্দ্রিক মানুষ তারা হয়তো বুঝতে পারবেন না, তবে গ্রামীণ কৃষি সমাজে এখনও বাংলা তারিখ অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। গ্রামের গেরস্ত-কৃষক সবাই বাংলা তারিখ অনুযায়ী অমাবস্যা, পূর্ণিমা, মাসের শুরু-শেষ, সাকরাইন, বারো চান্দ ইত্যাদি গণনা করে থাকে। কেননা এর সঙ্গে তাদের কৃষিজীবন সম্পৃক্ত। তাদের ধান, পাট, সরিষা, ফসল পাকা-কাটা, ঘরে তোলা সব এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
এ জন্য নগরে বসে বসে আপনি বাংলা সনের প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা ঠাহর করতে পারবেন না। যাদের কাছে এই বাংলা সন অতীব জরুরি, সেই কৃষকদের কাছে বর্ষবরণ বা মঙ্গল শোভাযাত্রার কোনো আবেদনই নেই। যারা সারা বছর একদিন বলতে পারে না আজ বাংলা মাসের কয় তারিখ, তারাই বাঙালি সংস্কৃতির ধ্বজা নিয়ে শাহবাগে নাচন-কুদন করে।
তিন
শেখ মারুফের কথার অর্থ সম্ভবত অনেকটা এমনই ছিল। তিনি বলতে চেয়েছেন, একটা প্রয়োজনীয় বর্ষকে কেন আমরা দূরে ঠেলে দিচ্ছি? এই বাংলা সন আমাদের জীবনযাপনের জরুরি একটা অংশ, সেই হেতু এর বর্ষবরণও তো দোষের কিছু নয়। বর্ষবরণের অনুষ্ঠানাদিতে আমাদের আপত্তি আছে, সেটা না বললেই নয়। কিন্তু বাংলা বর্ষবরণে কোনো ধর্মীয় বাধা নেই।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে কোনো প্রতিষ্ঠান যদি কুরআন খতমের আয়োজন করে, অথবা কোনো মাদরাসায় বাংলা কবিতা ও হামদ-নাত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়, কোনো স্কুলে যদি বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়, কোনো কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে নানাধর্মী আলোচনা ও পুস্তক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়, কোনো মহল্লা কর্তৃক বয়ান-ওয়াজের বন্দোবস্ত করা হয়, তবে সেটাকে দোষ দেয়ার তো কিছু দেখি না।
অন্যকে দোষারোপ করার মধ্যে তেমন কোনো বাহাদুরি নেই। আমার নিজের সংস্কৃতি হিন্দু সংস্কৃতিতে কনভার্ট হয়ে যাচ্ছে আর আমি এই দোষ অমুক তমুককে দিয়ে নিজে নিরাপদ দূরত্বে বসে ডুগডুগি বাজাচ্ছি; এগুলো কাপুরুষতা।
বাহাদুরি হলো, আপনার ছিনতাই হওয়া নিজের সংস্কৃতিকে অন্যের হাত থেকে ছিনিয়ে এনে নিজের রঙে রাঙানো। নিজের মতো করে উদযাপনের পরিবেশ তৈরি করা। না পারলে দোষ দেয়া থেকে বিরত থাকুন।
এটা লড়াই, এখানে লড়তে শিখুন। শিশুদের মতো কাদা ছোড়াছুড়ি আপনাকে মানায় না।