ঘটনা ২০০৭ সালের। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী আটটি দেশ নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন জি-এইট-এর শীর্ষ সম্মেলনটি এবার একটু অন্যরকমভাবে অনুষ্ঠিত হবে। বৈশ্বিক এসব সংগঠনের শীর্ষ সম্মেলনগুলো সাধারণত রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মেলনকেন্দ্র অথবা পাঁচতারা হোটেলেই হয়ে থাকে। কিন্তু বিশ্বের সর্বাধিক ক্ষমতাধর আটজন রাষ্ট্রপ্রধানকে নিয়ে এবারের শীর্ষ সম্মেলনটি হচ্ছে একেবারে ভিন্ন পরিবেশে। বিশ্বের সবচেয়ে বিলাসবহুল এবং বড়ো জাহাজ ‘কুইন মেরি-২’-এ অনুষ্ঠিত হবে এবারের জি-এইট শীর্ষ সম্মেলনটি। জাহাজটি নিউইয়র্ক বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে পুরো আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ভিড়বে বৃটেনের সাউদাম্পটন বন্দরে। এই যাত্রাপথেই রাষ্ট্রপ্রধানরা সেরে নেবেন তাদের সম্মেলন, দ্বিপাক্ষিক বৈঠক, চুক্তি এবং সর্বোপরি একটি চমৎকার সমুদ্রভ্রমণ। 

এটি একদিক থেকে যেমন অভিনব এবং চিত্তাকর্ষক, অপরদিক থেকে তেমনি প্রবল শঙ্কা এবং নিরাপত্তাহীনতার বিষয়। তবে আমেরিকা এবং বৃটেনের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন চৌকস নিরাপত্তাবাহিনী, স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত সার্বক্ষণিক নিরাপত্তাবলয়, বিশ্বকাঁপানো আমেরিকান সপ্তম নৌবহরসহ সাধ্যের সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। নির্ধারিত দিনগুলোতে সমুদ্র ও আকাশসীমাকে সম্পূর্ণ নিরাপদ রাখতে সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা সংস্থাগুলো কাজ করছে প্রায় এক বছর আগে থেকে। কিন্তু বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর আটজন প্রেসিডেন্ট এবং অন্যান্য প্রায় ৪২০০ যাত্রী নিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দেবে যে জাহাজটি, সেটি কি আসলেই নিরাপদে পৌঁছতে পারবে ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বন্দরে? অত্যন্ত খতরনাক প্রশ্ন।

ফ্রেডরিক ফরসাইথ নামটি থ্রিলারধর্মী উপন্যাস পাঠকের কাছে খুব বেশি আজনবি নয়। বৃটিশ এই লেখক পশ্চিমাবিশ্বে বিপুল জনপ্রিয় ১৯৭১ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ডে অব দ্য জ্যাকল’ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই। একসময় চাকরি করেছেন বিবিসি এবং রয়টারে। ফলে যেকোনো ঘটনাকেই আনুপুঙ্খিকভাবে দেখার এবং অনুধাবন করার চমৎকার একটি মেধা রয়েছে তার। থ্রিলার উপন্যাস লেখার যেটা আবশ্যিক অনুষঙ্গ। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ২০টির মতো উপন্যাস রচনা করেছেন, সবগুলোই আমেরিকার বেস্টসেলারে পরিণত হয়েছে।

ফ্রেডরিক ফরসাইথের সঙ্গে আমার পরিচয় তেমন একটা গাঢ় নয়। বছর তিনেক আগে আমি তার ওই একটি বই-ই পড়েছিলাম ‘দ্য ডে অব দ্য জ্যাকাল’। বাংলা অনুবাদ। পড়ার পরে আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলাম যে, থ্রিলার লেখা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজের একটি। এরপর লেখকের আরও গোটা দুই বই পাঠের সুযোগ হয়েছে।

যা হোক, উপরোল্লিখিত ঘটনাংশ ২০০৬ সালে প্রকাশিত ফ্রেডরিক ফরসাইথের ‘দি আফগান’ উপন্যাসের উপসংহার সংক্ষেপ। নাম শুনে পাঠকমাত্রই খানিকটা নোনতা স্বাদ অনুভব করবেন জিভের ডগায়। আমার বেলায়ও তাই হয়েছিলো। পল্টনের পুরনো বইয়ের দোকানে ‘দি আফগান’ নামটি দেখেই আমার ভ্রু কুঁচকে উঠেছিলো। কৌতূহল নিবারণের তাগিদে খরিদ করে পড়া শুরু করলাম।

পাঠকদের জানিয়ে রাখি, পঠিতব্য রচনাটি নিছক গ্রন্থ আলোচনা নয়। আমরা ফরসাইথের উপন্যাসের ঘটনা বর্ণনার ভেতর দিয়ে সুদূর পশ্চিম, পশ্চিমের সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ, আলকায়েদা তথা ইসলামি সন্ত্রাসবাদের উত্থান নিয়ে মার্কিনিদের সৃষ্ট মিথ, তাদের দ্বেষ এবং তার বহিঃপ্রকাশটাও জানতে পারবো। তা ছাড়া, সন্ত্রাসবাদ নিয়ে পশ্চিমের সুলভ অপপ্রচারও জানতে পারবো সাধারণ জ্ঞান দিয়ে।

তো, করাচির খুব সামান্য একটি ঘটনা দিয়ে উপন্যাসের শুরু। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সন্দেহভাজন একটি মোবাইল নাম্বার থেকে ৩ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডের একটি ফোনকল চিহ্নিত করে। চিহ্নিত করা সেই কলটি যেখান থেকে করা হয়েছিলো তারা দ্রুত সেখানে পৌঁছে যায় এবং আলকায়েদার একজন শীর্ষ অর্থ যোগানদাতার সন্ধান পায়। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতি টের পেয়ে আলকায়েদায়িস্ট লোকটি পাঁচতলা থেকে লাফ দেন এবং ঘটনাস্থলেই তিনি ওপারের যাত্রী হন।

আইএসআই-এর সদস্যরা তাকে জীবিত ধরতে না পেরে বেজায় নাখোশ হন এবং মৃতলোকটিকে তার অকালমৃত্যুর জন্য প্রচুর গালমন্দ করতে থাকে। তবে তাদের সঙ্গে থাকা একজন সিআই এজেন্ট কিন্তু খুব একটা নাখোশ হন না। কেননা তিনি তখন ঘটনাস্থল থেকে আলকায়েদায়িস্টের ব্যবহার করা একটি ল্যাপটপ বগলদাবা করতে পেরেছেন। 

সিআইএ এজেন্ট ল্যাপটপটি উদ্ধার করে জলদি নিজের স্টেশনে নিয়ে যান এবং এটির হার্ডডিস্কে থাকা সমস্ত তথ্য তখনই স্যাটেলাইট কমিউনিকেশনের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন আমেরিকা এবং বৃটেনের গোয়েন্দা হেডকোয়ার্টারে। সেখানকার কম্পিউটার এ্যানালিস্টরা মুহূর্তের মধ্যে কাজ শুরু করেন। 

মাঝে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে রাখি। অনেকেই মনে করেন, কম্পিউটার বা মোবাইল থেকে একবার কোনো একটি ফাইল বা ফটো ডিলিট করলে সেটি চিরতরে মুছে যায়। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে তা নয়। সফটওয়্যারের মাধ্যমে অনেক আগে কম্পিউটার থেকে ডিলিট করা ফাইলও পুনরুদ্ধার বা রিকভারি করা সম্ভব। 

সে যাই হোক, মূল ঘটনায় ফিরে আসি। কম্পিউটার অ্যানালিস্টদের মাধ্যমে ল্যাপটপের হার্ডডিস্কের মেমোরিতে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ব্যাংক এ্যাকাউন্ট, বিভিন্ন সময়ে টাকা লেনদেনের হিসাব, চেকবই নাম্বার ইত্যাদি পাওয়া যায়। এবং পাওয়া যায় আরবিতে লেখা দুটি চিঠি। এই দুটি চিঠির জন্যই ফ্রেডরিক ফরসাইথ পুরো সাড়ে তিনশো পৃষ্ঠার উপন্যাসটি লিখেছেন। মূলত এই চিঠি দুটোই এই উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। 

আরবি ভাষায় লিখিত চিঠি দুটো সংক্ষিপ্ত এবং কিছুটা সাংকেতিক শব্দে লেখা। গোয়েন্দা সংস্থার আরবি অনুবাদকরা জানায়, একটি চিঠি সম্ভবত আলকায়েদার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি আয়মান আলজাওয়াহিরির পক্ষ থেকে ওই মৃত আলকায়েদায়িস্টের প্রতি লেখা, অপরটি তার জবাব। তবে দুটো চিঠির মধ্যে ‘আল-আসরা’ শব্দটি এসেছে এবং এটি সফল হওয়ার ব্যাপারে প্রার্থনা করার কথা বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে সামান্য দিকনির্দেশনাও রয়েছে জাওয়াহিরির চিঠিতে। 

এই আল-আসরা শব্দটি কী, এটি দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে—এটিই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিলো গোয়েন্দাকর্তাদের কাছে। (বাংলা অনুবাদে ‘আল-আসরা’ শব্দটিকে আরবি-অজ্ঞতার কারণে কোথাও ‘আল-ইশরা’ আবার কোথাও ‘আল-ইশারা’ বলা হয়েছে। অনুবাদের ব্যাপারে কিছু কথা এই রচনার শেষদিকে উপসংহারে থাকবে বলে আশা করি।)

আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগের আরবি এবং মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষকদের ব্যাপারে কিছু না বললেই নয়। ফরসাইথ নিজেই জানাচ্ছেন আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগের আরবি এবং মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষকদের ব্যাপারে। তিনি বলছেন, ‘এই আরবি লেখাগুলো নিয়েই সংস্থার এখন যতো চিন্তা। কারণ ফোর্টমিডে একটি বিশাল সেনাছাউনি যা প্রতিরক্ষা বিভাগের অন্তর্গত। এনএসএ’র (ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি) কমান্ডিং অফিসার শুরু থেকেই একজন চারতারা জেনারেল। তার অফিসেই আরবি অনুবাদক বিভাগরে প্রধানকে তলব করা হলো। এনএসএ’র সাথে আরবি ভাষার এ গভীর সম্পর্কের সূচনা নব্বইয়ের দশকের দিকে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের উত্থানকালীন সময়ে, বিশেষ করে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে। এটি আরো গভীর হয় ১৯৯৩ সালে রামজি ইউসুফ কর্তৃক ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ট্রাকবোমা হামলাকে কেন্দ্র করে। তবে ৯/১১-এর পর কর্তৃপক্ষের মনোভাব হয়ে ওঠে- “এ ভাষার প্রতিটি শব্দের অর্থ আমরা জনতে চাই।” সে কারণে আরবি বিভাগের কলেবর বিশাল আর এতে কাজ করে যাচ্ছে চার হাজার অনুবাদক। এদের বেশিরভাগই জন্মসূত্রে আরব, তবে তাদের সাথে হাতেগোনা কিছু বিদগ্ধ অনারব পণ্ডিতেরাও কাজ করে যাচ্ছে।’

এ থেকেই অনুধাবন করা যায়, আমেরিকানরা ‘সন্ত্রাস’-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে কতোটা বেপরোয়া।

যা হোক, গোয়েন্দা সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা এই ‘আল-আসরা’ শব্দের মর্মার্থ খুঁজতে ‘কোরআন কমিটি’ নামে কোরআনের ওপর বিশেষজ্ঞ একটি দলকে আমন্ত্রণ জানায়। তারা বলেন, আল-আসরা মানে হচ্ছে মুসলমানদের নবির ঊর্ধ্বগমন বা প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাত। এমন ব্যাখ্যায় গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। এর কী মানে হতে পারে? তবে তারা অনুধাবন করতে পারেন, এটি বড়ো ধরনের কোনো পরিকল্পনা অবশ্যই। কিন্তু কী সেই পরিকল্পনা? জানার কোনো উপায় নেই। কেননা এটি যদি আলকায়েদার বড়ো ধরনের কোনো পরিকল্পনা হয়েই থাকে তা তাদের উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন ছাড়া কারো জানার কথা নয়, এ জ্ঞান বেশ ভালোই আছে পশ্চিমাদের। চুনোপুটিরা এসব জানবে না। তাহলে এখন কী করা? হয় তাদের সেই উচ্চপর্যায়ের কাউকে ধরতে হবে নয়তো তাদের ভেতরে নিজেদের একজনকে পাঠাতে হবে। প্রথমটি অসম্ভব ব্যাপার হওয়ায় কর্তাব্যক্তিরা দ্বিতীয়টিকেই বেছে নেন। এছাড়া তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই।

মাইক মার্টিন। যিনি বৃটিশ বিমানবাহিনীর এলিট ফোর্সের একজন চৌকস অফিসার এবং আরবি ভাষা ও আফগানিস্তান সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ব্যক্তি। তাকেই ছদ্মবেশে আলকায়েদার ভেতরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। 

কাহিনীর দৃশ্যপটে এই মহূর্তে আবির্ভূত হন গুয়ান্তানামো বে বন্দিশিবিরে আটক আজমত খান নামের একজন আফগান যুবকের। যাকে ৯/১১-এর পরবর্তী যুদ্ধে আফগানিস্তানের বাগরাম থেকে আটক করা হয়। এই আফগান যুবকের সঙ্গে মাইক মার্টিনের শারীরিক অবয়বের মিল থাকায় তার জায়গায় মাইক মার্টিনকে ঢুকানো হয় জেলে এবং তাকে সরিয়ে ফেলা হয় গোপন স্থানে। এবং খুব চমৎকারভাবে আজমত খানরূপী মাইক মার্টিনকে আদালতে পাঠানো হয় এবং তাকে বেকসুর খালাস দিয়ে আফগানিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। যেনো সেখান থেকে সে আলকায়েদার শীর্ষব্যক্তিদের কাছাকাছি যেতে পারে এবং তাদের পরিকল্পনা জানতে পারে। 

আজমত খানরূপী মাইক মার্টিন যদিও এই বানোয়াটি কাজে সফল হয় তবে লেখক হিসেবে ফ্রেডরিক ফরসাইথ এখানে বড়ো বেশি আত্মবিশ্বাসের পরিচয় দিয়েছেন। 

ধরে নিলাম আফগানযুদ্ধে আজমত খানের পুরো পরিবার এবং গ্রাম ধ্বংস হয়েছে। অন্যান্য বন্ধু-পরিচিতজনরা হয়তো শহীদ হয়েছেন নয়তো কারাগারে আছেন, কেউ তাকে চিনবে না। তবুও তিনি এলেই তাকে কেনো বরণ করে নেবে আলকায়েদা? আলকায়েদার লোকের কি এতোই অভাব পড়েছে যে, সদ্য কারামুক্ত একজনকে তাদের চরম গোপনীয় কাজে অঙ্গীভূত করতে হবে?

মি. ফরসাইথ আলকায়েদার চরম গোপনীয় কাজটির ব্যাপারে প্রবল গোপনীয়তা বজায় রেখেছেন বইয়ের একদম শেষ অধ্যায়ের আগ পর্যন্ত। শেষ অধ্যায়ে আমরা জানতে পারি, কুইন মেরি-২ জাহাজে জি-এইট শীর্ষ সম্মেলনের ব্যাপারে এবং আলকায়েদার ষড়যন্ত্রের হাকিকত। কুইন মেরি জাহাজকে মধ্য আটলান্টিকে ডুবিয়ে দিতে তারা একটি জাহাজ ছিনতাই করে সেটিকে জীবন্ত বোমায় পরিণত করে। কিন্তু অল্পের জন্য তাদের সে ষড়যন্ত্র সফল হয় না। কেননা সেই জাহাজে তখন আলকায়েদার আত্মঘাতি হামলাকারীর ছদ্মবেশে অবস্থান করছিলো মাইক মার্টিন। সুতরাং উপসংহার কী হতে পারে তা বলাই বাহুল্য।

এখানে ফরসাইথের ওপর আরেকটি দোষারোপ করা যায়, তিনি মাইক মার্টিনকে একজন দুর্ধর্ষ আফগান আলকায়েদায়িস্ট সাজিয়ে জাহাজে চড়িয়েছেন ঠিকই কিন্তু সেখানে তাকে কোনো প্রয়োজনীয় কাজ দিতে পারেননি। সে যদি কোনো বিষয়ে স্পেশালিস্ট হতো তবে না হয় জাহাজে তার অন্তর্ভুক্তিটা যুক্তিযুক্ত হতো, কিন্তু জাহাজে গিয়ে তাকে স্রেফ মাছি মারতে হয়েছে। এরকম মাছি মারা কেরানিকে আলকায়েদা কেনো দলে ভেড়ালো, চিন্তার বিষয়! সুতরাং আবার বলতে হচ্ছে, মি. ফরসাইথ এখানে কল্পনাকে একটু বেশিই প্রশ্রয় দিয়েছেন। 

এই হচ্ছে ‘দি আফগান’ উপন্যাসের সার সংক্ষেপ। একথা সত্য যে, ফরসাইথের এ নভেলটি কোনো নায়ককেন্দ্রিক বা চরিত্রকেন্দ্রিক নয়। এমনকি প্রয়োজন ছাড়া কথোপকথনকেও তিনি এড়িয়ে গেছেন উদারহস্তে। সাধারণত ফ্রেডরিক যেটি করে থাকেন। মূলত বর্ণনাই হয়ে উঠেছে এ নভেলটির মুখ্য আলোচক। আর সে বর্ণনার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন টান টান উত্তাপ। 

তবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে তিনি বেশ কিছু মিথ্যা বাগড়ম্বরও করেছেন। যেমন তিনি কওমি মাদরাসা সিস্টেমকে উগ্রপন্থার আঁতুড়ঘর বলে আখ্যা দিয়েছেন। অবশ্য পশ্চিমে এভাবেই মাদরাসাবিরোধী প্রচারণা খুব জোরে শোরে চলছে। তিনি ধর্ম বিষয়ে তার অতি উদারনৈতিকতার মনোভাব বুঝাতে গিয়ে মদ বা নারীসঙ্গকেও খুব একটা দোষী ভাবেননি। এগুলো তার কাছে জীবনেরই একটা অংশ। বেশ বুঝা গেছে, ধর্ম বিষয়ে তিনি ওয়েস্টার্ন ইসলামকে গ্রহণীয় মনে করেন, আরব থেকে উৎসারিত ইসলামকে নয়।
তবে তাকে সাধুবাদ দিতে হবে, এই উপন্যাসে কোনো যৌনতা নেই। সত্যি বলতে এ উপন্যাসে কোনো নারী চরিত্রই নেই। একদম নারীবিবর্জিত বলা যায়।

আপনাকে অবাক হতে হবে ফরসাইথের কাহিনীর বুনট পড়ে। তিনি এই উপন্যাসের অন্দরে আফগানিস্তান তো বটেই, পাকিস্তান, আরব আমিরাত, ফিলিপাইনসহ বেশ কয়েকটি দেশের যোগসূত্র টেনেছেন। এসব দেশের যে এলাকার বর্ণনা তিনি দিয়েছেন সবই আনুপুঙ্ক্ষিক। তা ছাড়াও ধর্ম, ভূগোল, আধুনিক টেকনোলজি, সামরিক স্পর্শকাতর তথ্যাদি, আধুনিক সমরাস্ত্র বিষয়ে তার বর্ণনা ভাববার মতো। একজন লেখক হতে হলে তাকে কতোটা গভীর জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে তা ফরসাইথের উপন্যাস পড়লে সহজেই অনুমান করা যাবে।

বই হিসেবে ‘দি আফগান’ অবশ্যই সুপাঠ্য। তবে পাঠের মধ্যে সবচে বেশি ভুগিয়েছে অনুবাদ এবং সম্পাদনাহীন বানান দেখে। বইভরা প্রচুর বানান ভুল তো রয়েছেই সেই সাথে অনুবাদকের কাঠখোট্টা ধরনের অনুবাদও স্বাদ দিতে পারেনি উপন্যাসের। আমাদের দেশের অনুবাদে অধিকাংশ অনুবাদক যেটা করেন, তারা আক্ষরিক অনুবাদ করে ক্ষান্ত হন। কখনো বুঝতে চান না যে, এটা উপন্যাস, ব্যকরণের বই নয়। উপন্যাস অনুবাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে মুন্সিয়ানা দেখায় সেবা প্রকাশনী। তারা উপন্যাসের গল্পটাকে অনুবাদ করে, বইয়ের অক্ষর অনুবাদ করে না। এবং এটাই হওয়া উচিত। বলতে ভুলে গেছি, উপন্যাসটি অনুবাদ করে প্রকাশ করেছে বাতিঘর প্রকাশনী, ২০০৮ সালে।

পুনশ্চ : এই বই নিয়ে হঠাৎ কেনো লিখতে হলো, সেটা সহজকথায় বলা যাবে না। কেননা সহজকথা যায় না বলা সহজে। বইটি পড়ার পর কেবল মনে হয়েছে, কিছু বিষয় ঠিক আছে আবার কিছু বিষয় ঠিক নেই। তাছাড়া আফগান বা আলকায়েদা নিয়ে এমন জোরালো উপন্যাস এর আগে আর পড়া হয়নি। কৌতূহল ছিলো, সেটা নিবারণের কারণেই ব্যাপারটা অন্যকে জানানোর তাগিদ অনুভব করলাম। 

সবচে বড়ো যে চিন্তাটা মাথায় ঢুকেছে, পশ্চিমারা তাদের আধুনিক টেকনোলজি এবং গভীর অধ্যয়নের মাধ্যমে যেভাবে আমাদেরকে তাদের নখদর্পণে আটকে রেখেছে আমরা তার ধারে কাছেও নেই। এই বই পড়ে সেই শূন্যতা নতুন করে অনুমিত হলো। ইসলামিস্টরা কেবল বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট আর মুক্তাঙ্গন গরম করার মুরোদ রাখে। বাস্তবিকপক্ষে যুদ্ধটা তো এখন আর রাজপথে নেই। যুদ্ধটা এখন চলে এসেছে বইয়ের পাতা আর মাউসের ক্লিকের নিচে। উদ্ভট উদ্ভট সব ব্যাপার স্যাপার নিয়ে গলাবাজি না করে ইসলামিস্টদের উচিত প্রচুর অধ্যয়ন এবং সার্বিক বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা। যার শূন্যতা নতুন করে অনুভব করলাম।