‘নসীম হিজাজি’র সঙ্গে আমার পরিচয়টা হয়ে গেল বড় কাঁচা বয়সে। বয়েস বড়জোর বারো-তেরো। আমি পাশের গ্রামের হেফজখানার তলবে এলেম। দিন-রাত যায় কুরআন মুখস্থ করতে। সেই অন্ধকার ভোরে উঠে পড়ো পড়ো, সারা দিন কুরআনের জপ মুখে। খানিকটা ফুরসত মিলে আসরের পর থেকে মাগরিবের আগের সময়টায়। ওই বিকেলটুকু কাটাতে হয় খেলাধুলা বা এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করে। নইলে দিনমান বসে থাকা শরীরটা ম্যাজম্যাজ করে। বিকেলের সময়টুকু তলবে এলেমদের নিজস্ব। যে যার মতো করে যাপন করে।
একদিন হেফজখানার বড়হুজুর বই পড়ার নানাবিধ ফজিলত বর্ণনা করলেন। প্রতি শুক্রবার সকালে সব তলবে এলেমকে বসিয়ে ঘণ্টাখানেক নসিহত করা রেওয়াজ। সেখানেই বলেছিলেন বইপাঠের গুরুত্ব। তো, আমরা টুকটাক বইপড়া শুরু করলাম। যার কাছে যা ছিল রঙিন-সাদাকালো, সেগুলো অদলবদল করে পড়তে লাগলাম।
আমার খানিকটা পূর্বাভ্যাস ছিল। বাড়িতে আব্বা এবং আপারা দারুণ বই-টই পড়তেন। হাইস্কুলের পাঠাগার থেকে হুমায়ূন, মিলন, সমরেশ আর সুনীল এনে লুকিয়ে চুরিয়ে চলত তাদের পাঠাভিযান। ওসব থেকে একটা ভাগ আমিও পেতাম। সুতরাং, বইপড়ার অভ্যাসটা আমার ছিল যে, সেটা অস্বীকার করব না।
নতুন করে যেটা হলো, হেফজখানায় ছোট হুজুরের কামরায় একটা আলমারি ছিল। ওই আলমারি ভরা ছিল অনেক অনেক বই। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে মসজিদভিত্তিক পাঠাগারের আলমারি ওটা, আর বইগুলোও ফাউন্ডেশন থেকে দেয়া। পুরোনো মসজিদ, সেখানে না রেখে আলমারিটা রাখা হয়েছে হেফজখানায়। এখান থেকে বই নিয়ে সবার পড়ার অধিকার আছে। কিন্তু কাউকে তো নিতে দেখি না। এতদিন শুধু মোটা-চিকন, ছোট-বড় আর হরেক রঙের বইগুলো শুধু দেখেই এসেছি; কাউকে পড়তে দেখলাম না। কীভাবে পড়ে এসব বই?
এক শুক্রবার আমার ভাগ্যের চাকা মোড় নিল। প্রতিবছর একবার করে আলমারির বইগুলো রোদে শুকিয়ে ঝারপোছ করে আবার সাজিয়ে রাখতে হয়। এবার যখন সেই দিনটা এলো, আমি বইগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলাম। রোদে শুকাতে গিয়ে একটা বই খুব মনে ধরে গেল-‘মরণজয়ী’। লেখকের নাম নসিম হিজাজি। তাতে তেমন কিছু যায় আসে না। আসল ঘটনা হলো, বইটির প্রচ্ছদে একজন অশ্বারোহীর ছবি আঁকা। তরবারি উঁচিয়ে সে তীব্র গতিতে ধাবমান। ওই প্রচ্ছদপট আমার পছন্দ হলো। সাহস করে ছোট হুজুরকে বললাম, এ বইটা আমি পড়তে চাই। হুজুর অনুমতি দিলেন।
সারাটা শুক্রবার গেল ওটা পড়ে পড়ে। পড়ার গতি ধীর, যখনই পাঁচ-দশ মিনিট সময় পেতাম তখনই মরণজয়ী নিয়ে চুপটি করে বসে পড়তাম। ঘোরলাগা নেশার মতো চক্কর খেতে লাগলাম এক কিশোর-কিশোরীর নাবালক প্রেম থেকে উমাইয়া খেলাফতের রাজধানী দামেস্কে, সেখান থেকে সিন্ধুবিজয়ী বীর মুহাম্মদ বিন কাসিমের সঙ্গে হিন্দুস্তান, আবার বাগদাদ থেকে বসরা, প্রেম, বেদনা, বিজয় আর যুদ্ধের মিশেলে কিশোর মনকে আকর্ষিত করার পরিপূর্ণ এক দাওয়াই।
নসিম হিজাজির সঙ্গে সেই শুরু হলো। আলমারিতে তার লেখা আরও বই ছিল-শেষ প্রান্তর, ভেঙ্গে গেলো তলোয়ার, সীমান্ত ঈগল, হেজাযের কাফেলা, আঁধার রাতের মুসাফির। এ সকল ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়ে ফেললাম কিছুদিনের মধ্যে। আমার ভেতরে তখন থই থই করছে ইসলামি ইতিহাসের অজস্র ঘটনা। অসংখ্য যুদ্ধ আর সোনালি অতীতের হিরন্ময় বিজয়গাথা আমাকে তাড়িয়ে ফিরছে টই টই করে।
এভাবেই ইতিহাসের সঙ্গে হয়ে গেল প্রথম চিন-পেহচান। পাকিস্তানি ঔপন্যাসিক নসিম হিজাজির সবগুলো উপন্যাস ওই কিশোরকালেই পড়া শেষ করেছিলাম। যে মুগ্ধতা তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন আমার কিশোর মনে, সে মুগ্ধতা চুইয়ে পড়া ফোঁটা ফোঁটা জলেই আজকে লেখার কোশেশ করছি দু’কলম।
দুই
নসিম হিজাজি ছিলেন ইতিহাস পাঠের শুরু, সেই প্রারম্ভিকা পরিশীলিত করেছে সেবা প্রকাশনী। বিশেষত বললে হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড। স্যার হ্যাগার্ডের প্রতি আমার অন্যরকম মুগ্ধতা রয়েছে। তাঁর উপন্যাসগুলো একেবারেই কাল্পনিক। নসিম হিজাজি যেখানে ইতিহাসের সত্য ঘটনাকে উপজীব্য উপন্যাসের দ্যোতনা সাজান, স্যার হ্যাগার্ড তার চেয়ে আরেক কাঠি সরেস। কল্পিত কাহিনির সঙ্গে খুব সামান্যই থাকে বাস্তবতার মিশেল। কোনো কোনো ঐতিহাসিক উপন্যাস একেবারেই সত্য বিবর্জিত। নিজের কল্পনাশক্তির আশ্রয় নিয়ে এমন এমন কাহিনির অবতারণা করেন এবং সেই কাহিনির মধ্যে যেভাবে মিশ্রণ করেন অ্যাডভেঞ্চার, রোমাঞ্চ, টান টান উত্তেজনার অনুষঙ্গ -তাঁর এই মুনসিয়ানা আমাকে পরবর্তী লেখালেখিকে প্রভাবিত করেছে।
স্যার হ্যাগার্ডের প্রথম যে বইটা পড়ি, সেটা ‘মুন অভ ইজরাইল’। নবী মুসা এবং তৎকালীন ফারাও রাজপরিবারের সময়কার কাহিনি উপজীব্য করে রচিত হয়েছে এ উপন্যাস। নবী এবং ফারাও উপন্যাসের মূল চরিত্র নয়, উপন্যাসের কাহিনি নির্মাণ হয়েছে মিসরের যুবরাজ শেঠিকে কেন্দ্র করে, সঙ্গে আছে ইজরাইলি মেয়ে মেরাপি। রাজকীয় বংশকৌলিন্য জলাঞ্জলি দিয়ে যুবরাজ শেঠি প্রেমে পড়েন রাস্তার ভিখিরি প্রায় এই ইজরাইলি মেয়ের। সুতরাং কাহিনি জমজমাট হতে বাধ্য।
‘মুন অভ ইজরাইল’ বইটা আমার সামনে নতুন একটা দর্শন খুলে দিয়েছিল। বইটা শেষ করার পর আমি ভাবতে লাগলাম, স্যার হ্যাগার্ড এখানে যে কাহিনিটা বয়ান করলেন, এ কাহিনিটা তো তাঁর চেয়ে আমি ভালো জানি। আমাদের কুরআন এবং হাদিসে এই কাহিনি অঢেল বর্ণনা করা হয়েছে। তাফসির এবং ইসলামি ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে নবী মুসা এবং তৎকালীন ইজরাইলি সম্প্রদায়ের বিস্তর আলোচনা রয়েছে। তাহলে আমরা মুসলিমরা কেন এমন একটা উপন্যাস লিখতে পারলাম না? এখানে তো নবীর ব্যাপারে মিথ্যা কিছু বলা হয়নি বা তাঁর আনীত ধর্মের ব্যাপারেও বিষোদ্গার করা হয়নি। নবী এবং ধর্মকে নিজের জায়গায় রেখে লেখক তাদের চারপাশে এমন কিছু চরিত্র তৈরি করেছেন যাদের দ্বারা ইতিহাসের ওই অংশটুকুর কোনো প্রকার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। নবী এবং ধর্মীয় মিথ নিজস্ব ইতিহাসের গতিতে চলবে, সঙ্গে চলবে পারিপার্শ্বিক আরও কিছু চরিত্র-যারা একটা বইকে উপন্যাসে রূপলাভে সাহায্য করবে।
তাহলে সমস্যাটা কোথায়? এই চিন্তা আমাকে ইসলামের ইতিহাস এবং ইতিহাসের মিথ নিয়ে আরও বিস্তর পড়াশোনা করতে আগ্রহী করেছে। বিশেষত নবীদের কাহিনি পড়ার আগ্রহ তৈরি করেছিল মুন অভ ইজরাইল।
নসিম হিজাজি এবং হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড – এ দুজন আমার ইতিহাস পাঠের অন্যতম শিক্ষক। তাদের কারণেই ইতিহাসের অনিসন্ধিৎসু পাঠক হওয়ার ব্রত তোলা হয়েছে কাঁধে।
কেবলই ধ্রুপদী সাহিত্য কিংবা কেবলই ইতিহাস নয়, ধ্রুপদী সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে আমি ইতিহাস পড়ি। বিশেষত বিদেশি অনুবাদ। ধ্রুপদী সাহিত্য থেকে আমি লেখার শিল্পকলা গ্রহণের চেষ্টা করি, আর ইতিহাস থেকে তুলে আনি লেখার রসদ।
বইপড়া তো এক ধরনের ম্যাজিক, অলৌকিক দিব্যদৃষ্টি খুলে যাওয়ার মতো ব্যাপার। তো, সেই দিব্যদৃষ্টি দিয়ে যদি আমি হাজার বছর আগে অতীত দেখে আনন্দ পাই, এর চেয়ে অলৌকিক আনন্দ আর কী হতে পারে!